পুরানো কলকাতার ম্যাপ - ১৮৮০ (ছবি - https://www.abebooks.com/)
এই প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করতে গেলে আমাদের প্রথমেই চোখ বুলিয়ে নিতে হবে ১৬৯০ সালের আগের ইতিহাসে। প্রাচীন প্রমাণ থেকে জানা যায় যে দিল্লি সালতানাতের আগমনের অনেক আগেই কলকাতা একটি প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন যে কলকাতার ইতিহাস দুই হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। বর্তমান কলকাতার আশেপাশের অঞ্চলে তার এমন কিছু প্রাচীন শিকড় রয়েছে যেখানে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেও মানববসতির প্রমাণ মেলে। কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এই অঞ্চলটি বিগত দুই হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে ছিল জনবসতিপূর্ণ। সেই থেকে অনুমেয় যে এই শহরের উৎপত্তি সম্ভবত মৌর্য ও গুপ্ত যুগে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখ্য হল - ১৪৯৫ খ্রীষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ কাব্য। আবার ১৫৮২ সালে দিল্লির সম্রাট আকবরের অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমলের নির্দেশে সমগ্র বাংলা সুবা (প্রদেশ) জরিপ করে “ওয়ালিশ-ই-জমাতুমার” নামে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয় যেখানে কলকাতার উল্লেখ আছে প্রদেশ হিসাবে। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থেও কলিকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়।
ঔপনিবেশিক স্থাপত্য সমৃদ্ধ কলকাতায় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে বেশ কিছু গির্জা। ইংরেজরা এদেশে আসার আগেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ান ও পর্তুগিজরা বাংলায় এসেছিল। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ফিরিঙ্গি বণিকদের আনাগোনা শুরু হয় কলকাতায়।
ক্রমে ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে’…
এই শহরের নথিভুক্ত ইতিহাস ১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পরেই শুরু হয়। এই শহরের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে তিনটি গ্রামের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এরা হল – সুতানটি (বা yarn market), গোবিন্দপুর যা ভগবান কৃষ্ণের নামাঙ্কিত আর কলিকাতা যা কিনা কালি মাতা বা দেবী কালিকার স্থান। এই শহরের নামকরণ প্রসঙ্গে যে মতামতগুলি ঘুরে ফিরে আসে তার মধ্যে এই “দেবী কালিকার থান বা স্থান” মতটিই প্রধান। আবার মতান্তরে, "কিলকিলা" অর্থাৎ "চ্যাপ্টা এলাকা” - এই কথাটি থেকে "কলিকাতা" নামটির উৎপত্তি হয় বলে অনেকে অনুমান করেন। অন্যান্য কিছু মতামতও অবশ্য রয়েছে। যেমন, - খাল-কাটা শব্দ দুটির বিকৃতির ফলে এই নামটির উৎপত্তি ঘটে বলে অনেকের ধারণা। আবার এই অঞ্চলটি কলিচুন ও কাতা বা নারকেল ছোবড়ার আঁশ উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। এমনও হতে পারে যে কলিকাতা নামটির উৎপত্তি এই কারণে ঘটেছিল।
ব্রিটানিকার তথ্য অনুসারে চার্নকের এখানে আগমনের পূর্বে হুগলি নদী বন্দর সংলগ্ন অঞ্চলে মুঘলদের সাথে বৃটিশ কর্মকর্তাদের বিরোধ ছিল এবং সে কারণে তাঁকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। তারপরে তিনি অন্য জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। মুঘল কর্মকর্তারা, ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্য থেকে যা অর্জন করেছিল তা হারাতে না চাইলে, চার্নককে আরও একবার ফিরে আসার অনুমতি দেয়। তখন তিনি কলকাতাকে তার পছন্দের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন। তখন