যা ছিল সেদিন, আজ আর নেই

লিখেছেন:সুদীপ দাশ

 

 

জীবনের অর্ধেকের‌ও বেশি অতিবাহিত করার পর যখন একটু 'হিসাব কিতাব' করতে মন চায়, তখনই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আসে। এই পথ যদিও খুব একটা দীর্ঘ নয়, তবুও এই পথেই কত লোকজনকে হারালাম, যাদের স্মৃতি আজ‌ও সমুজ্বল। আবার এমন সব জিনিস, ঘটনা, অভিজ্ঞতা, -- যা যত‌ই আপাততুচ্ছ হোক না কেন, মনের চোরকুঠুরিতে পাকাপাকি ভাবে লুকিয়ে আছে, হারাবার নয়। হারাতে চায় না।

এই কলকাতার কথাই ধরি না কেন? সেই ১৬৯০ সনের আধুনিক কলকাতার পত্তনের থেকে তো প্রায় তিনশো তিরিশ বছর অতিক্রান্ত। এই এত বছরে কত নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সাক্ষী এই শহর। আমি অত দূরে যেতে চাই না, আমি শুধু গত পঞ্চাশ ষাট বছরে কি কি বদলে যেতে দেখলাম, হারিয়ে যেতে দেখলাম, -- সেদিকেই একটু নজর ফেরাই।

প্রথমেই আসি ডাবল ডেকার বা দোতলা বাসে। কী সুন্দর ছিল লালটুকটুকে সেই বাসগুলো, বেশ‌ ক্যালকাটা স্টেট ট্র্যান্সপোর্ট কর্পোরেশন-এর রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখ মার্কা দেওয়া। এই ডাবল ডেকার বাসগুলো ক্রমে সামনের দিকে একটু এক্সটেনশন হয়ে নতুন রূপ নিল কতকটা আড়াইতলা গোছের। সে তার বিশাল বপু নিয়ে যখন চলত গজগমনে তার সে কী আওয়াজ ,কী গর্জন! মনে আছে আমাদের পাড়া নেতাজিনগর থেকে আপিস টাইমে প্রতিদিন একটি বিশেষ সময়ে সেই বাস ছাড়ত, চলত ধর্মতলা, ডালহৌসী হয়ে হাওড়ার পথে। সেখানে প্রতিদিন আপিস যাত্রীদের চলমান মঞ্চের গান, আবৃত্তির আসর বসত, নতুন নতুন বেড়ানোর প্রোগ্রাম হোত, দানা বাঁধত নতুন নতুন প্রেমপর্ব। অনেকেই ওই বিশেষ বাসটিতে চলাচল পছন্দ করেতেন। পরে কবে যেন, ওই ভাবল ডেকার বাসগুলো লুপ্ত হয়ে গেল, বোধহয় নব্ব‌ইয়ের দশকে, থেমে গেল চলমান মঞ্চের গান।

এবার আসি আমাদের অতি প্রিয় ‌কলকাতার ট্রামে, সেই ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাসের গল্পে। আমার এক পরিচিত দাদার বাড়ি থেকে কঠিন নির্দেশ ছিল যেন‌ সে কখনো ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে‌ না চড়ে, কেননা ওই ক্লাসটি একটু নিম্ন শ্রেণীর লোকের চড়ার জন্য। কিন্তু ওই দাদা সেকেন্ড ক্লাসেই ট্রামযাত্রা করতে পছন্দ করতো, বলতো, -- 'আরে কটা পয়সা বাঁচে তো।' এবার আসি ট্রামের - সুন্দরী, বনানী এমন সব নামে। সুন্দরী ট্রামের ভিতরে বাইরে কী সুন্দর সাজানো থাকতো। মনে আছে আমার মামাতো‌ দাদার বন্ধু জব্বলপুরের লোক, কলকাতায় এসেই আমাকে ধরল ওকে যেন একবার ট্রামে চড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি ওকে টালিগঞ্জ থেকে ভবানীপুর হয়ে ধর্মতলা যাত্রা করিয়ে দিলাম। ট্রামের টুং টুং আওয়াজ আর ওই দাদার লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা -- আজও ভুলিনি। সেই সব বিশেষ বিশেষ ট্রামরূট আজ আর নেই। তখনো ট্রাম কোম্পানি বাসের ব্যবসায় আসেনি। আর আজ তো সেই ট্রামের গঙ্গা যাত্রা সুনিশ্চিত!

