রাইডার অ্যাপটা থেকে সন্ধ্যের প্রথম ট্রিপটার খবর এল। ‘সন্ধ্যের আপাত শান্ত নির্জনতাকে চিরে ফালা ফালা করে দিয়ে একটা তাগিদকে প্রতিষ্ঠা করে দেবে’ এই বাণী বুকে করে, গ্রহণযোগ্য কোন একাকিত্ব আর কোলাহলের মাঝামাঝি, দ্বন্দ্ববিহীন এক বৈপরীত্বের সংকেত হয়ে। আজ উনিশে ফেব্রুয়ারী ২০২৫। দুবাইয়ের মাটিতে ভারত-নিউজিল্যান্ড মুখোমুখি হয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে। খেলা শুরু হবার প্রায় মুখে মুখে এন্টালির ননী গোপাল রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে স্বরূপ। আজ এমনিতেই রোববার, কলকাতার রাস্তায় মানুষজন কম। সারাটা সপ্তাহ যে শহরটা কলকলিয়ে ওঠে জীবনের যাবতীয় ব্যস্ত সাউন্ডস্কেপে, সপ্তাহান্তের এই একটি দিনে সে সলিটিউডের আবছায়ায় নিজেকে আপাদমস্তক মুড়ে ফেলে, শব্দ ও শব্দান্তরের মাঝে দৃশ্যগত ফারাক খুঁজতে থাকে। তবু যদি দু-একটা ট্রিপ পাওয়া যায় কোন অদৃশ্য দৈব জাদুবলে তবে তা পাওয়া সম্ভব এই নিউটাউন চত্ত্বরেই। এই তথ্য প্রযুক্তিই এমন এক শিল্প যার চাকা রোববারেও গড়ায়। এমনিতেই যত রাত বাড়ে ট্রিপের সংখ্যা বাড়তে থাকে এখানে। বিশেষ করে আইটি-র মহিলা কর্মীদের বিশেষ পছন্দ এই ট্রান্সপোর্টেশন অ্যাপের বাইক রাইড। স্বস্তা এবং সেফ! স্বরূপের মত শয়ে শয়ে শিক্ষিত বেকার এখন এ লাইনে দিব্যি করে খাচ্ছে।
যাত্রীর লোকেশন দেখাচ্ছে ইউনিটেক সেজ্ মেইন গেট এর কাছে। হাতের ফোনটা থেকে ‘হটস্টার’টা বন্ধ করে বাইকটা স্ট্যান্ড থেকে নামিয়ে দাঁড়ায় স্বরূপ। রবীন্দ্রতীর্থর মেইন গেটের পাশে বেশ একটু গা সওয়া অন্ধকারের মাঝে গাড়িটা পার্ক করেছিল ও। মাথায় হেলমেটটা চাপিয়ে ক্লাচটা চেপে ধরে বাইকটা স্টার্ট দেয় এবার। এর মধ্যেই ট্রিপটা একসেপ্ট করে নিয়েছে ও। জায়গাটা খুব বেশি দূর নয় এখান থেকে। খেলাটার কোন আপডেট আর নেওয়া হবে না এই যা! তা সে বাহ্যিক হাসি-মজা-আনন্দ এসব রংচঙে জিনিসগুলো চিরকালই হার মেনে এসেছে পেটের খিদের কাছে, এটা অতি অল্প বয়স থেকেই মানতে শিখে গেছে স্বরূপ। গ্র্যাজুয়েশন করে যখন টাকা পয়সার অভাবে পড়াশুনাটা বেশীদূর আর করা গেলো না, বাড়িতে বাবা বেকার, শারীরিক সামর্থ্য নেই কিছু করার, মায়ের অসুখ সেদিনই স্বরূপ ঠিক করে নিয়েছিল কিছু একটা করতে হবে! কিছু টাকা পয়সা জমাতে হবে। বাইকটা ফিন্যান্সে কিনে নিয়ে এই বাইক রাইডিং অ্যাপে কাজ করা শুরু করেছিল। শুরুতে পেমেন্ট খারাপ না থাকলেও ইদানিং যাত্রীদের সুবিধাটা দেখতে গিয়ে, বিশেষ বিশেষ ডিসকাউন্ট অফার দিতে গিয়ে রাইডারদের দিকটা আর দেখেনা কোম্পানি! পেটে টান পড়ে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা