“ওরে ও রিনি মা, কেদারনাথ দর্শনে গিয়েছিলাম, তোর জন্য কতকগুলো এই কাঁচের চুড়ি এনেছি, নিয়ে যা না মা… পরবি তো? পছন্দ হয়েছে?” বুড়ি দিদা কেদারনাথ এর উদ্দেশ্যে দুই হাত জড়ো করে ওপরে তোলেন।
“খুব পছন্দ হয়েছে দিদা।”
ঝাঁকড়া চুল বাতাসে ওড়ে। এলোমেলো হয়ে মুখেচোখে এসে লাগে। হাঁটুর ওপরে একটা লাল রঙের ফ্রক আর পায়ে একটা হাওয়াই চটি, রিনি ছুটে যায় ওই পাশের বাড়িতে। মা চেঁচিয়ে উঠে বলেন, “ওরে ও রিনি, আস্তে যা, ছুটিস না, পড়ে যাবি। ভিজে মাটিতে অনেক শ্যাওলা জমেছে, ওরা পরিষ্কার করে নি…” ও পাশের বাড়িতে মোটাসোটা গোলগাল কোমর ভেঙ্গে যাওয়া এক বুড়ি দিদিমা রিনিকে এক গোছা রঙবেরঙের কাঁচের চুড়ি উপহার দেন।
পাশাপাশি দুই বাড়ি। এ পাশের বাড়িটা হলুদ রঙের দোতলা, ও পাশের বাড়িটা একতলা। ওই বাড়ির মাঝখানে শ্যাওলা মাখা উঠোন, কলতলা। আর কলতলায় গোছা খানেক রঙ ওঠা প্রায় সাদা হয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের বালতি। সকাল বেলা কে আগে বালতিতে জল ভরবে তাই নিয়ে নিত্য ঝগড়া, বিবাদ কলহ। পাড়া, প্রতিবেশী অতিষ্ঠ হয়ে যায় এদের বাড়ির ঝগড়ায়। ওই বাড়িতে গরু, গোয়ালও আছে। চারিদিকে নোংরা ছড়ানো। বৃষ্টি পড়লে বৃষ্টির জল গোবরে মিশে বিশ্রী দুর্গন্ধ বেরোয়।
যে বুড়ি দিদিমার কথা বললাম তিনিও যে খুব ভালো মহিলা তাও কেউ বলে না। শোনা যায় যৌবন কালে তিনি অনেক পুরুষের সাথেই সহবাস করেছেন। পাড়ায় অনেকেই বলে “খানকি মাগি, বুড়ো বয়সে ভদ্রলোক হয়েছে।” কেউ কেউ বলে বরটাই ছিল আসল বদমাশ, বৌকে দিয়ে সারা জীবন দেহ ব্যবসা করিয়েছে। রিনি “খানকি” মানে জানে না। এই সব কথার মানে ঠিক উপলব্ধি করতেও পারে না সে। রিনি শুধু বুঝতে পারে বুড়ি দিদা তাকে খুব ভালোবাসে। রিনির মা রিনির সামনে কেউ এই কথা বললে রিনি কে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেন।
পাশের হলুদ বাড়িটি যেটি রিনিদের, সেটা পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সাজানো, গোছানো। নীচে একটা রুম একেবারেই অন্যরকম পরিবেশ। রিনির বাবা পেশায় ডাক্তার, বাড়িতে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ভিড় সবসময়। তবুও দুই বাড়ির মধ্যে একটা যোগাযোগ কি রকম ভাবে যেন গড়ে ওঠে। যাতায়াত লেগেই থাকে। দুই বাড়ির মাঝখানে একটা দরজা, যেটাকে সবাই জানতো বাগানের দরজা বলে, দরজার ওপর দিকে এ বাড়ির আম গাছ আর ও বাড়ির পেয়ারা গাছ শাখা প্রশাখায় পুরো নিবিষ্ট ভাবে পরস্পর কে বেঁধে রাখে ঠিক দুটো বাড়ির মত।
এখনো মনে আছে রিনির যে দুই বাড়ির মধ্যে খাবার দেওয়া নেওয়ার চল ছিল। কোনো বার ও বাড়ি থেকে এলো মোচার ঘন্ট বা এ বাড়ি থেকে গেলো নলেন গুড় এর পায়েস। এখনো মনে আছে মায়ের হাতের সেই পায়েস কী অপূর্ব স্বাদ ছিল। রিনির মনে হত গোটা হাঁড়ির পায়েস সে একাই খেতে পারবে। আবার কোনো কারণে দুই বাড়ির মধ্যে কোনো কারণে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেত। রিনির কারণ জানা ছিল না, কেন ঝগড়া হত? কিন্তু কয়েক দিন, তারপর আবার সেই ভাব ভালোবাসা, যাতায়াত, খাবার দেওয়া নেওয়া, গল্প-গুজব।
দুই
