#
শকুন
একটা শকুন সমানে আমার পা ঠুকরে যাচ্ছিল। আমার শক্তপোক্ত জুতোজোড়া এর মধ্যেই ছিঁড়ে খুঁড়ে গেছে, মোজারও শতচ্ছিন্ন অবস্থা; আর এইবারে সে আমার নিরাভরণ হয়ে আসা পা-দুটিকেও ঠুকরে ফালাফালা করে দিচ্ছে। শকুনটা বারবার উড়ে এসে আমার পায়ে আঘাত করছে; আর তারপর আমাকে ঘিরে অক্লান্ত কয়েক চক্কর কেটে নিয়ে নতুন আক্রোশে ও ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার উপর। এক ভদ্রলোক আমাকে অতিক্রম করে প্রায় চলেই যাচ্ছিলেন; তিনি কিছুক্ষণ থমকে এই দৃশ্য দেখলেন, আর তারপর অনুসন্ধিৎসু হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শকুনটির এই আক্রমণ আমি অহেতুক সহ্য করছি কেন। “তার কারণ আমি অসহায়”, - উত্তর দিলাম, “যখন ও প্রথমবার এলো আর আমাকে আক্রমণ করা শুরু করল, আমি ওকে তাড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ প্রয়াস করেছি; এমনকি শ্বাসরোধ করার চেষ্টায় ওর গলাও টিপে ধরেছি, কিন্তু এই সমস্ত জানোয়ার অত্যন্ত শক্তিশালী; আর ও আমার মুখে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিল, তাই আমি শেষ পর্যন্ত নিজের পা-টাকেই বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম; আর এখন তারা একেবারে ছিঁড়ে কেটে ফালাফালা হয়ে গেছে।” “কেউ যে বিনা প্রতিবাদে এই ভাবে নিজেকে নির্যাতিত হতে দিচ্ছে - এ আমার কল্পনাতীত”, ভদ্রলোক বললেন। “শুধুমাত্র একটা গুলি, আর তাই এই শকুনের ভবলীলা সাঙ্গ করার জন্য যথেষ্ট।” “সত্যি?”, আমি বললাম, “আর আপনি আমার জন্য এটা করবেন?” “নিশ্চয়ই, আনন্দের সাথে”, ভদ্রলোক প্রত্যুত্তরে জানালেন, “আমাকে শুধু একটিবার বাড়ি ফিরে আমার বন্দুকটা নিয়ে আসতে হবে। আপনি কি আর আধ-ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারবেন?’ “আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই”, আমি বললাম এবং এক মুহূর্তের জন্য তীব্র যন্ত্রণায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর আমি আবার বললাম, “তাও আপনি একবার চেষ্টা করেই দেখুন।” ভদ্রলোক বললেন, “বেশ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ফিরে আসছি।” আমাদের এই আলোচনা শকুনটি বেশ শান্ত হয়ে শুনছিল, আমার ও সেই ভদ্রলোকের দিকে ক্রমান্বয়ে তার দৃষ্টি আবর্তিত হচ্ছিল। এই এতক্ষণে আমি বুঝতে করলাম যে, সে আমাদের সমস্ত কথাই অনুধাবন করতে পেরেছে; এইবারে সে তার পাখা মেলল, আকাশের নীল সীমানায় নিজেকে সে পিছিয়ে নিয়ে গেল অনেকদূর - গতি অর্জনের জন্য, আর তারপর কোনো বর্শা নিক্ষেপকারীর মতই তীরবেগে ছুটে এসে, তার সুতীক্ষ্ণ চঞ্চু সমূলে বিঁধিয়ে দিল আমার মুখের ভিতর, - আমার শরীরের গভীরে। সেই ভয়ঙ্কর ও সুতীব্র অভিঘাতে মাটিতে পড়ে গিয়েও, আমি এই অনুভবে স্বস্তি পেলাম যে - সে শেষপর্যন্ত এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে আমারই রক্তে ডুবতে বসেছে, যে রক্ত আমার সমস্ত গভীরতা সম্পূর্ণ করে এখন চরাচর ছাপিয়ে উপচে পড়ছে।
#
গাছেরা
আমরা যেন তুষারে ছাওয়া শীতদেশের কোনো গাছের গুঁড়ি। আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চুপ, নিশ্চল, ও মসৃণ - সামান্য একটা ধাক্কাই বুঝি তাদের গড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। কিন্তু না, বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কারণ তারা এই মাটি, এই জমির সাথে সুদৃঢ় এক বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে। তবে দেখ, সেটাকেও তো একরকমের দৃষ্টিভঙ্গীই বলা চলে, তাই না?