স্বরূপ। এটা ছাড়া ও আর কীই বা করত? ফুড ডেলিভারি? ও ধান্দায় যা অপমান সহ্য করতে হয়! স্বরূপের এক বন্ধু ও লাইনে ছিল। একদিন তো প্রচন্ড ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে স্বরূপকে বলেছিল, “দূর শালা রেলে মাথা দিয়ে দেব।” তবু তো স্বরূপ নরমে গরমে যাত্রীদের সাথে ডিল করতে পারে। কখনও সখনও কোম্পানিকে এড়িয়ে ডাইরেক্ট ডিল করে নেয়! ওর মত এত স্বল্প শিক্ষিত ছেলেকে এই বাজারে কেই বা চাকরী দেবে? ক্লাচটা হাতে চেপে বাইকটায় ফার্স্ট গিয়ার দিল স্বরূপ। হঠাৎই বাইকটা যেন একটু পিছন দিকে ধাক্কা দিল। এতক্ষন তো ছিল না! এমনকি বাড়ি থেকে এতটা চালিয়ে এসেছে স্বরূপ, কই কিছু তো বোঝেনি! ক্লাচপ্লেট এর কোন ইস্যু নাকি? সেকেন্ড গিয়ারেও ঠিক যেন স্পিড নিচ্ছে না! কি করবে স্বরূপ এখন? রাইড টা ক্যানসেল করে দেবে? যদি সেরকম ঝামেলাবাজ পার্টি হয় তাহলে তো কমপ্লেইন ঠুকে দেবে! কিছুক্ষণ মনে মনে ভাবল স্বরূপ। পরে ঠিক করলো সন্ধ্যের প্রথম রাইড! না বউনির টাকা ছাড়া ঠিক হবে না। ট্রিপটা শেষ করে ক্লাচ প্লেটটা খুলে না হয় দেখা যাবে। একটু আস্তেই না হয় যাবে! ইঞ্জিন খুব বেশী গরম না হলেই হল। চোখ বুজে একবার মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো স্বরূপ! টেনশনে পড়লে ও এটা করে। মাকে মনে মনে দেবতার মত পুজো করে প্রায় ও! সামনের ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে বাঁদিক চেপে এসে দাঁড়াল স্বরূপ। আজ সন্ধ্যের প্রথম অতিথি তাড়াতাড়ি ওর সামনে এসে উপস্থিত হলে ও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে! পারফেক্ট লোকেশনেই তো এসে দাঁড়িয়েছে ও! আজ রোববার বলে এদিকে খাবার দোকানের ঝোপড়িগুলোও বন্ধ। জায়গাটা জুড়ে আজ যেন ছড়িয়ে আছে আরো গাঢ় অন্ধকার। তারই সঙ্গে যেন প্রায় গায়ে গায়ে মিশে আছে কালান্তক শূন্যতার সাথে নিগূঢ় চেতনার রহস্যময় এক কথোপকথন! সেই ফিসফিসানি যেন শুনতে পায় স্বরূপ। আসন্ন বসন্তের মৃদু শিরশিরানি যেন গায়ে এসে লাগে ওর। চোখে মুখে টুকরো টুকরো অস্থিরতা এসে জমা হতে থাকে। কব্জি ঘুরিয়ে কমদামি রিস্ট ওয়াচটায় সময় দেখে ও। এখন ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকারটার ওপর ট্যাঙ্ক ব্যাগটার ভেতর হালকা একটা জ্যাকেট, একটা ছাতা, জলের বোতল, শুকনো কিছু খাবার নিয়ে নিয়েছে ও। আজ সারারাত ট্রিপ করার ইচ্ছে আছে ওর, একদম কাল ভোর ছটা অবধি! সুতরাং এগুলো ঠিকই লাগবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা সিগেরেট ধরাতে যাবে, এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা ঠান্ডা উপস্থিতি যেন টের পেল স্বরূপ! একটা