এমন নয় যে পৃথাকে, শতায়ু পছন্দ করে না। তবু থাকতে পারল না এক বাড়িতে, এক ছাদের নিচে। সৌমাল্য যা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শতায়ুর সঙ্গে আলোচনা করেই।
পৃথাকে বলেওছে, "তোমার, আমার সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে, যদি শত মত দেয়। কারণ, একই বাড়িতে থেকে কোনওরকম মনোমালিন্য হওয়াটা সুখের নয়। তা ছাড়া, তুমি আমার জীবনে যতটা, শত তার থেকেও কিছুটা বেশি।"
পৃথা বলেছে, "সম্পর্ক মানেই কি বিয়ে ? এই যে আমাদের রোজ কথা হওয়া, প্রায়ই দেখা হওয়া আর মাঝেসাঝে দু'তিন দিনের ট্যুর, এই বা কম কী!"
"বেশি বয়সের প্রেমের এই সুবিধা, জানো তো। দু'জনেই পোড় খাওয়া। জীবনের খারাপ দিকগুলোর সঙ্গে দু'জনেরই পরিচয় থাকে। তাই চাহিদা কম।"
শতায়ু কিন্তু জোর করেছে বাবা'কে, "পৃথা আন্টি আমাদের সঙ্গে এসে থাকলে অসুবিধা কোথায় ?"
তারপরেই রেজিস্ট্রি করার সিদ্ধান্ত নেয় সৌমাল্য আর পৃথা।
*
সৌমাল্যর জীবনে বসন্তের একটা প্রভাব আছে। স্মৃতির সঙ্গে তার বিয়ে ফাল্গুনে। স্মৃতির মৃত্যুও ফাল্গুনে। বসন্তের আবেগী বাতাস গায় মেখে চিরদিনের জন্য পাড়ি দিয়েছে স্মৃতি বহু দূর দেশে। সৌমাল্য আর স্মৃতির জীবনে শত এসেছিল এমনই এক বসন্তের বিকেলে। আজ পৃথাও এল নব বসন্তের ডালি সাজিয়ে।
পৃথাকে 'মা' 'মা' লাগেনি কোনোদিনই শতায়ুর। বাড়িতে নতুন অতিথি এলে যেমন হয়, ক'দিন বেশ একটা আনন্দ ঘিরে থাকে, একটু গল্প করতে ইচ্ছা হয়, তেমনই। কিন্ত পৃথা যখন সংসারের সব দায়িত্ব একে একে নিজের কাঁধে নিতে শুরু করল, গণ্ডগোল বাঁধল তখন থেকে। কোথায় একটা মানতে না পারার কষ্ট শতায়ুকে পেয়ে বসল।
শতায়ুকে ভালো রাখার অতিরিক্ত চেষ্টা, শতায়ু কী খাবে, কী পরবে, যখন তখন গিফট্ কিনে এনে হাজির হওয়া, এর একটাও ভালো লাগছিল না শতায়ুর।
মায়ের শোকে যেটুকু প্রলেপ পরেছিল, পৃথার অতি ভালোবাসার চাপে আবার তাতে নতুন করে ক্ষত সৃষ্টি হলো। কিন্তু সৌমাল্য আর পৃথার ভালোবাসাকে এতটুকুও অসম্মান করল না শতায়ু। স্বেচ্ছায় অফিস থেকে ব্যাঙ্গালোরে ট্রান্সফার নিয়ে বাড়িতে বলল, "অফিস পাঠাচ্ছে।"
*
ব্যাঙ্গালোরে একটা সুবিধা, এখানে কলকাতার মতো গেল গেল রব নেই। অগ্নির সঙ্গে একই ফ্ল্যাট শেয়ার করতে কোনও বাধা আসেনি। শতায়ু আর অগ্নি যে শুধু নিছক বন্ধু নয়, সে ওদের দেখেই বোঝা যায়। এখানেই প্রথম দেখা। তার আগে ফেসবুকে যোগাযোগ।
অগ্নি বলেছে, "উপহাস যে, কোন্ লেভেলের হয়েছে, ভাবতে পারবি না। স্কুলের জুনিয়র থেকে শিক্ষকরা পর্যন্ত। 'হাফ লেডিস' নাম ছিল আমার। যারা এই ভুল ইংরেজি শব্দটা বলত, তারা ছিল টিচারদের স্নেহভাজন। আর ইংরেজিতে ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া আমি, ছিলাম উপহাসের পাত্র।"