তখনো কলকাতার পিঠে সেই জুড়ে দেওয়া ডানা আমরা পাইনি, যার নাম হল পাতাল রেল বা মেট্রো। শহর জুড়ে চলছে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি, পাতাল প্রবেশের জন্য। ভবানীপুরের অত বড় মার্কেট যে তার বাজার হারালো এই কর্মযজ্ঞের জন্য, তার আজো পুনরুদ্ধার আর হল না। মনে আছে লিন্ডসে স্ট্রীট ধর্মতলা অঞ্চলে একটি মাটির পাহাড় বা টিলা, তাতে গাছগাছালি, তার পাশে লেবারদের থাকার কুঁড়েঘর, সব মিলিয়ে এক অভিনব গ্রাম্যস্মৃতি উস্কে দিয়েছিল সেই সময়। আসলে এই মাটি মেট্রো রেলের জন্য খোঁড়াখুড়ির ফলাফল। মেট্রো রেল চলাচলের সঙ্গেই সেই সব মাটির ঢিবির পল্লীসমাজ ধর্মতলার বুক থেকে উবে গেল। আরো মন পড়ে প্রথম যেদিন পাতাল রেল চালু হল, সেদিন ধর্মতলা এসে লাইন‌ দিলাম, অজগরের আকারের সে লাইন তখন‌ পাতাল থেকে উঠে মেট্রো সিনেমা হল ছাড়িয়েছে। প্রথম দিনের সেই দুরু দুরু বুক যাত্রা ছিল শুধুই --- 'ধর্মতলা সে ভবানীপুর তক্'! (তখনো মেট্রোস্টেশনগুলো মনীষী-নামা হয়নি)। সে এক আশ্চর্য অনুভুতি! এর আগে কেবল সীতার পাতাল প্রবেশের কাহিনীই জেনেছিলাম। সেই প্রবেশ কী এমনই ছিল? কে জানে?

ছোটবেলাতে পাড়ায় দেখতাম কোন এক কাকু সরকারি আমলা ছিলেন, তাঁর ঘরের দুয়ারে সকাল থেকে সাদা আ্যমবাস্যাডার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। সেই থেকেই স্বপ্ন দেখতাম বড়ো হয়ে আমিও চাকরি করব, আমার জন্য‌ও একদিন ওরকম সাদা আ্যমবাস্যাডার অপেক্ষা করবে। ধর্মতলার ইন্ডিয়া অটোমোবাইলস্ এর শোরুমের ডিসপ্লেতে রাখা সাদা আ্যমবাস্যাডার দেখে কতদিন বিভোর হয়েছি, মনে হয়েছে 'ড্রীম কা--র'। কিন্তু বাস্তবে যেদিন সেই স্বপ্ন সত্যি হল, তখন এই রাজ্য থেকে সেই সাদা আ্যমবাস্যাডার লুপ্তপ্রায়। ইন্ডিয়ান অটোমোবাইলস্ কবেই ঝাঁপ তুলে দিয়েছে। সরকারি আপিসেও দিনে দিনে আধুনিক সুইফট্ ডিজায়ার  বা অন্যান্য এস ইউ ভি গাড়ির থাবা। অবশিষ্ট পুরোনো দু এক পিস্ গাড়ি আজ ধুঁকছে, বিদায়ের পথে।

বাড়ির আলমারিতে আজ ধুলোমলিন যে ক্যামেরাগুলো পড়ে রয়েছে সেগুলোর এক একটি যেন এক এক ইতিহাসের গল্প বলে। সেই আগফা ক্লিক থ্রি, স্ন্যাপার ক্যামেরা দুটো কত যে ঘটনার সাক্ষী। একবার ফিল্ম ভরার বিভ্রাটে মামাতো ভাইদের উপনয়নের অনুষ্ঠানের ছবি সব ভন্ডুল হ‌ওয়ায় আবার নতুন করে ফিল্ম ভরে সেই অনুষ্ঠানের পুনরাভিনয় করে ছবি তুলতে হয়েছিল। সেই ছবিগুলো আজ‌ও রয়েছে। মনে আছে একবার বেড়াতে গেলাম গঙ্গাসাগরে, --সাগরমেলায়। অনেক মাহেন্দ্রক্ষণের ছবিও তুলেছিলাম। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখি আমার আগফা ক্যামেরা বিগড়েছে, তাই কোন ছবিই ওঠেনি। কিন্তু সেইবার আর নতুন অভিনয়ের সুযোগ ছিল না। বাবার শখ ছিল ইয়াশিকা ক্যামেরার। সে যুগে জাপানি ক্যামেরা কেনার হ্যাপাও ছিল অনেক। লুকিয়ে চুরিয়ে কোথা থেকে যেন আনা হয়েছিল। নতুন ইয়াশিকা ক্যামেরায় দারুন সব ছবি উঠেছিল। আমাদের এক তুতো দাদা উত্তর বঙ্গের জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার জন্য ছবি তুলতে ক্যামেরাটি চেয়ে নিয়েছিল। তারপর কী যে হল, ক্যামেরা আর ফেরত এল না। কোথায় নাকি হারিয়ে গেছিল। সেযুগে ছবি তুলতে ছিল শত হ্যাপা, ফিল্ম ভরো, ছবি তোল ৩৬ টা, ওয়াশ করো, তারপর তাদের প্রিন্ট করো, আ্যলবামে তাদের সংরক্ষণ করো। আজ ডিজিটাল ক্যামেরার জমানায় এই সব ফিল্ম জড়ানো যন্ত্রগুলো আজো অনেক গল্প শোনায়।