নারী শরীর! পিছনে ঘাড় না ঘুরিয়েই সেটা দিব্যি বলে দিতে পারে স্বরূপ। কমদিন তো আর এ লাইনে হল না! স্বরূপ জানে প্রতিটা মেয়েশরীরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। পেছনের সিটে বসা মেয়েদের খোলা চুলের ঢেউ বেয়ে ভেসে আসা মাত্রাহীন সেই সোঁদা সোঁদা গন্ধগুলোয় কিংবা ওদের গা বেয়ে কূলহীন নদীর মত বয়ে এসে কালবেলার সীমাকে অতিক্রম করে, পুরুষ শরীরের কোন গোপন প্রকোষ্ঠে ঢেউ তোলা সুমিষ্ট পারফিউমের গন্ধই যেন ওদের আলাদা করে চিনিয়ে দেয়! যদিও স্বরূপ ছেলে হিসেবে নেহাত মন্দ নয়। আজ অবধি কোন ফিমেল প্যাসেঞ্জার ওর বিরুদ্ধে ‘ব্যাড টাচ’ বা ‘ফিলদি বিহেভিয়ার’ এর কমপ্লেইন করেনি। সুস্থতাকে নিজের জায়গা করে দিতে জানে ও। পিছন দিকে না ফিরেই ওটিপিটা জিজ্ঞেস করে স্বরূপ, কোন উত্তর আসে না। শুধু দুটো মেয়েলি হাতের স্পর্শ স্বরূপের দুটো কাঁধে এসে পড়ে। সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে যায় ওর! একটা ঝালঝাল এলাচ-দারুচিনি ভাঙা-বারুদ ঘেঁষা-রংমশাল পোঁড়া গন্ধ এসে লাগে স্বরূপের নাকে। একটা আনুমানিক যৌনগন্ধ! এমন গন্ধ হয়তো কোনদিন রোহিণীর শরীর ছুঁয়ে পশমিনা বাতাস হয়ে আসতো, তেতলার ছাতের ঘরে। সারাদিনের শ্রমে ভেজা ক্লান্তি আর ধারাবাহিক ঘনত্ত্বে পথ চলার একটা স্থির গন্ধ, ঠিক যেমনটা হয়তো আজও সন্ধ্যে সাতটা বাজলে পাড়াগেঁয়ে তুলসীতলা থেকে ভেসে আসে। স্বরূপ মন্ত্রমুগ্ধের মত স্টার্ট দেয় বাইকটা! ওর মস্তিস্ক অবাস্তব মনোলোগের মত একবার ওকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চায়, “হেলমেটটা পড়ে নিন।” অ্যাপটা যেন দুর্বার কোন মোহমায়ায় আপনা থেকেই রুট ম্যাপ দেখতে শুরু করেছে। মোট একুশ মিনিটের রাস্তা, গন্তব্য বেলেঘাটা আইডি কোয়ার্টারের কাছাকাছি। স্বরূপ বিশ্ববাংলা গেট রেস্তোরাঁর আন্ডারপাস পেরিয়ে সোজা বিশ্ববাংলা সরণী ধরে, ফেয়ারফিল্ড বিল্ডিং, ক্রোমার শোরুম বাঁয়ে ফেলে ‘স্বপ্নভোর’ মেট্রো স্টেশনের তলা দিয়ে ডানদিকে লেমন ট্রি প্রিমিয়ার বিল্ডিংকে ফেলে রেখে সেক্টর ফাইভের ফ্লাইওভারে উঠে পড়ে। পেছনে বসা ছায়াশরীর যেন তখন স্বরূপের দিকে ঝুঁকে পরে ক্রমশঃ ওর শরীরটাকে আঁকড়ে ধরছে। ঠিক যেমন নিঃসঙ্গ, নিশ্চুপ, ছায়াচ্ছন্ন শোভাবাজারের বুকে গ্যাস চুল্লিতে বসানো জ্বলে যাওয়া ভাত আর টক ডালের গন্ধ হয়ে ভেসে থাকা পোড়ো বাড়িটাকে চেপে ধরে থাকে, অনন্ত সূর্যাস্ত পেরিয়ে আসা বট অশ্বত্থের ঝুড়ি। বুড়িয়ে যাওয়া শব্দরা সেখানে খেলা করে সম্পর্কের শরীর জুড়ে। স্তব্ধতার ভিতর ঠিক সেরকম একটা সচেতন শরীরী সঞ্চার চলতে থাকে ওদের মাঝেও! বাক্যের অবশেষগুলো লেগে থাকে কোণায় কোণায়!