এবার শতায়ু যা বলল তা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না অগ্নি। "আমার অভিজ্ঞতা একদম অন্যরকম। ক্লাসমেট রিয়া আমার পেছনে পড়ে থাকত। আমি এড়িয়ে যেতাম। একবার বন্ধুরা মিলে মন্দারমণি গেছিলাম। সুযোগ পেয়ে রিয়া আমার খুব কাছে এসেছিল। তারপরেই ছিটকে সরে গেছিল। ও কিছু একটা বুঝেছিল। তারপর থেকে আমাকে এভোয়েড করত। আরও কত কী যে ফেস করেছি। পৃথিবীতে আমার মতো করে আমাকে বুঝেছে শুধু আমার মা।"
*
সৌমাল্য ফোনে আজকাল প্রায়ই শতায়ুকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। শতায়ু উত্তর দেয়, "সবাইকেই স্রোতের অনুকূলে ভাসতে হবে না কি? এই তো বেশ আছি।"
আজকাল পৃথাও একই ধরনের ইঙ্গিত দেয়। পৃথার সঙ্গে শতায়ুর সম্পর্ক কোনোদিনই মাতা-পুত্রের মতো হয়ে ওঠেনি। বরং বলা যায়, পৃথা এমন একজন, যার কাছে অনেক কিছুই বলা যায়।
পৃথার কথার উত্তরে শতায়ু একদিন বলল, "অকারণ আমাকে চাপ দিও না। আমার লাইফ পার্টনার আছে। কিন্তু সে'ও একজন পুরুষ।"
শতায়ু যতটুকু বুঝেছে, পৃথাকে আধুনিক মনস্ক বলেই মনে হয়েছে। সেই পৃথাও থমকাল। এদিক থেকে শতায়ুর হাসি মিশ্রিত কণ্ঠ, "কী হলো, নিতে পারলে না তো?"
"না, না। তা কেন? ভাবছি তোমার বাবা আবার কীভাবে নেবে!"
"যেভাবেই নিক, আমার কিছু যায় আসে না।"
প্রত্যাশা মতোই ছেলেকে ফোন করা বন্ধ করল সৌমাল্য। ভুলে গেল, নিজের দ্বিতীয় বিয়েতে তার দিকের একমাত্র সাক্ষী ছিল শত। পৃথা বুঝিয়েছে, কাজ হয়নি। সৌমাল্য অফিসে গেলে সুযোগ বুঝে শতায়ুকে ফোন করে পৃথা।
একদিন নাম শুনে চমকে উঠল।
"কী নাম বললে? অগ্নি? কি করে ছেলেটি?"
"হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করে প্রথমে পুণেতে ছিল। এখন ব্যাঙ্গালোরে সেটল্ করেছে।"
পৃথা হাঁপাচ্ছিল। বলল, "বাড়িতে কে কে আছে বলেনি?"
"বলছিল একদিন, ওর মা থাকে কলকাতায়, তার নিজের মতো। কেউই নাকি কারোর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।"
ফোন রেখে দু'হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে থাকে পৃথা। সৌমাল্যকে সব কথা বলার সাহস হয়নি আর। এমনিতেও আজকাল আর শত'র কথা শুনতে আগ্রহ দেখায় না সৌমাল্য। প্রসঙ্গ উঠলে বিরক্ত হয়। কিন্তু পৃথা এখন কী করবে? অগ্নিকে বলবে, শতায়ু আমার হাজব্যান্ডের ছেলে? এক অর্থে, সে তোমার ভাই। অগ্নিই বা কীভাবে নেবে! হাজারো চিন্তা গ্রাস করে পৃথাকে।
*
পৃথা যে'টুকু যা বলতে পেরেছে, তাই শুনে ক্ষেপে গেল অগ্নি। যা ওর চরিত্রের বাইরে তা'ই করে বসল। কেউ কখনও অগ্নিকে গলা তুলে কথা বলতে দেখেনি। সেই অগ্নি গলা ফাটিয়ে বলল, "হু ইজ সৌমাল্য? আমি তাকে চিনি না। তার একটা কেন, দশটা ছেলে থাকতে পারে। কোন হিসেবে তারা আমার ভাই হয়?"