প্রায় বাইশ বছর পরে আজ একটি দিন। আজ দুদিন ধরে ভীষণ বৃষ্টি পড়ছে। এপ্রিল মাস হয়ে গেলেও ঠান্ডা যায় নি। পিটসবার্গ শহরের একটা বনেদি জায়গায় দুতল বাড়ির মালকিন রিনি আর তার হাজব্যান্ড। দুজনেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতেতে কর্মরত। জীবন যেদিকে বয়ে নিয়ে যায়। ছোটবেলার জীবনের সাথে রিনিতার এখানকার জীবনের কোনো মিলই নেই। আজ বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে কোনো দুর্গন্ধও এসে নাকে লাগে না। সেই ছোটবেলার রিনিতা ওরফে রিনি অনেকটাই বদ্লে গেছে। ঘরে বাইরে একাধারে এক সঙ্গে প্রচুর কাজ সামলাতে সামলাতে সে এখন একজন অভিজ্ঞ গিন্নি। তবু ছোটবেলার কথা যখন তার স্মৃতিতে আসে তখন সেই কথা ভাবতে তার বেশ লাগে। এই শহরটার ডাউনটাউন কিন্তু খুবই ঘিঞ্জি। যেমনটি তার ছোটো বেলার শহরেও ছিল। এখানে তলের উপর তল, বহুতল… বাড়ির পরে বাড়ি, এখানে দুচোখ যেদিকে যায় সেই দিকেই বহুতল। ছোটবেলার বহুতল ছিল দোতলা কি তিনতলা, আর এখানে বিশ তল বা আরো বেশি। আরিগ্যামি নদীর চারপাশ ধরে এখানে গড়ে উঠেছে সভ্যতা। বহুতল বাড়ি, ব্রীজ। এখানটায় আসলে রিনিতা কোথাও একটা মিল খুঁজে পায় হাওড়া ব্রীজ আর গঙ্গা নদীর সাথে। নদীর জলের রঙটাও এখানে গঙ্গার জলের মত ঘোলাটে। সন্ধ্যায় তার পাড়ে এসে বসতে খুব ভালো লাগে। সুন্দর খানিকটা বাগান নদীর পাড়ে। বসার নানা জায়গা। এখানে বসে শহর দেখতে বেশ লাগে। রাতের আলোয় ঝিকিমিকি করে বহুতল সব বাড়ি। তার প্রতিচ্ছবি এসে পড়ে নদীর বক্ষদেশে। নদীর জলও ঝিলমিল করে ওঠে। কোনো কারণ নেই, কিন্তু অচেনা কোনো একটা ব্যথায় মনটা কেমন জানি হু হু করে ওঠে রিনিতার।
সকাল নটা বাজলেও ছুটির দিন বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না রিনিতার। তবে আজ সকাল নটা থেকে এখানের বাঙালিরা নববর্ষের আয়োজন করেছে। দেশে অবশ্য নববর্ষ দুদিন আগেই হয়ে গেছে, এখানে তো নববর্ষের ছুটি নেই, তাই এখানে সপ্তাহ শেষই ভরসা। নববর্ষ যেখানে হচ্ছে সেখানে যেতে গেলে গাড়িতে প্রায় আধ ঘন্টা। আজ তো শাড়ী পড়তেই হবে। তড়িঘড়ি করে একটা শাড়ী বের করলো রিনিতা। শাড়ীটা পিওর সিল্ক-এর। লাল রঙের শাড়ীতে নীল রঙের আভা, আঁচলে সূর্য, ধানক্ষেত আর নীল রঙের আকাশ। আঁচলটা পিছন দিকের থেকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে আনতে মনে হয় যেন ভোরের নতুন সূর্য আভা দিচ্ছে নীল আকাশের গায়ে। নববর্ষের নতুন আলো। ইদানিং ড্রেসিং টেবিল এর সামনে বসে বাঙালি স্টাইল এ সাজা হয়ে ওঠে না রিনিতার। এই শাড়ীটার সাথে মিলিয়ে গয়না পড়তে গিয়ে ড্রয়ার খুঁজে উঠে এলো সেই ছোট বেলায় পাওয়া চুড়ি। বুড়ি দিদা মারা গেছে অনেক বছর হয়ে গেল। চুড়িগুলো হাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে হাতে পরে ফেলে রিনিতা। এই ধরণের কাজ এখনকার দিনে বেশি দেখা যায় না। এত দিন পরেও তার রঙ নষ্ট হয় নি। সত্যিই শাড়ীটা র সাথে মানিয়েছে বেশ। ছোট বেলায় চুড়ি গুলো হাতে বড় হয়েছিলো, এখন একদম ঠিক। কোনো কারণ নেই, বুকের ভিতর থেকে একটু মুচড়ে উঠলো রিনিতার, একটা ব্যথা চিড়িক দিয়ে উঠল, চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো একটু জল।
মানুষ আর সময় - - কোথায় চলে যায় কে জানে? সময়ের টান বড় টান। কোথায় যে হু হু করে এগিয়ে যায় কে জানে? পিছনের দিকে একবার ফিরেও তাকায় না। পিছন টান বলে যদি কিছু থেকেও যায় সে কথা কি সময় বোঝে? মানুষ চলে যায়। কত দূরে কেউ জানে না, শুধু তার পার্থিব জিনিস গুলো খানিকটা হেলা ফেলা ভাবেই বা খানিকটা স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
আর জীবন চলতেই থাকে বহমান নদীর মত বিরামহীন স্রোতে।
28 April, 2025
দারুন হয়েছে লেখাটি। সুদূর আমেরিকায় বসে এরকম একটি স্মৃতিমেদুর লেখনী এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। এভাবেই কলম চালিয়ে যাবেন এবং ভালো থাকবেন।