ছুটির দিন সন্ধ্যেবেলায় অবনীবাবু একঘন্টা নীতুকে মহাভারত পড়ে শোনান। সটিক ব্যাখ্যা সমেত। পরের রোববারে ফিডব্যাক চান। খুশি হলে হাতে হাতে পুরষ্কার। নইলে লবডঙ্কা। একদিন ওমনি প্রশ্ন করলেন, বলতো দিদিভাই, গান্ধারী বিদুরের কে হন? ডানহাতটি পেতে নীতু বললো, "বৌদি"। সঙ্গে সঙ্গে হাতে হাতে বিশটাকার কিটকাট ইনাম। নীতু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এগারো ক্লাসে পড়ে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের রামায়ণ মহাভারতে তেমন আগ্রহ নেই। ইঁদুরের মতো তাদের ছুটোছুটি। পড়াশোনার চাপ। সময় কোথায়? কিন্তু অবনীবাবু বিশ্বাস করেন ভিত শক্ত না হলে বহুতল শীঘ্রই হেলে পড়বে। নীতুর মা অনীতা শ্বশুরের ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। ওর বাবা ছিলেন গ্রামের গরীব স্কুলমাষ্টার। সেই স্কুল থেকে প্রতিবছর মাধ্যমিকে প্রথম দশজনের একজন এখনো উঠে আসে। নীতুর বাবা বলেন, ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে না পড়ালে মেয়ে জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়বে। সত্যিকথা বলতে কি দাদুর কাছে নেওয়া নীতুর এই মহাকাব্যের ক্র্যাশ কোর্স জীবনে যে কি কাজে আসবে অমরেশ তা ভেবেই পায় না ।
স্কুল থেকে ফিরে ব্যাকপ্যাক সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলে নীতু রান্নাঘরে মার কাছে যায়। অনীতা তখন পমফ্রেট ভাজছে। একটা দেবে মা? - এখন না। সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে, চানে যা। দাদুর চান হয়ে গেলে তোদের দুজনকে একসঙ্গে খেতে দেবো। নীতু ঘরে এসে খাটের ওপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে ওয়াগলে কি দুনিয়া বা কার্টুন ফিল্ম দেখে। অনীতা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলে, বাবা আগে চান করে নিন, ও নাহয় একটু পরে যাবে।
টেবিলে ভাত বেড়েছে মা । পাতলা ডাল, আলুভাতে, পমফ্রেটের ঝাল আর টক দই। মা আলুভাতে মাখতে পারে না। আলুসেদ্ধ আর আলুভাতে তো এক নয়! ঠাকুমা মাখতো হাফডাষ্ট মরিচ আর একচিমটে রকসল্ট দিয়ে, আঙুলে ভালোবাসা মিশিয়ে। দুবছর আগে ছবি হয়ে গেছে বুড়ি। খেতে খেতে নীতুর ঠাকুমাকে খুব মনে পড়ে। জবাকুসুম ভোরবেলায় ঠাকুমার সঙ্গে ছাদের গাছে জল দিতো নীতু । তখন সারাক্ষণ ওদের বকবকানি। এসব কথা মা কোনোদিন শোনে না। অফিস থেকে ফিরে বাবার হাঁড়িমুখও সারাক্ষণ ল্যাপটপের আড়ালে। অথচ কথা জমে থাকলে নীতুর পেট ফুলে জয়ঢাক। মনের কথাগুলো বুড়ির সঙ্গে বলতে পেরে তবে ওর শান্তি। ঠাকুমা সব কথা শুনতো। ফুল ফোটার শব্দ, সন্ধ্যে নামার শব্দ, মিনি বেড়ালের পায়ের আওয়াজ বুড়ি কান পাতলে শুনতে পেতো। এখন নীতুর কথা শোনার লোক নেই।