এবার কণ্ঠস্বর খাদে গেল। নিজস্ব নমনীয় ভঙ্গিতে বলল, "জানি মা, আমাকে জন্ম দিয়ে তোমাকে ভুগতে হয়েছে প্রচুর। লোকে জানতে চাইত, তোমার ছেলে 'মেয়েলি' কেন? আমার কণ্ঠস্বরে, আমার হাঁটাচলায় তুমি অসম্মানিত বোধ করতে। আমি তাই তোমার থেকে দূরে দূরেই থাকতে চেয়েছি। তোমার পার্সোনাল ব্যপারে আমি যখন ইন্টারফেয়ার করিনি। তুমিও কোরো না, প্লিজ।"
ফোন বন্ধ করে অগ্নি। অগ্নির থেকে সব শুনে শতায়ু একেবারে অবাক।
"পৃথা আন্টির ছেলে আছে, বলেনি তো কোনওদিন। অবশ্য বলতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই।"
*
শতায়ু আইটিতে আছে। দু'বছরের জন্য ওকে অনসাইটে লন্ডনে যেতে হচ্ছে। এই ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। অফিসের পয়সায় বিদেশ যাওয়া, আরও নানারকম সুযোগ সুবিধা। তবে এবারে মনটা খুবই ভারাক্রান্ত। ওর একমাত্র পিছুটান অগ্নি। বাবার জন্য চিন্তা যেটা, সে বাবার বয়স হচ্ছে। বাড়তি অনুভূতি কিছু নেই। বাবা নিজেই যেখানে সম্পর্ক রাখতে চায় না। সরু সুতোর মতো যেটুকু বন্ধন এখনও রয়েছে, তা ওই পৃথা আন্টির জন্যই। তবে পৃথার সঙ্গেও সম্পর্কের বাঁধন এমন নয় যে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে বলে মন খারাপ হবে। ব্যাঙ্গালোরে আসার পর আর তো কলকাতায় ফেরেনি একবারও। তাই হৃদয় জুড়ে যে থেকে গেল, সে অগ্নি। কলকাতায় থাকতে অগ্নির সঙ্গে ভিডিও কল, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং যেমন ছিল, লন্ডনে গিয়ে আবার জীবন সে পথেই হাঁটতে লাগল। তবু শতায়ুর মন মানে না। তবে, এতটা উতলা অগ্নি নয়। জীবনের মায়া মোহ, বন্ধন সব কিছুরই ও কারণ খোঁজে। নিজেকে বুঝতে চায়। প্রকৃতিতে ঘটে চলা প্রতিটি ঘটনাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে। মায়ের সঙ্গে ওর বন্ধনটা আলগা। কিন্তু শত্রুতার নয়। বরং ওর জন্য মাকে লোকের কাছে অপদস্থ হতে দেখে মনে মনে দুঃখিতই হয়েছে, নিজেকে অপরাধী ভেবেছে। মা'র সম্মান বাঁচাতেই ওর বাইরে চলে যাওয়া। এমনকী মায়ের বিয়ের সিদ্ধান্তকে ও দূর থেকে স্বাগত জানিয়েছে। বিয়ের সময় উপস্থিত থাকতে চায়নি সব দিক চিন্তা ভাবনা করেই।
অগ্নির বাবা মারা যাবার পর থেকে পৃথা বড়ো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ছেলেকে নিয়ে উপহাস সইতে সইতে ছেলের উপরেই তীব্র আক্রোশ তৈরি হয়েছিল। অগ্নি পুনেতে চলে গেলে সামাজিক লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পেলেও এক ভয়ঙ্কর একাকিত্ব পৃথাকে ঘিরে ধরল। এই একাকিত্ব কাটাতেই সৌমাল্যর বাড়ানো হাতে হাত রাখল পৃথা।