মায়ের ছিল একটি সিঙ্গার হাত সেলাই মেশিন। আমাদের বাড়ির যাবতীয় পর্দা, বাবার লুঙ্গি, ছোটখাটো সেলাইয়ের কাজ চলত মায়ের হাতে। মা গত হ‌ওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই সেই মেশিনের জায়গা হয়েছিল খাটের তলার কোন আঁধারে। মায়ের হাতের উলের কাঁটা, কুরুশ গুলো আমি আজো রেখে দিয়েছি যত্ন করে। পুরোনো সোয়েটার, পুল‌ওভার গুলো যেন কতনা গল্প শুনিয়ে রায়। ওগুলো যদিও আজকের দিনে ফ্যাশনদুরস্ত নয়, তবুও ওই ওগুলোতে জড়িয়ে আছে মায়ের স্নেহের ওম্।

আমাদের ভাড়াবাড়ির উল্টোদিকে ছিল একটি খুব‌ই পুরোনো ছাপাখানা, নাম তার সর্বজয়া প্রেস। ছোটবেলা থেকে দেখতাম ওই প্রেসে কত না বিল ব‌ই, সুভেনিয়ার, ব‌ই, ম্যাগাজিন ছাপা চলত লাইনোটাইপ ঘটাং ঘট্ শব্দ করা মেশিনে। একজন বুড়ো ভদ্রলোক কুঁজো হয়ে দিনের পর দিন ওই প্রেসে সিসের হরফ সাজিয়ে সাজিয়ে ছাপার ফর্মা তৈরি করতেন। দেখে অবাক হতাম কি করে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে এক সুবিশাল ব‌ইয়ের আকার পায়। মনে আছে ওই মেশিনেই বাবার লেখা উপন্যাস ছাপানো হয়েছিল, যদিও তা কোনদিন বাজারে কাটে নি, -- পোকায়‌ই কেটেছে বেশি। সেই ঘটাং ঘট্ মেশিন এবং সেই বুড়ো ভদ্রলোক দুজনেই সময়ের সাথে সাথে আজ বাতিলের দলে।

এবার আসি মজার সব খাওয়া দাওয়ায়। ইস্কুলের বাইরের সেইসব হজমিওলা, আমড়াওলারা কি কোথাও হারালো? মনে আছে জব্বলপুরে মামাবাড়ি গিয়ে প্রতি বছর খুঁজে বেড়াতাম সেই চুরণ‌ওলাকে যে প্রতি সন্ধ্যায় গরম ধোঁয়া ওঠা চুরণ বিক্রি করত। এখন সেই হজমিওলা, চুরণ‌ওলারা হারিয়েছে, বেঁচে আছে শুধুই তাদের সুখস্মৃতি। 

মনে পড়ে যায় সেই এস বিস্কুট, পটল বিস্কুট, প্রজাপতি বিস্কুটের কথা। অনিন্দ্যবাবুকে ধন্যবাদ, ওঁর 'প্রজাপতি বিস্কুট' সিনেমার মাধ্যমে বাজারে সেই ব্র্যান্ডটির প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। সেই ছিল হালকা গোলাপি রঙা বুড়ির মাথার পাকা চুল বা ক্যান্ডি। এক অদ্ভুত দর্শন মেশিনে ছোট ছোট গোলাপি দানা ফেলে তা তৈরি হত। নিমেষেই ওই দানা থেকে যে কিভাবে অমন‌ একমাথা পাকা চুলের মতো ক্যান্ডি তৈরি হত তা আজো আমার কাছে মিস্ট্রি!! আজ প্যাকেটে করে ক্যান্ডি বিকোয়, কিন্তু তার তৈরি হ‌ওয়ার সেই যে ম্যাজিক, তা আজ কোথায়?