প্রতিদ্বন্দ্বী ডাচ, ফরাসি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় বসতিগুলি নদীর পশ্চিম তীরে ছিল, ফলে পূর্ব পাড়টি নির্বাচিত হয়। সাথেই সমুদ্র থেকে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা হুগলি বন্দরে কম। মনে রাখতে হয় এই সময়ে হুগলী নদীটিও বাণিজ্যতরী ও রণতরী চলাচলের জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত ও গভীর ছিল। ১৬৯০ সালের ২৪শে আগস্ট কলিকাতার পত্তন জোব চার্নকের পদার্পণের সাথে বলেই ধরে নেওয়া হয়। যদিও আধুনিক গবেষকগণ এই মত খণ্ডন করেছেন। ২০০৩ সালে একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়ে দেন যে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা অভিধায় অভিহিত করা যাবে না।
ইউরোপীয় জনবসতি বাড়ার সাথে সাথে ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবে তৈরি হতে থাকে কলকাতার একের পর এক গির্জা। সেন্ট জন'স চার্চ কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম নির্মিত ভবনগুলির অন্যতম। বর্তমান রাজভবনের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত এই গির্জার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৭৮৪ সালে আর শেষ হয় ১৭৮৭ সালে। এটি কলকাতার তৃতীয় সর্বাধিক প্রাচীন গির্জা যেটি লন্ডনের “সেন্ট মারটিন ইন দ্য ফিল্ড” চার্চের আদলে নির্মিত। চার্চের জন্য জমিটি প্রদান করেছিলেন শোভাবাজার রাজাবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নবকিশেন বাহাদুর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, শহর কোলকাতায় রাজত্ব কায়েম করার শুরুর দিকে জনসাধারণের জন্য প্রথম যে ‘পাবলিক বিল্ডিং’ তৈরি করেছিল, সেটাই আজকের সেন্ট জনস চার্চ। এই চার্চের বাগানে শায়িত রয়েছেন কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা (বিতর্কিত?) জোব চার্নক। ল্যাটিন ভাষায় সমাধি ফলকে লেখা তাঁর মৃত্যু তারিখ - ১০ জানুয়ারি, ১৬৯২। অষ্টভূজাকৃতি মুরিশ-স্টাইলের সমাধিটি বানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম মেয়ে মেরির স্বামী চার্লস আয়ার। এছাড়াও এখানে রয়েছে গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্ন-এর সমাধি আর লেডি ক্যানিং-এর স্মৃতিসৌধ। তাছাড়াও রয়েছে বেগম ফ্রান্সিস জনসন (১৭২৫-১৮১২)-এর সমাধি। কলকাতার ‘গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি’ হিসাবে পরিচিত এই মহিলা সিরাজদৌল্লার মায়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখানে সবথেকে বড় ও উঁচু স্মারকটি দ্বিতীয় রোহিলা যুদ্ধে মৃত ইংরেজ সৈন্যদের স্মৃতি - রোহিলা ওয়ার মেমোরিয়াল আর পশ্চিমের পাঁচিল ঘেঁষে ‘ব্ল্যাক হোল অব ক্যালকাটা মনুমেন্ট’। কথিত যে কলকাতা দখলের সময় নবাব সিরাজদৌল্লা একটি ছোট ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলেন প্রায় ১৫০ জন ইংরেজ সৈন্যকে - যারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। এই মনুমেন্ট তাদেরই স্মৃতি বহন করে চলেছে। এই মতামত নিয়ে যদিও প্রচুর বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
উত্তরে সুতানটি তৎসহ চিতপুর, পশ্চিমে গঙ্গানদী, পূর্বে লালবাজার, দূর দক্ষিণে গোবিন্দপুর যা বর্তমানে ফোর্ট উইলিয়াম আর ময়দানের অংশবিশেষ - প্রাথমিকভাবে মূল কলকাতা বলে ধরে নেওয়া যায়। ১৬৯৬ সালে বর্ধমানের নিকটবর্তী জেলায় একটি বিদ্রোহ শুরু হয়, তখন মুঘল প্রাদেশিক প্রশাসন ক্রমবর্ধমান বসতির প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোম্পানির কর্মচারীরা, যারা তাদের ট্রেডিং পোস্ট, বা কারখানাকে শক্তিশালী করার অনুমতি চেয়েছিল, তাদের আত্মরক্ষার জন্য সাধারণ শর্তে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পর্তুগিজদের বাণিজ্যঘাঁটি ছিল সুতানুটি। পরবর্তীকালে ডাচ (ওলন্দাজ) বণিকরা হুগলি নদী থেকে খাল কেটে এখনকার মধ্য কলকাতাকে সুরক্ষিত করে।