*
পুজোর ছুটিতে যখন ভিন-রাজ্যে থাকা ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফেরে, অগ্নি তখন একা একা ঘুরে বেড়ায়। কখনও কেরালায় গিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখে, কখনও হিমালয়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। পাহাড়, নদী, ঝর্ণার মধ্যে কী খুঁজে বেড়ায় অগ্নি! কখনও বা পুরীতে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত সি-বিচে বসে সমুদ্রের দিকে এক মনে চেয়ে থাকে। সাগরের বিশালতার কাছে নিজেকে একটা বিন্দুর মতো মনে হয় ওর। নিজের মনেই ভাবে, আমি যদি হারিয়ে যাই, ভেসে যাই এই সমুদ্রে! সমুদ্রের তাতে কিছু এসে যাবে না। সে কোটি কোটি প্রাণ বুকে ধরে রয়েছে। নাম না জানা কত জলজ জীব বেঁচে রয়েছে সাগরের কোন গভীরতায়, মানুষ কি তার সঠিক হিসেব আজও পেয়েছে? অফিসে যখন কাজ করে অগ্নি, তখন মন দিয়েই করে। কাজে ওর ফাঁকি নেই। ও জানে, ঈশ্বর ওকে ঠিক ওই কাজটুকুর জন্যই জন্ম দিয়েছেন। ওর জীবন ধারণের জন্য এটাই ওর একমাত্র কাজ। তবু ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় ওর মনে। আসলে কাদের জন্য করছে ও? যাঁদের আছে, তাঁদের জন্য। তাঁরা ফাইভ স্টারে জায়গা না পেলে সেভেন স্টারে যাবে। ফুটপাথে, স্টেশনে রাত কাটানো মানুষগুলোর কি তাতে কিছু এসে যাবে?
*
বছর খানেক পরে শতায়ু একবার দেশে ফিরল। কলকাতায় যায়নি। ব্যাঙ্গালোরে অগ্নির ফ্ল্যাটেই উঠল। এবারে অবশ্য নিজের খরচেই আসা যাওয়া। মধ্যিখানে এলে অফিস খরচ দেবে না। অগ্নি যে শুধু ওর জীবন-সঙ্গী তা নয়। অগ্নির জীবনবোধ, জীবনদর্শন শতায়ুকে মুগ্ধ করে। বলে, "তোর সঙ্গে থাকলে না, জ্ঞান বাড়ে।"
অগ্নি হাসে। বলে, "এ বিশ্বের কতটুকু আমরা জানি!"
"আমার থেকে তো বেশি জানিস। আমি কেন? বহু লোকের থেকে বেশি জানিস তুই।"
"তা ঠিক নয়। এটা তোর মনে হচ্ছে। আমরা আসলে আপেক্ষিকতায় বিশ্বাসী। তুই একজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবি, কত কম জানি আমি। অথচ, সেই বিজ্ঞানীও কিন্তু সব জানেন না। তিনি যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন, শুধু সেটাই জানেন। ডাস্টবিন থেকে রাস্তার কুকুরের সঙ্গে যে মানুষটি খাবার ভাগ করে খায়, তার জীবন সম্বন্ধে কোনও ধারণা কি তিনি দিতে পারবেন?"
শতায়ু চুপ করে থাকে। অনেকটাই নীরবতার পর শতায়ু বলে, "আমি কেন তোর মত করে ভাবতে পারি না অগ্নি?"