আজ যে লেয়স্, বিঙ্গো ইত্যাদি পোট্যাটো চিপস্ এ বাজার ভরে রয়েছে তার উৎস ছিল কিন্তু 'ফান মানচ্' বলে একটি ব্র্যান্ডে, যা আজ হারিয়েছে। কেক পেস্ট্রির জগতে জলযোগ ছিল কলকাতায় পথিকৃৎ। মনে আছে লেক মার্কেট অঞ্চলে কোন কাজে গেলে মা ঠিক জলযোগের দোকান থেকে পেস্ট্রি কিনে আনত। ওই দোকানে চন্ডী লাহিড়ীর আঁকা কত কার্টুন ঝোলানো থাকত কেক পেস্ট্রি খাওয়া নিয়ে। পরে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে জলযোগের কেকের দোকান, যা আজ অবলুপ্ত।

তালগুড় মহাসঙ্ঘ নামে একটি সংস্থা ছিল যারা গুড়ের কত স্টল থেকে রকমারি খাবার বিক্রি করত, আজ তা বিলুপ্ত। ওখানকার একটি পানীয়ের নাম ছিল ' নীরা '। বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো -- নীরা পান করুন।

তখনকার দিনে সারারাত ব্যাপী জলসা হত, নাম তার 'বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান'। মনে আছে রাত নটায় পিন্টু ভট্টাচার্য্য গাইবেন 'আমি চলতে চলতে থেমে গেছি' আর বনশ্রী সেনগুপ্ত রাত বারোটায় ধরলেন – 'আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম'। মাঝ রাতে উৎপল দত্ত 'জেলখানার চিঠি'র আবৃত্তি করলেন। এরপর এলেন মান্না দে, ধরলেন – 'যখন কেউ আমাকে পাগল বলে' আর 'কাহারবা নয় দাদরা বাজাও'; এর সঙ্গে রাধাকান্ত নন্দীর তবলা, আহা সে কী কোনদিন ভোলা যাবে! একেবারে হাড় কাঁপানো শীতের শেষ রাতে এলেন ভূপেন হাজারিকা। আমরা তো তখন শীতে কাঁপছি। সেদিন এতটাই 'জলপথে' ছিলেন যে তার 'আমি এক যাযাবর' গানে কিছুতেই সুর লাগছিল না, এদিকে পাবলিক তো অধৈর্য্য। যাই হোক, কোন মতে কয়েকটি গান গেয়ে শেষ করলেন। শেষ রাতে বাড়ি ফেরা। মনে আছে যে কুকুরের তাড়া খেতে হয়েছিল বাড়ি ফেরার সময়। আজ এই স্মৃতি গল্পগাছা মনে হয়।

এরপর এক পাহাড়প্রমাণ অবলুপ্তির কথা জানাই। সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলগুলি আজ আর নেই বললেই চলে। এক একটি সিনেমা হলকে নিয়ে কত না স্মৃতি -- সেগুলো কোনোটা আজ শপিং মল আবার কোনোটি হাউসিং আবার কোনোটা পোড়ো অবস্থায় ধ্বংসের দিন গুনছে। মনে আছে উজ্জ্বলা হলে (এখন একটি মল) দেখেছিলাম দেবদাস সিনেমার প্রেস শো, – যেখানে উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, সুমিত্রা মুখার্জি এসেছিলেন। সেযুগে ভবানীপুর অঞ্চলের চার পাঁচটি হলে একসাথে উত্তমকুমারের বিভিন্ন ব‌ই চলত। সে এক স্বর্ণযুগ। একটি মজার স্মৃতি বলি, আমার বাবা ছিলেন রাশভারি মাস্টারমশাই। কোনদিন সিনেমা দেখতে হলে যেতে দেখিনি। আমার বাড়ির পুবদিকে ছিল আধা কিমি দূরত্বে মধুবন হল আর পশ্চিম দিকে পাঁচশো গজের মধ্যেই মালঞ্চ হল। একবার সবাই মিলে মধুবনে 'এ্যন্টনী ফিরিঙ্গি' সিনেমা দেখবেন বলে মা কিভাবে যেন বাবাকে রাজি করিয়েছেন। রাত আটটার নাইট শো। বাবা সিনেমা দেখতে যাবে, আমরা তো খুবই উৎফুল্ল। আমি আর মা যথাসময়ে পৌঁছে গেছি হলে। আটটা বেজে গেল, বাবার তো দেখা নেই। সেযুগে মোবাইলও ছিল না যে খবর নেওয়া যাবে। সব লোক হলে তখন ঢুকে পড়েছে। বাবা দেখি সোয়া আটটা নাগাদ একটি রিকশা থেকে ধীরে ধীরে নামছেন। যা বুঝলাম তা হল বাবার কোন হলে সিনেমাটা চলছে, তা মনে না থাকায় তিনি চলে গিয়েছিলেন উল্টোপথের মালঞ্চ হলে। তাই রিকশায় উল্টোদিকে আসতে একটু দেরি হল। যাই হোক একটু পরে হলেও লোকের গাল শুনতে শুনতে অন্ধকার হলে নিজেদের আসন খুঁজে বসতে হয়েছিল সেদিন। সেই সিঙ্গল স্ক্রীন জমানা বুঝি আজ শেষ হয়েছে, হল দুটি আজ ভূতের বাড়ি।

