আকাশের তারারা

লিখেছেন:বিমান চক্রবর্তী

 

সপ্তর্ষিমন্ডল (ছবি - কিউরিয়াসপোর্ট) 

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই লোডশেডিং চলছে। গরম পড়তেই ইদানিং ঘন ঘন এই সমস্যা বেড়েই চলেছে এই মফস্বল শহরে। বিশেষ করে সন্ধ্যের পর এটা কোনো কোনো দিন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। সিঁড়িঘরের কোণায় রাখা মাদুরটা নিয়ে সুবীর ছাদে উঠে এলো। ছাদ জুড়ে ও পায়চারি করছে। এদিক ওদিক চাইছে। চারদিক অন্ধকার। শান্ত নিস্তব্ধ এক পরিবেশ। দুরে রেলষ্টেশনের আলোর ছটায় পশ্চিম আকাশ কিছুটা উদ্ভাসিত। দক্ষিণে মিশনারি স্কুলের প্রাচীরের গায়ে পরপর সার দেওয়া উঁচু গাছগুলোর অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে মাঝেমাঝে ধরা দেয়। ফিরফিরে হালকা হাওয়া বয়ে চলেছে। ছাদে মাদুর পেতে সুবীর শুয়ে পড়ে। মাথার ওপর বিস্তীর্ণ নক্ষত্রজগত। আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। কত সহস্র কোটি বছর ধরে তারারা রয়ে গিয়েছে। এই একইভাবে আলো দিয়েই চলেছে। এ এক অবাক ও বিস্ময়কর ব‍্যাপার। পৃথিবীর বুকে প্রথম এককোষী প্রানী থেকে বানর শিম্পাঞ্জি হয়ে আধুনিক মানুষের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে থেকেছে এই তারারা। শুধু কি তাই? টেথিস সাগর থেকে হিমালয়ের উৎপত্তি অথবা কয়েক হাজার বছর আগে একদা নদী হ্রদ বেষ্টিত সবুজ তৃণভূমি বনাঞ্চল শোভিত অঞ্চল কিভাবে সাহারা মরুভুমিতে পরিণত হয়, সবই আকাশের তারারা তাদের চোখ দিয়ে দেখেছে। মিশর সুমেরীয় হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর উন্নত মানবসভ‍্যতার বিকাশ তারা চাক্ষুষ করেছে। আকাশের শোভা দেখতে থাকে সুবীর। রাতের আকাশকে বড্ড ভালো লাগে তার। অজানা আকাশ সুবীরকে ভীষনভাবে টানে। তাই সময় পেলেই সে ছাদে এসে তারাদের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তারারা কোথাও ঘনবিন‍্যস্ত কোথাও আবার একলা একলা ছাড়া ছাড়া। সুবীর অবশ‍্য অনেক তারাদেরই চেনে। তাদের নামও জানে। তাদের উৎপত্তি কিভাবে, তাদের রঙ দেখে সে এখন বলে দিতে পারে, বলতে পারে সে তারারা নবীন না প্রবীণ। জীবনের কোন দশায় এখন সে তারারা আছে, এটাও সুবীর জেনে গিয়েছে। বাবা ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের অধ‍্যাপক। সুবীর তখন ছোট। তখনও লোডশেডিং হতো। ছাদে পাতা মাদুরের একপাশে শুয়ে মা রেডিও শুনতো। আর বাবা? সুবীরকে আকাশের তারা ধরে ধরে শোনাতেন তাদের জন্মবৃত্তান্ত, তাদের ইতিহাস। সুবীর বিভোর হয়ে যেত সেসব শুনে। শুনতে শুনতে কল্পনার জগতে ভর দিয়ে তার