সত্যি স্তনের কি অদ্ভুত কুহক! অন্যান্য দিনের চাপা অস্বস্তিগুলো আজ অনায়াসে যেন কবিতার মত ভালো লাগার বৃষ্টি নামায়। স্বরূপের গোটা পিঠ ভরে থাকে উত্থিত সুডৌল এক জোড়া নারীস্তনে! পৃথিবীর দুই গোলার্ধ এই মুহূর্তে যেন ওর দখলে! রাস্তার দুপাশের তেপায়া বাতিস্তম্ভের গায়ে ঝিকিঝিকি ঝিল্লিওয়ালা এল.ই.ডি স্ট্রিপগুলোর সর্পিল উপস্থিতি, সামনে সান্ধ্যকালীন বাসন্তিক অন্তরীক্ষে ভারী মাথা নিয়ে স্থির হয়ে যাওয়া উদ্ধত বহুতল, আঁধো অন্ধকারে ডুবে গিয়ে বাজারদরের আলো জ্বেলে রাখা কর্পোরেট অফিস, তারই মাঝে অন্তধীর ছায়াপথ হয়ে কালপুরুষ-ধ্রুবতারার উজ্জ্বল জ্যোতির্মন্ডল, মাথার ওপর পূর্ণিমা থেকে সামান্য সরে আসা লালচে চাঁদ, এই সব কিছুই এই ক্ষয়ে যেতে থাকা সন্ধ্যের মায়া মমতায় অনায়াসে ভুলিয়ে দিতে পারে উপস্থিত অতিথির নাম-নক্ষত্র-উদ্দেশ্য-বিধেয়। তবু ভোলা যে যায় না তার কারণ এই যাত্রাপথে চারপাশের সবকিছুই যেন বড় শান্ত সমাহিত! অপূর্ব এক আত্ম সম্মোহন যেন বিরাজ করছে এই শহরের চিরায়ত ধ্বনিপ্রবণ নাগরিক কথকতায়! শুধু এই দৃশ্যময় স্তব্ধতার মাঝে শরীরী বিহঙ্গে অবাধ গতিময়, স্বরূপের সফরসঙ্গিনী। লোলুপ জিহবা দিয়ে সে তখন স্বরূপের কানদুটো জুড়ে স্বরবর্ণ চলনে এঁকে চলেছে চুমু আর সিডাক্টিভ ক্রিয়ার বিস্তৃত আল্পনা। গুনগুন করে একটানা দীর্ঘ্য একটা বাক্যরাজি ভেসে আসে স্বরূপের কানে, প্রবাহ পথে কান পেতে থাকে স্বরূপ। অর্ধ জ্ঞানে অর্ধ নিমজ্জনে স্বরূপ শোনে, অস্থির হাওয়ার সাথে কথোপকথনে যেন কবিতা রচনা হচ্ছে। বড় চাপা সে শব্দ! একমাত্র তীব্র মনোযোগী কোন শ্রোতার অনুভব বোধের উপর নির্ভর করেই যেন ঝরে পড়ছে শব্দজননীর এই আশ্চর্য্য সংকেতময় বিস্তার! আসা যাওয়ার পথে লুব্ধ চোখে সিগন্যালে কান পাতে স্বরূপ। কল্পনায় চেনার চেষ্টা করে সেই ক্ষীণ অথচ বর্ণময় কাহন।
“একটা খোলা রাত!