#
একটি ছোট্ট উপকথা
“হায় রে”, ইঁদুরটা বলল, “পৃথিবীটা প্রতিদিনই কেমন ছোট হয়ে আসছে। অথচ শুরুতে এটা এতটাই বড় ছিল যে, আমি সবসময় ভয় পেতাম। আমি দৌড়তাম, খালি দৌড়তাম। সেদিন আমি কী ভীষণ খুশিই না হয়েছিলাম, প্রথম যেদিন দেখতে পেলাম দূরে, অনেক দূরে - আমার ডানদিক আর বাঁদিক জুড়ে চওড়া দেওয়াল। কিন্তু এই লম্বা টানা দেওয়ালগুলোও এখন এত দ্রুত সরু হয়ে আসছে যে, এরই মধ্যে আমি শেষ কামরায় এসে উপস্থিত হয়েছি। ওই কোণে এখন আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে একটা ইঁদুর-ধরা ফাঁদ যার উপর দিয়ে আমায় দৌড়ে যেতেই হবে।” “তোমাকে শুধু দৌড়ের দিক পরিবর্তন করতে হবে” - বিড়ালটা বলল এবং সে তাকে তৎক্ষণাৎ খেয়ে ফেলল।
*সাহিত্যে পরাবাস্তববাদের জনক বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা সাহিত্যিক ফ্রানজ্ কাফকার জন্ম - ১৮৮৩ সালের ৩রা জুলাই, বর্তমান চেক রিপাবলিকের রাজধানী শহর, প্রাগের - এক ইহুদি পরিবারে। কাফকার রচিত কাহিনীগুলি বাস্তবতা (রিয়েলিজম্) ও কল্পনার (ফ্যান্টাসি) মধ্যে এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল। তার লেখায় সমাজ-বিচ্ছিন্ন, একাকী নায়ক বিচিত্র কোন পরাবাস্তব পরিস্থিতি এবং একইসাথে অকল্পনীয় কোন সোশ্যিও-ব্যুরোক্রাটিক ক্ষমতা (পাওয়ার) ও তার বিবিধ আস্ফালনের সম্মুখীন হন। পরাবাস্তবতা, একাকীত্ব, অপরাধবোধ এবং এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস - এগুলোই ছিল কাফকার লেখার মূল উপজীব্য।
১৯২৪ সালের ৩রা জুন, মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে টিউবারকুলোসিস রোগে ভুগে ফ্রানজ্ কাফকার জীবনাবসান হয়। এখানে বলে রাখা দরকার, কাফকার ক্রনিক সেলফ-ডাউটের সমস্যা ছিল। যার জেরে, তিনি জীবৎকালেই তার অধিকাংশ রচনা নষ্ট করে ফেলেছিলেন। বাকি যে সামান্য অংশটুকু রক্ষা পায়, তার মধ্যেও আবার বেশ কিছু লেখা চিরতরে হারিয়ে গেছে। বস্তুত, এখনকার দিনে কাফকার যে লেখাগুলি সুপরিচিত, তার অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছিল তার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে - অল্প কয়েক বৎসরের ব্যবধানে। (যদিও কাফকা নিজে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন যে, - তার অসমাপ্ত ও অপ্রকাশিত রচনাগুলি যেন তার মৃত্যুর পর নষ্ট করে ফেলা হয়। কী ভাগ্যিস তা মানা হয় নি!) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তার লেখা বিশ্বজনীন পরিচিতি লাভ করে।
প্রসঙ্গত, কাফকা সাহিত্য রচনা করেছেন তার মাতৃভাষা জার্মানে, - আজকের বহুল প্রচলিত ইংরেজিতে নয়। যদিও পরে তার তামাম সাহিত্যকীর্তি বিশ্বের প্রধান সবকটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। কাফকার যেসমস্ত সাহিত্যকর্ম আজও তুমুল জনপ্রিয়, সেগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল - উপন্যাসিকা দ্য মেটামরফোসিস (১৯১৫) এবং তার অকালমৃত্যুর পর প্রকাশিত হওয়া দুটি উপন্যাস - দ্য ট্রায়াল (১৯২৫) এবং দ্য ক্যাসেল (১৯২৬)।
প্রসঙ্গত, এই উপন্যাস বা উপন্যাসিকাগুলির সাথে পরাবাস্তবতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আর তাই, কাফকাকে আধুনিক পরাবাস্তবতাবাদের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত করলেও তা অত্যুক্তি হবে না। তবে, উল্লিখিত উপন্যাসগুলির বাইরেও এমন বেশ কিছু রচনা রয়ে গেছে যা হয়তো বহুল পঠিত নয়। বিশেষত তার অণুগল্পগুলি - যা কিন্তু এখনো পাঠককে তার চিন্তার খোরাক জোগাবে। পুরোগামীর এই সংখ্যায় সঙ্কলিত হল এমনই তিনটি অণুগল্প।