নারীর মুখাবয়ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কাদম্বরী দেবীর প্রতিকৃতি?) (ছবি- উইকিপিডিয়া)
তারা দুজন রবীন্দ্র জীবনের দুই প্রধান নারী চরিত্র। তারা দুজনেই তাদের ব্যক্তিত্বে, স্পর্শে তাকে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, যদিও নিজেরা রয়ে গেছেন আড়ালে। কেমন হত যদি তারা মুখোমুখি হতেন? প্রসঙ্গত, নীচের এই কথোপকথন সম্পূর্ণই কাল্পনিক। শুধুমাত্র তাদেরকে কেন্দ্র করে বা বলা উচিত তাদের চোখ দিয়ে সেই সময়কে স্পর্শ করার দুঃসাহস মাত্র।
কাদম্বরী - মৃণালিনী মুখোমুখি পর পারে।
মৃণালিনী : মাতু দি
কাদম্বরী : কে??? তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না ভাই ।
মৃণালিনী : আমি মৃণালিনী।
কাদম্বরী : কে মৃণালিনী?
মৃণালিনী : তোমার রবির স্ত্রী মৃণালিনী।
কাদম্বরী : মৃমৃমৃণালিনী...রবির মৃণালিনী। আর কী বললে, 'আমার রবি'??? সে তো তোমারই ভাই।
মৃণালিনী : আমি কি কখনো তোমার 'রবি'-র হয়ে উঠতে পেরেছিলাম… কী জানি!!!
কাদম্বরী : বোধহয় একটু ভুল বললে। তুমি হয়তো তাঁর হয়ে উঠেছিলে ঠিকই কিন্তু সেই হয়তো তোমার একার রবি হয়ে উঠতে পারেনি। রবি যে কখনো কারুর একার হয়না। সে তো সমগ্র বিশ্বের। তা ভাই আমায় 'মাতু দি' বলে সম্বোধন করলে যে? আমি তো কাদম্বরী।
মৃণালিনী: তুমি তো মাতুই। কাদম্বরী তো খোলোস মাত্র। তাই নয় কি!!
কাদম্বরী : কত যুগ বাদে কেউ মাতু বলে ডাকলো। বাবা নাম দিয়ে ছিলেন মাতঙ্গিনী। মা ডাকতো 'মাতু' বলে। (দীর্ঘশ্বাস) … তুমি ঠিকই বলেছো। ঠাকুর বাড়ির শক্ত ভিতের আড়ালে ওই ছোট্টো দামাল মেয়েটি কোথায় জানি হারিয়ে গেলো। আচ্ছা... তুমিও তো ভবতারিনী কিন্তু আমি তোমায় মৃণালিনী বলেই ডাকব। এ যে আমার রবির দেওয়া নাম। 'আমার রবি' বললাম বলে তুমি রাগ করো না আবার।
মৃণালিনী : না গো মাতু দিদি। এই যে বললে, রবি কখনো কারুর একার হয়না। সে তো সমগ্র বিশ্বের।
আচ্ছা মাতু দিদি, তুমি আর তোমার দেওর ছোট্টো বেলা এক সাথে খুব মজা করেছো না !! তুমি নাকি ও রাগ করলে ওকে খাইয়েও দিতে।
কাদম্বরী : (হেসে)....রবি বলেছে বুঝি! হ্যাঁ, এই বাড়িতে যখন আমি আসলাম, ওই নয় বছর বয়সে, আমার শিশু মন তখন ভিটে ছাড়া। ঠাকুর বাড়ির কড়িবরগার ছাদ সবই তখন সেই ছোট্টো মাতঙ্গিনীর কাছে ভীষণ উঁচু ঠেকে। সেই উচ্চতার নাগাল সেই ছোট্টো মেয়েটি পেত না তখন। পরে অবশ্য উপলব্ধি করেছি যে সেই উচ্চতার নাগাল কোনো দিনও সে পায়নি। যাক সে সব কথা। সেই সময় আমার ছোটো হাতটি ঠাঁই পায় আর দুটি ছোটো হাতে। রবির দুটি হাতে। রবি তখন সাত আর আমি নয়। রবির যখন চোদ্দ বছর বয়স তখন রবির মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ি গত হন। রবি তখন মাতৃহারা। সেই প্রথম মৃত্যু তাঁর জীবনে। কখনো মাতৃত্বের উষ্ণতার টানে আবার কখনো প্রগাড় বন্ধুত্বের টানে, সুখে দুঃখে আমরা জড়িয়ে ধরেছি একে ওপরের হাত। আর আমার নিঃসঙ্গ, একাকী জীবনে রবিই তো ছিল আমার এক মাত্র সহমর্মী, আমার বন্ধু। ঠাকুর বাড়ি কখনই খোলা মনে আমায় গ্রহণ করেনি। আমাদের ভিন্ন সামাজিক অবস্থানের কারণে ঠাকুর বাড়ি আমায় শুধু তাচ্ছিল্যই দিয়েছে। এক মাত্র রবির বন্ধুত্বের কারণেই ঠাকুর বাড়ির এই কাঠিন্য আমায় ভাঙতে পারেনি।