চেনাগাছের থেকে অশুচি অন্ধকার ধার চেয়ে নিচ্ছি।
নির্বাক হিংসায় হা-হুতাশ পাগলের দল,
ভয়ের একটা বস্তুবাদী ভীত ছাড়িয়ে
স্নিদ্ধ বালকের ছায়া বোনে,
বাষ্পাকুল আচ্ছন্ন মায়া জীবনের শিকড়ে গিয়ে।
রক্ত ভাঙা গোলাপী গন্ধে ম-ম করে চতুর্দিক!”
উচ্চারণ হয়তো ভীষণ অস্পষ্ট! তবু যেন তা ভাবের ঘরে দোল দিয়ে যায়। ভাবনার পাল ঠেলে স্বরূপ গিয়ে ভেড়ে দশটা বছর পেছনে। যাতায়াতের দোরগোড়ায় পরে থাকা অবশিষ্ট চা টুকু বেয়ে যখন, পিঁপড়ের ওঠানামাকে পেছনে ফেলে চৈত্রের রোদ এসে পড়ত ভিক্টরিয়া কিংবা মোহরকুঞ্জের শাখামুখে। কত সহস্র শনি রবিবার জুড়ে যখন ও রোহিনীকে কবিতা পড়ে শোনাত। এরই ফাঁকে ওরা সেক্টর ফাইভ ফ্লাইওভার পেরিয়ে টেকনোপলিসের এর সামনে দিয়ে নির্মীয়মান মেট্রো লাইনের তলা দিয়ে এসে, সেক্টর থ্রি এর খালপাড়ের রাস্তা বেয়ে, বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে করুণাময়ী মোড়ে পৌঁছেছে। নেভিগেশন বলছে, এবার বাম দিকে সোজা। সামনেই মণিপাল হাসপাতাল। এটাই আগে ‘কলম্বিয়া এশিয়া’ ছিল। মণিপাল তো সল্টলেক আমরিকেও নিয়ে নিয়েছে এখন! আরেকটু এগোলে ডানদিকে ‘যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন’।
“পশ্চিম পারের সূর্য্য বলেছিল
ইতস্তত কোন অমিত আয়ুর কথা।
জলের সমুদ্র পেরিয়ে আসা জলের মতই সহজ ছিল এতদিন।
সন্ধ্যেটা ফুরিয়ে গেলে কোন পশুর হাত
আগুনের পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়াল!
যমুনাবতী কমলে কাজলে, এখন ইতিহাসের সিলেবাসে।
অবিচুয়ারী লেখা হবে তার নামে।
পূর্ণচ্ছেদে জমা হয় কালো গোলাপ!
আসলে কি বলতে চেয়েছিল, আর কি বলে গিয়েছিল,
এক আকাশ অভিমান আকাশ জুড়ে ফুটে উঠেছিল শুধু!
সুতোহীন উষ্ণতায় একটু একটু করে জামা ছেঁড়া হবে তার!
একটু একটু করে রমণের শ্যামল জঙ্ঘায় হয়তো
জড় হয়েছে একগোছা বিবাদী জোঁক।
যেন শবের শরীরে অসুরের সঙ্গম!”
একরাশ মুহূর্তের ভিতর জেগে থাকা স্বপ্নের গভীরে ডুব দিয়েছে যেন স্বরূপ! কি অপূর্ব শব্দচয়ন! কি অসামান্য দখল! চাপা অথচ কি গভীর মেটাফিকশন! দুটি নদী যেমন লম্বা পথ পেরিয়ে এসে মিশে যায় তুরীয় সঙ্গমে, সেখানে একজনের স্নিগ্ধতা আর অন্যজনের উচ্ছাস একে অপরকে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসে, ঠিক তেমন কবিতাগুলোর ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে কি ভীষণ একটা এলোমেলো আলিঙ্গনের রীতি! এই নদীর ঢেউহীন মোহনায় নিজেকে ছেড়ে রাখতে মন চায় স্বরূপের। আবার ওর কানের কাছে হিলহিলিয়ে সেই মহিলাকণ্ঠ। বলে ওঠে,
“প্রেমিকের শিকড়ে শব্দেরা হেঁটে যায়!