অগ্নি শতায়ুকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। বলে, "আমিও যে তোর মত গাইতে পারি না। তুই কাছে থাকলে আমার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে। মনে হয় আমার জীবনেরও একটা মূল্য আছে। নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় না।"
শতায়ু চোখ বন্ধ করে বলে, "আমারও বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ তুই। তোর জন্যই অত দূর থেকে আমি ছুটে এলাম।"
সময় বয়ে যায়। এই বহমানতায় না আছে কোনও কোকিলের কুহুতান। না আছে সদ্য ফোটা হাসনুহানার গন্ধ। তবু দুটো প্রাণ পরস্পরকে কাছে পেয়ে ভালো থাকে। সমগ্র বিশ্ব না বুঝুক, ওরা বোঝে এই ভালোবাসাও ঈশ্বরেরই দান।
*
অগ্নির অফিসে কাজের চাপ আছে। তবু শতায়ু এসেছে, অগ্নি কয়েকদিন অফিস ছুটি নিল। ছুটি অবশ্য শতায়ুরও নেই। রোজই ল্যাপটপ খুলতে হয়। তার মধ্যেই কদিন ছুটি নিয়ে ওরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াল। একদিন অগ্নি বলল, "এক জায়গায় যাবি আমার সঙ্গে? তোর কতটা ভালো লাগবে জানি না। আমি ওখানে গেলে কিছুটা শান্তি পাই।"
"কোথায়? জায়গাটা বল।"
"বোলপুর।"
শতায়ু উৎফুল্ল, "চমৎকার জায়গা। শান্তিনিকেতন যাইনি অনেকদিন।"
"শান্তিনিকেতন তো যাব। এ ছাড়া আরও একটা জায়গায় যাব।"
বোলপুর স্টেশন থেকে ওদের টোটো যখন নিরিবিলি এক আশ্রমের গেটের সামনে থামল, দু'জনের কারোর মুখেই কথা নেই। পাখির কূজন ছাড়া কোনও শব্দ নেই। অথচ, সন্ন্যাসীরা সবাই নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন মুখ বুঁজে। উপাসনা গৃহ যেন এক চরম শান্তির জায়গা। এক পাশে অনাথ বাচ্চাদের স্কুল। মহারাজদের অমায়িক ব্যবহার ও আপ্যায়নে শতায়ু প্রায় বাকরুদ্ধ। একটা বেলা ওই আশ্রমে কাটিয়ে ওরা যখন শান্তিনিকেতনে আগে থেকেই বুক করে রাখা হোটেলে পৌঁছল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ।
ঘরে ঢুকেই শতায়ু অগ্নিকে জিজ্ঞাসা করল, "তুই বোধহয় ওই মিশনে ফিনান্সিয়াল হেল্প করিস।"
অগ্নি কোনও উত্তর দিল না।
*
তখনও কিছু তারা শুকিয়ে যাওয়া জলের ফোঁটার মতো রয়ে গেছে আকাশের মাঝে। পুবের আকাশ হয়তো বা তুলির আঁচড় কেটেছে। অগ্নির ঘুম ভাঙ্গে এক সুরেলা কণ্ঠস্বরে, "রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে, তোমায় আমায় দেখা হলো সেই মোহানার ধারে ....."
অগ্নি নিঃশব্দে হোটেলের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। শতায়ু চোখ বন্ধ করে গাইছে। গানও যে প্রকৃতির একটা অংশ অগ্নি নিজের কান দিয়ে চোখ দিয়ে তা অনুভব করল। গান শেষ করে অগ্নিকে দেখে দুহাত বাড়িয়ে দিল শতায়ু। চার হাতের মিলনে যখন শুধুই ভালোবাসার স্পন্দন শতায়ুর গলায় তখন আরও একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, "তুমি সুখী থাকো, আমার পানে চেয়ে চেয়ে সুখী থাকো...."
*
লন্ডনে ফিরে যাবার দিন, শতায়ুর চোখ ছলছল করছিল। অগ্নি বুঝতে পেরে ওর পিঠ চাপড়ে বলল, "কাম অন ডিয়ার। আর তো একটা বছর। তাছাড়া রোজই তো ভিডিও কল, হোয়াটসঅ্যাপে কথা হবে।"
কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে অঝোরে কাঁদল অগ্নি। নিজেকে প্রশ্ন করল, "শতায়ু আমার কে? কয়েক বছর আগে ওকে তো আমি চিনতামই না। আমাদের মাঝে যদি শুধুই শারীরিক সম্পর্ক থাকে, তাহলে মন আজ কেন উথাল-পাথাল? এ সবই কি ঈশ্বরের সৃষ্টি!"