১৭৫৪ সালে শিল্পী Jan Van Ryne-র চিত্রিত ফোর্ট উইলিয়াম (সংগৃহীত - https://puronokolkata.com/)
আসল ফোর্ট উইলিয়াম তৈরী হয় ১৬৯৬-৯৯ সালে। এটি সম্পূর্ণ হয় ১৭০৬ সনে। এই দুর্গটি ছিল একাধারে একটি সেনানিবাস ও আঞ্চলিক সেনা কার্যালয়। কলকাতা এরপর "প্রেসিডেন্সি সিটি" হিসাবে ঘোষিত হয় এবং পরে বাংলার প্রেসিডেন্সির সদরে পরিণত হয়। অবশ্য কলকাতার আগে আরো পাঁচটি রাজধানী ছিল অবিভক্ত বাংলার। গৌড়, রাজমহল, ঢাকা, নদীয়া এবং অবশ্যই মুর্শিদাবাদ – যেখানে বাংলার নবাবের অধিষ্ঠান ছিল। সেদিক থেকে দেখলে কলকাতাকে বাংলার ষষ্ঠ রাজধানী হিসাবে ভাবা চলে। ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফারুখ সিয়ার বার্ষিক ৩০০০ টাকা প্রদানের বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাণিজ্যের স্বাধীনতা প্রদান করেন; এই ব্যবস্থা কলকাতার বিকাশে একটি বড় প্রেরণা দেয় এবং বিপুল সংখ্যক ভারতীয় বণিক এই শহরে ভিড় করতে শুরু করেন। কোম্পানির কর্মচারীরা কোম্পানির পতাকা তলে শুল্কমুক্ত ব্যক্তিগত বাণিজ্য চালনা শুরু করে দেন। ১৭০৬ সালে যেখানে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ১০,০০০ থেকে ১২,০০০-এর মধ্যে, সেটি ১৭৫২ সাল নাগাদ প্রায় ১,২০,০০০-এ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লা এই শহর অবরোধ ও অধিকার করলে খোদ ইংল্যান্ডেও এই শহর খ্যাতিলাভ করে। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মতে সিরাজ প্রায় ৪৩ জন ব্রিটিশ বাসিন্দাকে একটি ছোট গুদামঘরে গুমখুন করান। এই স্থানকে কলকাতার কৃষ্ণগহ্বর বলা হয়। সেইসময়ই তিনি কলকাতার নামকরণ করেছিলেন আলিনগর। অবশ্য রবার্ট ক্লাইভ পরের বছরই কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন। নবাবের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে আদি ফোর্ট উইলিয়াম অনেকটাই বিনষ্ট হয়ে যায়, ১৭৬৬-সনে মেরামতের পর এটি কাস্টমস হাউসে রূপান্তরিত হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৫৮ সনে রবার্ট ক্লাইভ নতুন ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণ শুরু করেন, যেটি আজ আমরা ময়দানের পশ্চিম প্রান্তে দেখতে পাই। লেখক দেবাশিস দের “পুরোনো কলকাতার কাহিনী” থেকে জানতে পারি “১৬শ শতাব্দীর প্রথম থেকেই নতুন বন্দর ভিত্তিক বাণিজ্যের জন্য সেখানকার শেঠ (শ্রেষ্ঠী) ও বসাকরা প্রথমে বেতর ও পরে গোবিন্দপুর অঞ্চলে বসবাস ও বাণিজ্য করতে শুরু করল… কলকাতার বন কেটে বসত আসলে শুরু করেন শেঠ ও বসাকরাই”।
১৭১৫ সনে ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সি স্বীকৃতির পর বিদেশী জন কোম্পানি গঠন করে মেয়র্স কোর্ট আর কিছু বিত্তশালী, প্রভাবশালী ইংরেজ, অ্যংলো ইন্ডিয়ান এঁরা মূল শহর কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। এই শহর হয়ে ওঠে দেশের বৃহত্তম বাণিজ্যস্থল। পাশ্চাত্য ঘরানার ব্যবসায়িক ঔপনিবেশিক এই শহরে নির্দিষ্টভাবে ঘিঞ্জি আর অপরিকল্পিত এলাকায় দেশীয় বাসিন্দাদের জন্য আলাদা পাড়া ছিল মূল শহরের পূর্ব আর উত্তর ঘেঁষে। সুপরিকল্পিত এবং ফাঁকা জায়গায় বসতি ছিল ইউরোপীয়ানদের, সেটি দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। স্বাধীনতার পরে এই সাহেবপাড়াগুলি দেশীয় ধনীদের বাসস্থান বা পার্ক স্ট্রিট প্রভৃতির মতো বাণিজ্যিক অঞ্চল হয়ে ওঠে। লর্ড ওয়েলেসলির আমলে কলকাতা শহরের উল্লেখযোগ্য কলেবর বৃদ্ধি ঘটেছিল। তার