সেকালে পুজোর গানের আলাদা আকর্ষণ থাকত। শিল্পীরা পুজোয় দুটো চারটে করে নতুন গানের রেকর্ড করতেন। সেইসব পুজোর নতুন গানের কথা সাজিয়ে এইচ এম ভি থেকে একটি রঙিন ব‌ই বের করত, -- নাম তার 'শারদ অর্ঘ্য'। আমরা প্রতি পুজোয় এই ব‌ইটি কিনতাম। শিল্পীর ছবি দেওয়া সেই ব‌ইয়ে গানের কথা গুলো লেখা থাকত। তখন তো ডিস্ক বা কালো এল পি, ই পি, এস পি রেকর্ডের যুগ। কলের গানের শেষে শুরু হয়েছে স্টিরিও, সাউন্ড সিস্টেম, ফিয়েস্টা ইত্যাদি মিউজিক সিস্টেম। সোনোডাইন কোম্পানির সাউন্ড সিস্টেমের কী গমগমে আওয়াজ! আমাদের যখন একটু সামর্থ্য হল তখন  বাড়িতে এল ফিলিপসের ফিয়েস্টা সিস্টেম। তার সঙ্গে মায়ের প্রিয় কত রেকর্ড। রবীন্দ্র সংগীতের সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখার্জী, দেবব্রত বিশ্বাস, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, গীতিনাট্য - তাসের দেশ, চিত্রাঙ্গদা ,শ্যামা ইত্যাদি, আবার শচীন দেব বর্মন, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অনুপ ঘোষাল, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, ফিরোজা বেগম – কার রেকর্ড নেই সেখানে? আর কী সুন্দর সুন্দর তাদের অলংকরণ, তাদের কভার। আমাদের ভাড়াবাড়ির প্রতিবেশী মিন্টুদারা আমাদের এই সাউন্ড সিস্টেমটি মাঝে মাঝে দিন পনেরোর জন্য চেয়ে নিয়ে যেত। এই কদিন চুটিয়ে ওরা ওদের বাড়িতে গান শুনত, – আমরা দূর থেকে সেই গান শুনতে পেতাম। এমন‌ই ছিল তখনকার দিনকাল।

আমরা যখন মামাবাড়ি জব্বলপুরে যেতাম তখন ওখানে এক দিন সবাই মিলে আনন্দ করে রেকর্ডের গান শোনা হত। ওদেশে গোরান্দি বাজারের কাছে অনেক বিরল হিন্দি গানের পুরোনো রেকর্ড পাওয়া যেত। মনে আছে লতা মঙ্গেশকরের লন্ডনের রয়াল অ্যলবার্ট হলে লাইভ গানের রেকর্ড ওখানেই প্রথম শুনি, কি অপূর্ব!! আমার মনে আছে জব্বলপুরে মামিমারা আমার কাছে 'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা', 'সাধের লাউ', 'দাদা পায়ে পড়ি রে', 'হায়,হায় সাতপাকে বাঁধা পড়ো না' – এই সব তখনকার হিট বাংলা গান শুনতে চাইত।