অবচেতন মন চলে যেত কতশত নক্ষত্রলোকের দোরগোড়ায়। ঐ যে কালপুরুষের কোমরবন্ধনী, ওতে আমরা দেখি তিনটে নক্ষত্র। মাঝেরটা অনিরুদ্ধ। সবচেয়ে উজ্বল। সূর্যের চেয়ে চল্লিশ গুণ বড় তার আকার। অনিরুদ্ধের দুই দিকে রয়েছে চিত্রলেখ ও ঊষা। আর কোমরের নীচে যে তরবারি দেখা যায়, সেখানে আছে এক বিশাল নীহারিকা। দুর থেকে তাকে তারা বলে মনে হয়। আর লুব্ধক? সবাই জানি এই নাম। সে হচ্ছে কালপুরুষের কুকুর। আসলে পৃথিবীর কাছাকাছি এক দ্বিমিক তারা সে। দুটো তারা পরস্পরকে প্রদক্ষিন করে চলেছে। সুবীরের কেন জানি বারবার মনে হয় কালপুরুষ আর সপ্তর্ষিমন্ডল তার খুব আপন। খুব নিজের। সে আকাশে সপ্তর্ষিমন্ডল খুঁজে বের করে আর ভাবে সপ্তর্ষিমন্ডলের সাত ঋষির নামগুলোও কত সুন্দর। ক্রতু পুলহ পুলস্ত অত্রি অঙ্গিরা বশিষ্ঠ আর মরীচ। সাতজন ঋষি জিজ্ঞাসা চিহ্নের ন‍্যায় আকাশে রয়ে গিয়েছেন। আরো মজার ব‍্যাপার আছে এখানে, বশিষ্ঠের পাশেই আছে আরো এক তারা। ঔজ্জ্বল্যতা তুলনামূলক কম। নাম অরুন্ধতী। কি দারুন নামটা! যেন এক আধুনিকা রমনী। ইনি আবার বশিষ্ঠ ঋষির স্ত্রী। কি সুন্দর এনারা আকাশেই সংসার পেতে ফেলেছেন। আর রয়েছে আমাদের সবার প্রিয় ধ্রুবতারা। সুবীরের বাবা আঙ্গুল নির্দেশ করে বলতেন, উত্তর আকাশের রাজা। ইনি স্থির নিশ্চল। সবসময় সারাবছর একই জায়গায় তাকে দেখা যায়। পথভ্রষ্ট কতশত পথিককে এই রাজা পথ দেখিয়েছেন। মাঝ সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কত নাবিককে পথ চিনিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শুধু কি তাই? কত গান কত কবিতা লেখা হয়েছে এই ধ্রুবতারাকে নিয়ে। পৃথিবীর সাহিত্যে ধ্রবতারা এক বহুল চর্চিত নাম। সুবীর জানে আসলে তিনটে তারার সহাবস্থানে গঠিত এই ধ্রুবতারা। মহাকাশে কেউই স্থির নয়। সবাই ঘুর্নায়মান। এটাই মহাকাশের নিয়ম। থামলে চলবে না এখানে। সবাই সবার সঙ্গে প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করে চলেছে। পৃথিবীর অক্ষের সঙ্গে ধ্রুবতারার ঘুর্ণনের গতি এক হওয়াতে সে আপাত স্থির থাকে আমাদের চোখে। অথচ প্রায় তের হাজার বছর পর এই ধ্রুবতারা কিন্তু আর থাকবে না। সে স্থান পরিবর্তন করে চলে যাবে আকাশের অন‍্য প্রান্তে। আমরা অবশ‍্য তাকে দেখতে পাবো। ধ্রুবতারার স্থান তখন দখল করবে অভিজিৎ নক্ষত্র। এও এক নীল ধ্রুবতারা। কোন এক দূর ভবিষ্যতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই অভিজিৎকে দেখেই মুগ্ধ হবে। অভিজিৎকে নিয়েই তখন তৈরি হবে কত গান গল্প উপন‍্যাস। অভিজিতকে সাক্ষী রেখেই ঘরে ফিরবে কত পথ হারানো পথিক, মাস্তুল ভাঙা নাবিক।