জানো মৃণালিনী আমরা কত দুপুর কাটিয়েছি কখনো রবির নতুন কোনো গানে সুর করে বা ওর নতুন কোনো লেখার আলোচনা করে।
মৃণালিনী : ওর সব লেখার প্রথম পাঠিকা এবং সমালোচক তো তুমিই ছিলে। তাই না! আমি জানি মাতু দিদি, তুমি ওর জীবনে কী ছিলে। তুমি যাওয়ার পরও তাঁর কতো গানে, কতো উপন্যাসে তোমায় খুঁজে পেয়েছি আমি। তুমি পুরোনো হয়েও ওঁর জীবনে নতুনই থেকে গেলে চিরকাল, আর আমি নতুন হয়েও পুরোনো।
আসলে তুমি আর আমি সারাটা জীবন দুটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তে দৌড়ে বেরিয়েছি। আমাদের কেন্দ্র একই। কিন্তু আমরা কেউ সেই কেন্দ্রকে ছুঁতে পারিনি ।
কাদম্বরী : (দীর্ঘশ্বাস) তোমার আর আমার কী তুলনা হয়? তুমি হলে রবির স্ত্রী। নতুনে যেরকম আবেগ থাকে পুরোনোতে থাকে অভ্যেসের যত্ন। তুমি ঠাকুর বাড়ির ছোটো বউ। কতো আদর করে, যত্ন করে রবি তোমাকে নিজের মনের মতন করে তৈরী করার চেষ্টা করেছে ।
আর আমি হলাম গিয়ে ঠাকুর বাড়ির বাজার সরকার শ্যাম গাঙ্গুলীর কন্যা। রূপে, গুণে, শিক্ষায় বা ব্যক্তিত্বে, কোনো ভাবেই কী তোমার ভাশুর ঠাকুর শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সমতুল্য ছিলাম আমি? তার ওপর নিঃসন্তান ।
মৃণালিনী : তা ঠিকই বলেছ, অনেক যত্ন করে সে আমায় নিজের মনের মতন করে তৈরী করার চেষ্টা করেছে ।
এক বছর লরেটো হাউসে ইংরেজি অধ্যায়ন করার পর তোমার রবিই তো আমাকে সংস্কৃত শেখানোর জন্য পণ্ডিত হেরম্বচন্দ্র বিদ্যারত্নকে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করে ছিল।
ভাশুর ঠাকুরও তো তোমায় নিজের মতন করে গড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তোমার পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন।
আসলে মাতুদিদি ঠাকুর বাড়ি আমাদের আচারে, ব্যবহারে, শিক্ষায় নিজের মতন করে গড়ে নিতে চেয়েছিলো। এই গড়ে নেওয়ার খেলায় এরা ভুলেই গেছিলেন যে আমাদের নিজস্ব একটি সত্তা আছে।
কাদম্বরী : তা হয়তো ঠিকই বলেছো । কিন্তু কী জানো তো, আমরা নিজেরাও হয়তো আমাদের নিজস্বতাটুকুকে মনের গহনে কবর দিয়ে দিয়েছিলাম। ওই যে তুমি বললে না ,"কাদম্বরী তো খোলোস মাত্র।" আমরা মেয়েরা শুধু সবার পছন্দ মতন একটা খোলোস পরি আর পরতেই থাকি। নিজেদেরকে অন্যের পছন্দ মতন গড়ে নিই।
আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি না এই খোলোসের আড়ালের আসল 'আমি'টা আর সেই 'আমি'র অন্তরের মনটা কখন আর কোথায় হারিয়ে যায়।
মৃণালিনী : জানো তো তোমার দেওর, স্ত্রীর পত্রে, মৃণালের মনের গভীরে পৌঁছেছেন ঠিকই কিন্তু নিজের জীবনের মৃণালের খবর কখনো রাখেননি।