শরীর আর মনের মধ্যে যে যোগসূত্র রয়ে গেছে, তার কোনও কূল পায় না অগ্নি। তখনই ওর মনে দ্বন্দ্ব আসে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে। হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ এগুলোকে মানুষ অনুভূতি বলে। কিন্তু অনুভূতি জিনিসটা কী? কেন তাকে দেখা যায় না! কেন স্পর্শ করা যায় না! উত্তর পায় না অগ্নি।
শতায়ু থাকলে সুখে দুঃখে একরকম কেটে যায় অগ্নির। কিন্তু ও না থাকলে অফিস থেকে ফিরে অগ্নিকে হাজারো ভাবনা ঘিরে ধরে। যার কোনও নিশ্চিত উত্তর ওর কাছে নেই। যা আছে, শুধুই সম্ভাবনা।
*
শতায়ুর বাবার অফিস থেকে অবসর নেবার সময় হলো। শতায়ু নিজেও ইতোমধ্যে লন্ডনের পাট চুকিয়ে ব্যাঙ্গালোরে ফিরে এসেছে। একদিন একটু বেশি রাতে পৃথার ফোন আসে শতায়ুর কাছে।
"সৌমাল্য হসপিটালে অ্যাডমিটেড। বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। আবাসনের ছেলেরা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সব ব্যবস্থা করেছে।"
পৃথা ফোনটা হাসপাতাল থেকেই করেছে। এদিক থেকে শতায়ুর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, "আমি অগ্নিকে নিয়ে কালকেই আসছি। এখন কন্ডিশন কেমন? ডক্টর কী বলছেন?"
"আরে না, না। এখনই আসতে হবে না। আইসিইউ'তে আছেন। আর .... একটা কথা।" থেমে যায় পৃথা।
"হ্যাঁ, বলো। কী বলবে।"
"এলে একাই এসো। অগ্নিকে আনতে হবে না। বাবা তো তোমার। তাই তোমাকেই খবরটা দিলাম।"
পরদিন শতায়ু একাই গেছে কলকাতায়। পৃথা আন্টির শেষ কথাগুলো বলেনি অগ্নিকে। বেরোনোর সময় অগ্নি বলল, "দরকার হলে জানাস। আমি চলে যাব।"
এ যাত্রা বেঁচে গেল সৌমাল্য। বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে তবে ব্যাঙ্গালোরে ফিরেছে শতায়ু। ছেলেকে দেখে আদৌ খুশি সৌমাল্য হয়েছিল কিনা বোঝা গেল না। তবে, একেবারে মুখ ঘুরিয়েও নেয়নি। বাবার চিকিৎসার খরচ সবই দিয়েছে শতায়ু। পৃথা আপত্তি করেছিল। শোনেনি। ব্যাঙ্গালোরে ফিরে রোজই ফোনে পৃথার সঙ্গে কথা বলে বাবার শরীরের খবর নেয় শতায়ু। যে কদিন শতায়ু ছিল, একদিনও পৃথা জানতে চায়নি অগ্নি কেমন আছে। এমনকী রাতে ফোনে কথা বলার সময়ও না। অথচ পৃথা রোজ আশা করে, শতায়ুর থেকে ফোনটা নিয়ে হয়তো অগ্নি বলবে, "কেমন আছ, মা?"
আর অগ্নি? কান পেতে থাকে। মায়ের গলাটা যেটুকু শোনা যায়। কতবার ভেবেছে, শতায়ুকে জিজ্ঞাসা করবে, "হ্যাঁ রে, তুই যখন কলকাতায় ছিলি, মা একবারও জানতে চায়নি আমার কথা?"
তবু পারেনি বলতে। বাবার শরীর খারাপের পর থেকে শতায়ু বছরে দুবার অন্তত কলকাতায় যায়। বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ হয় না। যা হয় পৃথার সঙ্গেই। এবারে অগ্নি এল ওর সঙ্গে। কিন্তু হোটেলে উঠল আর মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে শতায়ুর হাতে দিয়ে বলল, "দিয়ে দিস। আমি দিয়েছি বলার দরকার নেই।"
শতায়ু শাড়িটা পৃথার সামনে ধরে বলল, "অগ্নি পাঠিয়েছে। তুমি কি নেবে?"
পৃথার দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে থাকে। হাত বাড়িয়ে শাড়িটা নিয়ে বুকে চেপে ধরে।
*
কলকাতা থেকে অগ্নি আর শতায়ু আবার গেল পুরীতে। পুরী ওদের খুব পছন্দের জায়গা। সি-বিচে বসে অগ্নি নিজেকে হারিয়ে ফেলে। মুখে কথা নেই। শুধু দুচোখ দিয়ে প্রকৃতির স্বাদ নিতে থাকে।
শতায়ু হঠাৎ বলল, "অসীম জলরাশির কাছে আমরা কত নগণ্য!"