এখনো আলো আসে নি। লোডশেডিংটা ইদানীং বেশ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। সুবীর জানে এই লোডশেডিংয়ের রাতেই তারা দেখা তারা চেনা সহজ হয়। ওপরে রাতের আকাশের বুক চিরে মিটিমিটি আলোর নিশান দেখিয়ে ইতিউতি ধীরলয়ে এগিয়ে চলে একটা উড়োজাহাজ। সুবীর মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। অসীম বিশ্বের বুকে মানব সভ‍্যতার একটা সামান্য চিহ্ন যেন বহন করে চলেছে এই উড়োজাহাজ! সুবীর ভাবে শুধু শেষ পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীর বুকে বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। কিন্তু তবু সর্বশক্তির উৎস যে সূর্য, তার নির্গত শক্তির সামান্য এক ভগ্নাংশ মাত্র আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি। বাকিটা হচ্ছে না আমাদের কারিগরি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে। এই মুহূর্তে আমরা হয় তো পারছি না কিন্তু আমাদের আগামীর মানবকুল এই বিপুল শক্তির সদ্ব্যবহার করবেই করবে। এছাড়া আর কোনো পথ যে নেই। সৌরশক্তিই হবে মানবসভ্যতা এগিয়ে নিয়ে যাবার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু এই যে সূর্য আদি অনন্তকাল থেকে তার পরিবারের সকল গ্রহ উপগ্রহদের তাপ আর আলো দিয়ে যাচ্ছে, তারও তো একদিন শেষ আছে। এই মহাবিশ্বে কোনো কিছুই তো স্থায়ী নয়। সবাই সৃষ্টি আর বিনাশের মাঝেই ঘোরাফেরা করে চলেছে। এটাই তো রীতি। এই মুহূর্তে সূর্য রয়েছে তার জীবনচক্রের মধ‍্যভাগে। ইতিমধ্যেই সৃষ্টির পর সূর্য কাটিয়ে ফেলেছে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। যৌবন পার করা এই নক্ষত্রের অভ‍্যন্তরে প্রতি মুহূর্তে হাইড্রোজেন পরমানু যুক্ত হয়ে হিলিয়ামে পরিনত হচ্ছে। নির্গত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ শক্তি। সেটাই মহাশূন‍্যের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার পরিবারের দিকে। এভাবে সূর্যের মধ্যে জ্বলতে জ্বলতেই কোন এক দূর ভবিষ্যতে শেষ হবে হাইড্রোজেনের ভান্ডার। বিজ্ঞানীদের হিসেব সেটা হবে আরো প্রায় ৫০০ কোটি বছর পর। এরপর শুধু শেষের পালা। বিনাশের ইতিহাস তখন রচিত হতে থাকবে। ঐ যে বলে মরণ কামড়। নিভে হওয়ার আগে শেষবারের মতন জ্বলে ওঠা। তার তাপ উষ্ণতার প্রভাবে খাক হয়ে যাবে বুধ শুক্র এবং আমাদের সাধের পৃথিবী। মুছে যাবে মানবসভ্যতার সব চিহ্ন। মানুষ জীবজন্তু গাছপালায় ভরা প্রাণচঞ্চল পৃথিবী পরিণত হবে নিস্প্রাণ নিথর এক ধুসর ছাইয়ের দেহাবশেষে। পাখি গান গাইবে না, গাছপালা সালোকসংশ্লেষ করবে না, শিশু মা বলে ডাকবে না, খাদ‍্য-খাদকের থাকবে না কোনো সংজ্ঞা।  পৃথিবী তখন শুধু এক মৃত গ্রহ। নিজের অজান্তে মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায় সুবীরের। তবে সঙ্গে সঙ্গে মনে প্রশ্ন চলে আসে,  কী হবে তখন?  মানবসভ্যতা ততদিন থাকবে নাকি নিজেরাই নিজেদেরকে বিলুপ্ত করে দেবে? যদি মানবপ্রজাতি থেকেই যায়, বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কেমন হবে তাদের আকার?  আন্তঃনক্ষত্রলোকে যাতায়াত নিশ্চয় ততদিনে করায়ত্ত হবে। আলোর গতিবেগের কাছাকাছি ছোটার গতিবেগ প্রযুক্তি নিশ্চিতরূপে আবিস্কৃত হয়ে যাবে। পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে কত নতুন পাহাড় পর্বত গজিয়ে উঠবে। আজকের আফ্রিকা মহাদেশ দুভাগ হয়ে যাবে। সৃষ্টি হবে কত নতুন মহাসাগর মহাদেশ। এসব ভেবেই আকুল হয়ে যায় সুবীর। অসীম এই মহাবিশ্বের বুকে লুকিয়ে রয়েছে কত রহস‍্য। তার কিছুটা জানলেও অধিকাংশই রয়েছে আমাদের নাগালের বাইরে। সেসব জানার মতন প্রযুক্তির উদ্ভাবন আর জ্ঞানের উন্মোচন এখনো হয় নি। তাই সুবীর একান্তভাবেই চায়, এগিয়ে চলুক বিজ্ঞানের অগ্রগতি। উন্নত বিজ্ঞানচর্চায় ভর করে আগামী দিনে পৃথিবীর প্রতিনিধি হিসেবে মানবকুল মহাবিশ্বের প্রাঙ্গণে প্রান্তরে রেখে দিক আমাদের চিহ্ন।

 

0 Comments
Leave a reply