মাতু দিদি, আমার ভাবতে ভীষণ অবাক লাগে, যে ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল থেকে প্রথম নারী স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিলো, যে ঠাকুরবাড়ি বাঙালি নারীদের শিখিয়েছিলো কী ভাবে বাড়ির চৌহুদ্দির বাইরে পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে স্বাচ্ছন্দ্যে, সগর্বে, আত্ম-সম্মান সহ মাথা উঁচু করে এক নারী নিজের মতন করে চলতে পারে, সেই ঠাকুর বাড়িই কী করে শুধুমাত্র মাতৃত্বতেই এক নারীর পরিপূর্ণতা খুঁজলো। আর গর্ভে ধারণ না করেও তো মা হওয়া যায়। স্বর্ণ দিদির মেয়েকে তো তুমি মাতৃ স্নেহেই আগলে রেখেছিলে।
কাদম্বরী : (কেঁদে) মৃণালিনী, মৃণাল এই ভাবে তো কেউ আমায় বোঝায়নি কখনো আর বোঝেওনি কখনো। আসলে আমি নিজেও হয়তো নিজেকে বুঝিনি। সম্পর্কের অন্তরালে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে বেরিয়েছি।
নিজের জীবনটাকে আবর্তিত করেছি অপর একজনকে কেন্দ্র করে।
নিজের অনেক অক্ষমতার জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি। ঠাকুর বাড়ির শিক্ষা, জ্ঞান এবং প্রগতিশীলতার মধ্যে থেকে আমি হয়তো বিবর্তিত হয়েছি, বিকশিত নয়। আমার মনের সেই অন্ধকার ঠেলে তাই বুঝি নিজেকে ভালবাসতেও পারিনি। আর তাই.......
রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবী (ছবি - উইকিপিডিয়া)
মৃণালিনী : মাতু দিদি, আমার আজও মনে আছে আমাদের বিয়ের আচার অনুষ্ঠানে ভার খেলার সময় উনি সব ভার উল্টে দিয়েছিলেন। ছোটো কাকিমা বলে ছিলেন, 'এ কি করলি রবি'। তাতে উনি উত্তর দিয়েছিলেন, 'আজ থেকে আমার সব কিছু উলোট পালোট হয়ে গেলো। তাই ভার গুলো উল্টে দিচ্ছি।’
সেই দিন কার ছোট্টো মেয়েটি এই কথাটির মানে বোঝেনি। বোঝেনি সেদিন অনুষ্ঠানে তোমার অনুপস্থিতির কারণ। আজ বুঝি, হয়তো, কোনো বিষণ্ণতা, কোনো দুঃখ, কোনো ভয় ছিল, তোমার মনের কোণে। এক মাত্র সঙ্গী, সহপাঠী, এক মাত্র বন্ধুকে সংসার মঞ্চে হারিয়ে ফেলার।
মাতু দিদি, সে দিন যদি তুমি একটু অন্য রকম করে ভাবতে। যদি ওই ছোট্টো মেয়েটির অসহায়, ভীত চোখ দুটির দিকে তাকাতে, তবে হয়তো নয় বছরের ভবতারিনীর মধ্যে সেই পুরোনো অকৃত্রিম মাতঙ্গিনীকে খুঁজে পেতে যাকে হারিয়ে ফেলেছিলে কাদম্বরীর অভিজাত্যে। তোমার দেওর, তোমার রবি তো মাতঙ্গিনীর ছোট্টো হাত দুটি ধরে তাকে ঠাকুর বাড়ির বিশালত্বে হারিয়ে যেতে দেয়নি।
তুমিও তো পারতে ভবতারিনীর বন্ধু হতে, না হয় তার অভিভাবিকা হতে। কেন কিছু না বলে চলে গেলে মাতু দিদি?
আমরা এক সঙ্গে থাকলে হয়তো ইতিহাসটা অন্য রকম হতো। তুমি আর আমি দুজনে মিলে তোমার দেওরের লেখা গান বা কবিতা পড়তাম, তাঁর ভুলে দুজনে মিলে হাসতাম আর সে দূরে দাড়িয়ে ছদ্ম রাগে আমাদের দুজনের খুনসুটি উপভোগ করতো। হয়তো বেলাকে গল্প বলে ঘুম পাড়াতে। হয়তো বেলা আর রথী ঘুমিয়ে পড়লে আমরা এক সাথে Mark Twain পড়তাম।
কতো কিছু তো করা যেত। কতো কিছু তো করা হলো না মাতু দিদি।