নির্জন নগ্ন বৃক্ষকে জড়িয়ে থাকে নির্বাক হিংসা।
গুল্মলতার ভারে নয়নতারা পাখনা মেলে
লাল গোলাপ হয়। তারা দেখে এক নির্জন কালো রং!
দোলযাত্রা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে ক্রমশঃ
এক ভ্রান্তিবিহ্বল বালিকার অপ্রকাশিত কৈশোর।
বনস্পতি বেড়ে উঠছে অযুত মঙ্গল কামনায়।
রাস্তার পিচ জুড়ে শুধুই ছলনা নদী বয়ে যায় শতভাগে।”
নিজের বাম গাল জুড়ে একটা নরম স্পর্শ অনুভব করে স্বরূপ। ঠিক যেন কোন উন্মুক্ত পাখির শরীর থেকে ছিঁড়ে আনা একটা মসৃণ পালক, নিজের শরীরের দীর্ঘ্য ছায়ায় রোদ গুটিয়ে নিয়ে, বিরহের ক্যানভাস এঁকে দিচ্ছে ওর গালের খসখসে অমসৃণ চামড়া জুড়ে। মেয়েলি ঠোঁটের উপর লেগে থাকা স্যালাইভার মত মৃদু সুগন্ধে স্বরূপ বুঝতে পারে ওটা গোলাপফুল। রঙের পিঠে রং চাপিয়ে স্বরূপের চোখে ভেসে ওঠে, ইতিউতি উড়ে বেড়ানো অন্ধকারের প্রজাপতিরা! ওর নরম ছায়াচ্ছন্ন মনে তীব্র উষ্ণতার গন্ধ চাগাড় দিয়ে অদম্য এক প্রশ্ন জাগে, ফুলটার রং কি? লাল-নীল-হলুদ রঙের অবাস্তব মনোলগেরা ভিড় করে ওর শুনশান হৃৎপিন্ডটা জুড়ে।
বেলেঘাটা মোড় থেকে সোজা যেতে গিয়ে সিগন্যালে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা। চারপাশে এখন জাতীয় পতাকা আর আতসবাজির রোশনাই। ভারত জিতেছে তাহলে! মনের মধ্যে বাস্তব আর পরাবাস্তব একসাথে ভুবনজোড়া ঢেউ বুনছে যেন স্বরূপের। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় নাকা ফর্মেশন ঠেলে বাম দিকে পড়ে থাকা সরকার মাঠের সামনে দিয়ে সোজা এসে বেলেঘাটা আইডি কোয়ার্টারের মেইন গেটের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। অনেক ছোটবেলায় এখানে একবার এক আত্মীয়ের বিয়েতে এসেছিল স্বরূপ। এই রাস্তাতেই সেদিন একটা কুকুর ছানাকে চাপা দিয়েছিল নাম না জানা মৃত্যুর সংকেতবাহী কোন আরোহী! বাচ্চাটার দেহটাকে সামনে নিয়ে মা কুকুরের সে কি বুক ফাটা কান্না! আজও মনে আছে স্বরূপের। চারিদিকটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে জমাটবাঁধা কালচে রক্ত! দৃশ্যটা যেন ওর চোখের সামনে ঝলসিয়ে ওঠে হঠাৎ! বেলেঘাটা আইডি কোয়ার্টারের ভোল পুরো বদলে গেছে এখন। আগের মোড় থেকে ডানদিক নেয় ও। এইখানেই এক চিলতে গুমোট অন্ধকারে ঢেকে আছে ছোট গেটটা। হঠাৎ সামনে ছায়ার মত ভেসে ওঠে কিছু মদ্যপ যুবক। প্রত্যেকেই এরা বাইক আরোহী। টেনে হিঁচড়ে জোর করে এক যুবতীকে নিয়ে যাচ্ছে কোয়ার্টারের