আমলেই কলকাতার অধিকাংশ সরকারি ভবনের নির্মাণকার্য শুরু হয়। এই ভবনগুলির বিশালতা ও স্থাপত্যসৌকর্যই কলকাতাকে "প্রাসাদ নগরী" বা "সিটি অফ প্যালেসেস" সম্মান প্রদান করেছিল। কলকাতা পুরসভার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া গভর্নর জেনেরাল মেটাকাফ ১৮৪৪ সালে গ্রীক স্থাপত্যের অনুকরণে মেটাকাফ হল নামে গঙ্গাতীরস্থ হেরিটেজ বিল্ডিংটি নির্মাণ করেন গ্রীসের temple of wings এর অনুকরণে। গঠনগত দিক থেকে ত্রিশটি ছত্রিশ ফুট দীর্ঘ classical Corinthian স্তম্ভ এই দ্বিতল পাঁচ প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট বাড়িটির ভারবহন করে। প্রাথমিকভাবে দ্বারকানাথ ঠাকুরের Calcutta Public Library-র প্রায় ৫০০০ বই আর ব্যক্তিগত সংগ্রহের ভিত্তিতে এটি লাইব্রেরী হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। বর্তমানে এটির নিচের তলায় এশিয়াটিক সোসাইটির দুষ্প্রাপ্য কিছু বিদেশী জার্নাল আর ম্যনুস্ক্রিপ্ট সংরক্ষিত আছে। আর দ্বিতল বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহের প্রদর্শনী শালা যার মধ্য দিয়ে কলকাতার তথা বাংলার সংস্কৃতি জগতের ক্রমবিবর্তন সুস্পষ্ট রূপে ফুটে ওঠে।
একটা বিষয় কিছুতেই ভুললে চলবে না, নগর কলকাতা কিন্তু সেভাবে সুপরিকল্পিত উপায়ে গড়ে ওঠে নি। বরং একান্তই বানিজ্যিক স্বার্থে সপ্তগ্রাম বন্দর বাণিজ্যের অবনতি ঠেকাতে তড়িঘড়ি গড়ে উঠেছিল, যাতে সুবিধাবাদী বিদেশী ব্যবসায়ী বা তাদের ঘনিষ্ঠ দেশীয় স্বার্থান্বেষীদের নগরপত্তন সংক্রান্ত পরিকল্পনার কোনো স্থান ছিল না। কি করে সৈন্য যাতায়াত দ্রুত করা যায়, বাণিজ্যে গতি আনা যায় এইসব চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে লর্ড ওয়েলেসলির সময় (১৭৯৮ – ১৮০৫) অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পথ ইত্যাদি নির্মাণ অবাধে চলতে থাকে। পার্থ দত্ত মহাশয়ের কলকাতার প্ল্যানিং সংক্রান্ত বইটি খুললে দেখা যাবে কলকাতা গড়ে ওঠার পিছনে পরিকল্পনা তো ছিলই না উল্টে ভয়ংকর অপরিণামদর্শিতা ছিল। যে কারণে ১৭৩৭ সালের “হারিকেন” নামক প্রবল ঝড়ে দুইশতাধিক বাড়ি উড়ে যায়, প্রায় ৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় যা রোধ করার ক্ষমতা এই অপরিকল্পিত নগরীর ছিল না। সে সময় কলকাতাকে মড়কপূর্ণ শহর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
১৭৫৭ সালে একটা ব্যাপক পরিবর্তনের মুখোমুখি হল শহর কলকাতা। অবশিষ্ট বাঙালীদের উচ্ছেদ করা হতে থাকল ডালহৌসী অঞ্চল থেকে আর তাদের ঠাঁই হতে থাকল আরও উত্তরে। এর মূল কারণ ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের সুরক্ষা, ডকইয়ার্ড গঠন, চার্চ, নানাবিধ নদীতীরস্থ ঘাট নির্মাণ ইত্যাদি। এই সময় থেকেই বৃহত্তর কলকাতার গঠনে বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, গার্ডেনরিচ ইত্যাদি অঞ্চলের শহরভুক্তি শুরু। উত্তর কলকাতা ঘিঞ্জি হয়ে যাবার কারণে আর পশ্চিমে গঙ্গা নদীর গতিপথের হেলদোলের অনিশ্চয়তায় না গিয়ে কলকাতার বৃদ্ধি হতে থাকল পূর্বে আর দক্ষিণে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতা শহর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শহরের দক্ষিণে যে অংশে ব্রিটিশরা বাস করতেন সেটিকে ইংরেজিতে বলা হত "হোয়াইট টাউন" এবং উত্তরে যে অংশে ভারতীয়েরা বাস করত সেটিকে ইংরেজিতে বলা হত "ব্ল্যাক টাউন"। এই সময় শহরের বিভিন্ন স্থানের নামকরণ হতে থাকে যেমন কুমোরটুলি কুমোরদের এলাকা এবং সাঁকরিপাড়া শঙ্খ-খোল শ্রমিকদের এলাকা ইত্যাদি। দেশী হাটবাজারের খোলনলচে পাল্টে পাকা বাজার নির্মাণের প্রস্তাব বিলিতী ব্যবসায়ীদের থেকে আসতে থাকে