অগ্নির যেন ধ্যান ভঙ্গ হলো। বলল, "কে বলল, জলরাশি অসীম? পৃথিবীর জলভাগের তুলনায় স্থলভাগ এত কম, তাই আমাদের মনে হয় জলরাশি অসীম। এই জলরাশিরও একটা সীমা আছে। শুধু সীমানা নেই আকাশের। আকাশ, মহাকাশ যা'ই বল, শেষ কই?"
শতায়ু অবাক হয়ে অগ্নির কথা শুনে একবার আকাশের দিকে তাকাল। তারপর নিজের মনেই বলল, "সাগরের তবু তল পাওয়া যায়। তোর মনের তল পাওয়া কঠিন। কোনও যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি, যা দিয়ে তোর মনের গভীরতা মাপা যায়। কোনও একক পর্যন্ত নেই।"
*
আজ কিন্তু বসন্তের হাওয়া নেই। দখিনা বাতাস পাল তোলেনি। ভরা বর্ষায় সে তরণী খেই হারিয়েছে। দুধ সাদা বৃষ্টিতে কিছুই প্রায় দৃষ্টিগোচর নয়। শুধু একটা বিকট বাজ পড়েছে। সেই বাজের শব্দ আর রাতের অশরীরীর মতো বিদ্যুতের বুক কাঁপানো হাসি অগ্নির হৃদয় নামক বস্তুটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিল।
গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে শতায়ু যেদিন মারা যায়, সেদিনটা ছিল অগ্নির জন্মদিন। পঁয়তাল্লিশ পার করে ছেচল্লিশে পা দেওয়া অগ্নি জীবনের এক কঠিনতম মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। পৃথাকে খবরটা ওই দিয়েছিল। সৌমাল্য, পৃথা ছুটে এসেছিল ব্যাঙ্গালোরে। সৌমাল্যর চোখে জল ছিল না। ছিল একরাশ ঘৃণা আর আক্রোশ। সবটাই অগ্নির প্রতি। আর মরমে মরে গেল পৃথা। সৌমাল্যর সামনে কাঁদতেও ভয় পায়। বাথরুমে গিয়ে কল চালিয়ে নিজের মনেই বলে, "আমার তো তবু সৌমাল্য আছে। কিন্তু আমার অগ্নি কী পেল?"
ছেলের জন্য উপহাস সইতে সইতে পৃথাও তো বিরক্ত হয়েছিল। ছেলেই মাকে অপমানের হাত থেকে মুক্তি দিতে ভিন-রাজ্যে চলে গেছিল। তখন মা হয়ে পৃথার ভূমিকা কী ছিল? পৃথা নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। শাওয়ারের জলে চোখের জল ধুয়ে যায় পৃথার।
অগ্নি চাক বা না চাক পৃথা এরপর থেকে অগ্নিকে মাঝেমাঝে ফোন করা শুরু করল। দার্শনিক অগ্নির জীবনদর্শনের ক্ষেত্র বাড়তে থাকে। পৃথা বোঝে ছেলে ওর অন্যরকম। শান্ত, স্থিতধী। শোক-দুঃখ হাসি-কান্নার ঊর্দ্ধে যেন ঈশ্বরের এক প্রতিমূর্তি।
*
এখন সৌমাল্য পঁচাশির দোর গোড়ায়। মৃত্যু এবার হাতছানি দিচ্ছে। পৃথাও বুঝতে পারছে, সৌমাল্যকে বিদায় জানানোর সময় এসেছে। পুরো চব্বিশ ঘন্টা সংজ্ঞাহীন থাকার পর সৌমাল্য যখন চোখ খুলল, কাকে দেখল? সব কেমন ধোঁয়াশা। চারপাশে যেন ধূপছায়া রঙ লেগেছে। তার মধ্যেই সৌমাল্য যাকে দেখল, সে যেন এক মহামানব। গেরুয়া বসন পরিহিত সৌম্য-দর্শন এক যুগপুরুষ। পরম মমতায় সে সৌমাল্যর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সৌমাল্য আবার চোখ বন্ধ করল। দু'চোখে তার অবিরত জলের ধারা। যে ধারা বইবার কথা ছিল শতায়ুর মৃত্যুর সংবাদে। সে ধারাই আজ খাল বিল নদী পেরিয়ে সাগরের নোনা জলে মিশে যেতে লাগল।
*****