বাউন্ডারির ভেতর! আর কিছুক্ষন পরেই এরা সবাই মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে, এই গৌরবর্ণা অনাম্নী নরম শরীরটিকে। কোয়ার্টার গুলোর রং হঠাৎ কেমন যেন পাল্টাতে থাকে। সেই ছোটবেলায় দেখা গায়ে শ্যাওলার দাগ ধরা, ভাঙা-চোরা ভুতুড়ে চেহারাটা যেন ফুটে উঠতে থাকে স্বরূপের চোখের সামনে। পেছন থেকে ভেসে আসে সেই মা কুকুরের দোমড়ানো মোচড়ানো বুকফাটা কান্না! মুহূর্তের মধ্যে চৈতন্য হারায় স্বরূপ। বাইকের পেছনটা হঠাৎ হালকা মনে হয় ওর। সামনে একটা প্রচন্ড আলো, তারপরই স্বরূপের দুচোখ জুড়ে নেমে আসে ক্লান্ত-শ্রান্ত ভাঙাচোরা অন্ধকার।
রাস্তার ঠান্ডা ব্যস্ততা চিরে আশেপাশে তখন গুটিকয়েক কৌতূহলী মানুষের জটলা। ইতিউতি টায়ার জ্বালিয়ে ভারতের জয় উদযাপন চলছে। বাজি ফাটছে দেদার। বেলেঘাটা আইডি কোয়ার্টার এর ছোট গেটের মুখে রংহীন অন্ধকারে তখন কাত হয়ে পড়ে আছে একটা কালো রঙের বাইক। পাশেই মুখ থুবড়ে পরে আছে বাইকারের দেহ। মাথার পিছনটা খুবলে গিয়েছে যেন। সেখান থেকে চুঁয়ে পড়ে গাঢ় রঙের রক্ত জমা হচ্ছে, পিচকালো রাস্তার বুকে হঠাৎই গজিয়ে ওঠা মসৃণ মোলায়েম কৃষ্ণগহ্বরে। বুকের ভিতর তখনও বিপ-বিপ-বিপ, বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি। রাস্তার ধারের ‘অ্যাক্সিডেন্ট প্রোন এরিয়া’ কশন বোর্ডটা অন্ধকারে ঠিক করে দেখতে পায়নি স্বরূপ। হয়ত আরো একটা ভুল কোনোদিন করেছিল স্বরূপ! হয়তো বা কারো বুক ভরা জমাট অভিমান হেলায় ফেলে ভাসিয়ে এসেছিল ও। এগিয়ে এসেছিল অনেকটা জীবন। প্যারাবোলিক কক্ষপথ ধরে গ্রহের আপাত ঘূর্ণনে এসে দাঁড়িয়েছিল এমন একটা প্রস্তর সমাধিতে, যেখান থেকে দূরবীক্ষণেও মাপা যায় না ফেলে আসা শব্দের নিমেষহীন দীর্ঘ্যশ্বাস। স্বরূপের চোখের সামনে একবার রোহিণীর মুখটা ভেসে ওঠে। একবার হয়তো সেই অশরীরির কালো হয়ে যাওয়া পাংশু মুখটাও দেখতে পায় স্বরূপ! তার তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁতগুলো যেন কালো হয়ে যাওয়া ঠোঁটের ফাক থেকে ঝলমল করে ওঠে। সে ঠোঁটে তখন ক্রুঢ়তার হাসি!
কেউ দেখেনি এতক্ষণ, রাস্তার এককোণে তখন পড়ে আছে একগোছা গোলাপ। রাস্তার কালো কিংবা জমাট বাঁধা রক্তের কালো অথবা রাতের নিয়মমাফিক ছায়াহীন কৃষ্ণময়তা বা ধুলোয় মিশে যাওয়া নির্বাক কোন কবিতার শরীরে বাসা বাঁধা কোন কালো রঙের পাপ, ওদের হাড়মাংসহীন বিবর্ণ শরীরে ইচ্ছেমত কালো বসন্তদাগ এঁকে দিচ্ছে ততক্ষণে!