আমাদের এক প্রতিবেশী দাদু দিদা ভাড়াবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আমাকে তাদের ৭৮ আর পি এম কালো একগোছা রেকর্ড দিয়ে গেলেন, যা আজ‌ও আগলে রেখেছি। সেখানে যেমন আঙুর বালা, ইন্দুবালার গান রয়েছে তেমনই রয়েছে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন 'প্রভাস-মিলন' আবার কিশোর কুমার এর 'শিং নেই তবু নাম তার সিংহ' আরো কত কী? আমাদের এই পাড়ার ঘোষালকাকুদের রেকর্ড গুলো ধুলো জমছিল। আমাকে দিয়ে গেলেন নাজিয়া হাসানের 'ডিস্কো দিওয়ানে' – যা সে যুগের ডিস্কো সেনসেশন।

আমাদের পাড়ায় দুই কিশোর কুমারের ভক্ত তাদের মধ্যে সবসময় প্রতিযোগিতা করত, কার কত কিশোরের দুষ্প্রাপ্য ডিস্ক আছে। ওরা ধর্মতলা স্ট্রীটের পুরোনো রেকর্ডের দোকান থেকে কত যে বিরল রেকর্ড কিনত তার ইয়ত্তা নেই। এমনকি অনেক রেকর্ডের এক্সচেঞ্জ হত অনেকের মধ্যে দেখেছি। কিশোরকুমার মারা যাবার পর ওদের দেখেছি কিশোর কুমারের ছবিতে মালা দিয়ে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে তারপর গুরুর রেকর্ড বাজিয়ে গান শুনত। কালের ডাকে এক কিশোর কুমার ভক্তকেও এই সেদিন চলে যেতে হলো।

আমার শ্বশুর বাড়িতে আজ‌ও শ্বশুরমশাইয়ের সংগৃহীত অসংখ্য সেযুগের রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ড অতি যত্নে বাক্সে বাক্সে থরে থরে সাজানো রয়েছে, যদিও শ্বশুর মশাইও আজ নেই আর না আছে সেই রেকর্ড বাজানোর যন্ত্র।

এমন‌ই সব দিনে রাসবিহারী মোড়ের, গোলপার্কের মেলোডি রেকর্ডের দোকান কেমন গমগমিয়ে চলত। স্কুল ফেরত কোন বিকেলে ওই মেলোডির বাইরের কাঁচের শো-কেসে হাঁ করে তাকিয়ে খুঁজতাম নতুন কী সব ডিস্ক বেরোল। পরে ক্যাসেটের, সিডির যুগেও এইভাবে কত গানের হদিশ করেছি ঘুরে ঘুরে। আরো পরে পার্ক স্ট্রীটের মিউজিক ওয়ার্ল্ডও নিয়ে এল গানের সম্ভার যা কত আধুনিক ভাবে সাজানো। তারপর গানের জগৎটাই কেমন পাল্টে গেল। মেলোডির দোকান বোধহয় ধুঁকছে আজ‌ (আছে কী? কে জানে?) মিউজিক ওয়ার্ল্ডও উঠে গেছে।

একবার দুর্গাপূজায় কসবার একটি নামকরা বারোয়ারি পুরোনো কয়েক হাজার রেকর্ড দিয়ে বাঁকিয়ে চুরিয়ে থিমের পুজোর প্যান্ডেল সাজিয়েছিল। সেই থিম পুজোয় অসংখ্য কালো ডিস্কের ওই সর্বনাশ দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম সেবার। কোন উর্বর মস্তিষ্ক এই ধ্বংসের বুদ্ধি দেয় কে জানে?

আমি তাই পুরোনো রেকর্ড প্লেয়ার, ক্যাসেট প্লেয়ার, সিডি প্লেয়ারগুলোকে মাঝে মাঝে ধুলো ঝেড়ে বার করি শুধু একবার অতীতের হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর একটু ওম, একটু উত্তাপ পাওয়ার জন্য, তাঁদের গুনগুন করে গেয়ে যাওয়া সুরের অনুরণনের জন্য।

অসীম কালসাগরে ভেসে ভেসে কত যে পাথর, নুড়িতে ঠোক্কর খেয়েছি, – কত যে শৈবালদাম, শ্যাওলা, মস জন্মেছিল সেই জলতরঙ্গে, – তার হিসেব কে রেখেছে? আজ জীবনের এক উপান্তে এসে এই আশায় বুক বেঁধে র‌ই, – 'তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় নাকো কভু।' 

 

 

0 Comments
Leave a reply