রোদ পড়লে নীতু পাশের বাড়ির মুন্নির সঙ্গে ওদের ছাদে যায়। স্কুলের গল্প করে। ওদের মনে অনেক প্রশ্ন। অনেক অস্থিরতা। কে শুনবে। কেইবা বুঝবে। বিষন্ন আকাশে অস্তরাগ ঘনায়। হাঁসগুলো হেলেদুলে ঘরে ফিরে আসে। এলইডি স্ট্রীটল্যাম্প জ্বলে ওঠে। মা'র শাঁখের চেনা শব্দে নীচে নেমে আসে নীতু। ধুপের গন্ধে ঘন্টি নাড়ার শব্দে বোঝে মা আরতি করছে। হাত পা ধুয়ে বইপত্র গুছিয়ে ও পড়ার টেবিলে যায়।
অনীতা স্বপ্ন দেখে নীতু ছোটোখাটো ডাক্তার হোক। অর্ডিনারি এম.বি.বি.এস। ভালো রেজাল্ট চাই, প্রচুর প্র্যাকটিশ হবে। নিজের বিদ্যেটুকু উজাড় করে দিয়েও রোগ না সারলে সময় থাকতে পাঠাবে স্পেশালিস্ট এর কাছে। ছোট্ট একটা টুকটুকে গাড়ি কিনবে। গয়না বেচে সাজিয়ে দেবে মেয়ের চেম্বার। এসব কথা অনীতা কাউকে বলে না। বলতে নেই। সুগন্ধী ফুলের চাষ বুকের মধ্যে করতে হয়। নীতুর ইচ্ছে অবশ্য তার মায়ের স্বপ্নের সাথে একটুও মেলে না। নীতু পাইলট হতে চায়। ককপিটে বসে আকাশপথে উড়িয়ে নিয়ে যাবে যাত্রীদের। বাবাকে বলেছে উচ্চমাধ্যমিকের পর কোনো ভালো ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হবে। বাবা বলেছে তার জন্যে সায়েন্স গ্রুপে খুব ভালো রেজাল্ট চাই। এছাড়া খরচও অনেক। এডুকেশন লোন নিতে হবে। এয়ারলাইন্স পাইলট প্রশিক্ষণের খরচ সবচেয়ে বেশি। মা বলেছে অতো টাকা কোথায় পাবে তুমি? আমরা ছাপোষা মানুষ। ওসব অলীক স্বপ্ন দেখো নাতো।
নীতু কাল স্বপ্নে হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধনের সঙ্গে শপিং মলে গেছিলো। মাথার পাশে কালরাতে শিবরাম ছিলেন। দাদুর দেওয়া জন্মদিনের উপহার। আজকে মাসের দশ তারিখ। তেইশ তারিখে ক্লাসফ্রেন্ড নন্দিতার বাড়িতে জন্মদিনের নেমন্তন্ন। মা বলেছে উপহারে বই কিনে দেবে। নীতু বলেছে আজকেই বইটি কিনে আনতে। গিফট প্যাক বানানোর আগে খবরের কাগজ জড়িয়ে যতোটা পারে পড়ে নেবে ও। হাতের কাছে যা পায় নীতু তক্ষুণি পড়ে ফেলে। কাগজের ঠোঙা সাবধানে ছিঁড়ে সেটাও তার পড়া চাই ।
সোম, বুধ ও শুক্রবারে সন্ধ্যেবেলায় মাষ্টারমশাই আসে। মুখার্জীপাড়ার ইন্দ্র। যাদবপুরে ফিজিক্স পড়ায়। নীতুর আজ মন খারাপ। জানেন স্যার, স্কুলবাসের জানলা দিয়ে আজ দেখলাম দুটো ষন্ডামার্কা লোক একটা বিশাল বড়ো লাল রঙের ট্রলিব্যাগ টানতে টানতে হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছে। তাদের হাইলাইট করা চুল আর ভাঁটার মতো গনগনে চোখ। মনে হলো ওই ব্যাগটাতে কোনো মেয়ের শরীর কুচিকুচি করে কেটে রেখেছে ওরা। সবসুদ্ধু গঙ্গায় ফেলবে বলেই ওদের অমন তাড়াহুড়ো।
হাহা করে হেসে উঠলো ইন্দ্র । খবরের কাগজে এসব পড়ে তোমার মনে ভয় ঢুকেছে সুনীতা। ভয় পেয়ো না, এসো আজ আমরা আর এক সুনীতার কথা শুনি, একটু ভাবি। আটদিনের জায়গায় দীর্ঘ ন'মাসের অনিশ্চয়তায় মহাকাশ স্টেশনে কাটিয়ে যার ড্রাগন ক্যাপসুল অবশেষে নেমে এলো অতলান্তিক এর বুকে, এই চিরচেনা নীলগ্রহে, ভালোবাসার ঘরে। এসো, আমরাও সকলে মিলে এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলি। ইন্দ্র বাড়িয়ে দিলো তার ডান হাত। সুনীতা ধরলে। নিঃসংশয়ে, পরম নির্ভরতায় ।