কোম্পানীর কাছে। কলকাতার বাজারায়নের উদাহরণ দু-একটা দিলেই ধারণাটি পরিস্ফুট হবে। জোসেফ শেরবার্ণ সাহেব কসাইটোলা থেকে ইমামবাড়ী স্ট্রিটের মাঝামাঝি ইসমাইল সারেঙের বাগান কিনে নিজের নামে মার্কেটের সূচনা করেন। এরপাশেই ছিল বিরাট আস্তাবল আর পশুপাখির পাইকারি হাট যার মাথার ওপর টাঙানো থাকত চাঁদোয়া। শেরবার্ণ সাহেবের মৃত্যুর কিছুদিন পর এই বাজারের চরিত্রগত পরিবর্তন হয়, নাম হয় চাঁদনী বাজার। আবার এই বাজারের দ্বিতীয় গলিতে মসজিদের ডানদিকে পুরনো ইংরেজ আমলের দোকান ছিল ‘কাদির কাইট শপ’ যা নবাবী আমলের ঘুড়ি ওড়ানোর সৌখিন শখ মেটাতো, এখন তা পরিবর্তিত ‘সরগম ইলেক্ট্রনিক্স’ যেটা অনেকেই চেনেন। এই সময়ের কিছুদিন পরে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে শহুরে বাঙালিদের মধ্যে এক নব্য বাবু শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল। এই বাবুরা ছিলেন সাধারণত উচ্চবর্ণীয় ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু। পেশাগতভাবে এঁরা ছিলেন পড়তি জমিদার, উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী প্রভৃতি।
সামাজিক পরিস্থিতির আলোচনা থেকে আবার বানিজ্যকরণ আর প্রশাসনিক বিষয়ে ফিরে আসা যাক। ১৭৭২ সালের পর কলকাতা বৃটিশ ভারতের রাজধানীর সম্মান পায়, আর ১৯১১ সালে প্রাক স্বাধীনতা আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ এইসব বিষয়ের থেকে রাজধানীকে সুরক্ষিত রাখতে বৃটিশ সরকার ভারতের রাজধানীকে কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করেন। ১৮৫০-এর দশক থেকে কলকাতা শহর বস্ত্রবয়ন ও পাটশিল্পে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার এখানে রেলপথ ও টেলিগ্রাফ প্রকল্পের মতো পরিকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন।
আসলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশরাজের সরাসরি শাসনের প্রথম ১৫০ বছর (১৯০৫ সাল পর্যন্ত) তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশ নানাভাবে অবহেলিত ছিল। ১৭৭২ সালে মুর্শিদাবাদের পরিবর্তে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়। ১৯১১ সালে দিল্লিতে স্থানান্তরের আগপর্যন্ত কলকাতাই ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। তারপর থেকে ক্যালকাটা বা কলকাতা শুধু বাংলা, আসামসহ কিছু অঞ্চল ও রাজ্যের রাজধানী। পরে ১৯৪৭ সালের পর থেকে শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। প্রশাসনিক দিক থেকে দেখলে ১৮৬২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের প্রতিষ্ঠা হয় আর তার প্রথম বিচারপতি ছিলেন স্যার বার্ণস পিক। তথ্যসূত্রের অনুসন্ধিৎসু যাঁরা তাঁরা ২০০৯ সালে প্রকাশিত ২০শে জুলাই প্রকাশিত “কলকাতা পুরশ্রী” নামের ৭ম সংখ্যার চটি বইটি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন অথবা ১৯৫ বছরের প্রাচীন রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি যেটি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোডে অবস্থিত তার নিচের তলে “পুলিশ মিউজিয়াম”টি ঘুরে দেখতে পারেন।
১৮৮৩ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন। এটিই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন। এরপর ধীরে ধীরে কলকাতা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশেষত বিপ্লবী সংগঠনগুলির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় কলকাতা শহর। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত যে যুগান্তকারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার আন্দোলন বাঙালি সমাজের চিন্তাধারা ও রুচির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তার পটভূমিও ছিল এই কলকাতা শহর। বাংলার নবজাগরণ শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের পথপ্রদর্শক হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাবাহিনী একাধিকবার কলকাতা শহর ও বন্দরে বোমা নিক্ষেপ করেছিল। কলকাতায় জাপানি বোমাবর্ষণের প্রথম ও শেষ ঘটনাটি ঘটে যথাক্রমে ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বর এবং ১৯৪৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। যুদ্ধের সময় কলকাতায় পঞ্চাশের মন্বন্তরে লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে মারা যান। এই মন্বন্তরের কারণ ছিল সামরিক তাণ্ডব, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ১৯৪৬ সালে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবিতে এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ভারত বিভাগের সময়ও বহু মানুষ সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন। দেশভাগের পর বহুসংখ্যক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান এবং সেই দেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দু কলকাতায় চলে আসেন। এর ফলে শহরের জনপরিসংখ্যানে একটি বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। কলকাতার দাঙ্গা, হিরোশিমাতে পরমাণু বিস্ফোরণ এইসবের মাঝেই ১লা এপ্রিল বাংলার নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশ। বিধানসভার ২৩৮টি সিটের মধ্যে ১৫০ টি কংরেসের অধীন; কমিউনিস্ট পার্টি ২৮ আর নতুন প্রতিষ্ঠিত শ্যামাপ্রসাদ বাবুর জনসংঘ ও হিন্দু মহাসভার জোট ১৩টি আসন পায়। প্রায় ৭ জন বিশিষ্ট কংগ্রেস মন্ত্রী হেরে যান, যদিও মফঃস্বলে প্রায় একচেটিয়া জয় কিন্তু উদ্বাস্তু আগমনের প্রভাব শহরবাসীর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শুরু হয় মহানগরীর অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি। নির্বাচনের প্রায় সাড়ে চার মাস পর রাজ্যের মূল মন্ত্রীসভা গঠন এই স্থগিত পরিস্থিতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে ব্রিটিশ বাংলা প্রেসিডেন্সির হিন্দুপ্রধান পশ্চিমাঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। কলকাতা এই রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা পায়। ২০০১ সালে কলকাতার ইংরেজি নাম ‘ক্যালকাটা’ বদলে ‘কলকাতা’ করা হলে ‘কলিকাতা পৌরসংস্থা’ নামের পরিবর্তে ‘কলকাতা পৌরসংস্থা’ নামটি চালু হয়। কলকাতাই পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জেলা যেটির কোনো মহকুমা নেই এবং এটি কলকাতা পুলিশ ও পৌরসভার দায়িত্বাধীন যা ১৮৬৬ সালের 'কলকাতা পুলিশ' আইন' এবং ১৮৬৬ সালের 'কোলকাতা উপ-পৌর পুলিশি আইন'-এর অধীনে সংজ্ঞায়িত। এভাবেই ইতিহাসের নানা বিবর্তনের সাক্ষী থেকে দূর দারুচিনি গাঙ্গেয় বদ্বীপে জনঘনত্বের সমুদ্রসফেন কলকাতা আজও কল্লোলিনী তিলোত্তমা হয়ে রয়ে গেছে।
তথ্যসূত্রঃ
১. “কলিকাতার ইতিবৃত্ত” – প্রাণকৃষ্ণ দত্ত
২. ব্রিটানিকা ও উইকিপিডিয়া
৩. “পুরোনো কলকাতার কাহিনী” – দেবাশিস দে
৪. কলকাতা পুরসভার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
৫. “কলকাতা পুরশ্রী” ৬ঠ ও ৭ম সংখ্যা
৬. আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোডে অবস্থিত “পুলিশ মিউজিয়াম”
৭. প্রবন্ধ – বহুরঙা থেকে একমেটে – ঈপ্সিতা হালদার
৮. প্রবন্ধ – উদ্বায়িত মান্দাস – ব্রাত্য বসু।
৯. Brief introduction leaflet of St John’s Church, Kolkata, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লেখা সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগের প্রতিবেদন