লেনিন (ছবি - উইকিপিডিয়া)
১
যাঁদের সাথে মার্ক্সবাদের পরিচিতি নেই, বা যাঁরা মার্কসবাদ-নামক তত্ববিদ্যার সাথে সুপরিচিত নন, এবং যাঁরা এই মতবাদের বিরোধী; তাঁদের সবার কাছেই মনে হবে এই শীর্ষক 'লেনিনের দর্শন চর্চা... ' নিশ্চয়ই একটি ভ্রান্তি। এবং তাঁদের মনে হতেই পারে যে এই বিষয়ে যে কোনও লেখার মতোই বর্তমানের এই প্রবন্ধটিও গুরুত্বহীন। কারণ, তাঁদের মতে লেনিন বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন, তা ঠিক। তিনি ১৯০৫ এর ব্যর্থ বিপ্লব আর ১৯১৭ -এর সফল বিপ্লবের প্রধানতম নেতা এবং হোতা – সেও ঠিক। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি নামক সাংগঠনিক ধারণারও তিনিই প্রথম সূত্রকার, যদিও সেই ধারণার বিরুদ্ধে লুক্সেমবার্গ সহ আরও অনেক তৎকালীন মার্কসবাদী দাঁড়িয়ে ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ারও (কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক না সমাজতান্ত্রিক - তা নিয়েও অবশ্য বিতর্ক ছিল এবং এখনও আছে) তিনিই পরিকল্পনাকার, সংগঠক, নৈতিক রূপরেখার তাত্ত্বিক এবং শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তিনিই ছিলেন প্রধান সেনাপতি। তা বলে দর্শনচর্চা? কখনোই না।
তাঁদের কোনো দোষ দেওয়াও যায় না। কেননা তাঁরা জানেন না যে মার্কসবাদ নিজেই একটি দর্শন। মার্কসবাদ কেবলমাত্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে নির্মিত ও চর্চিত রাজনৈতিক মতবাদ নয়। আর এঙ্গেলস সহ অনেক মার্কসবাদীকেই রাজনৈতিক লড়াইয়ের সাথে সাথেই তীব্রতম দার্শনিক সংগ্রামও চালাতে হয়েছিল। লেনিন সেই উত্তরাধিকার পালনের উজ্জ্বলতম উদাহরণ। তাঁর দর্শন চর্চার কেন্দ্রে ছিল মূলত দুটি বিষয়, - ঘটনাচক্রে সামনে চলে আসা আন্তর্জাতিক দার্শনিক লড়াই এবং বিপ্লবের সঠিক দিশানির্মাণ। আমরা এখানে প্রধানত তাঁর রচিত দার্শনিক নোটবইয়ের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেবার চেষ্টা করেছি।
২
লেনিনের দর্শন চর্চার সাথে যুক্ত রয়েছে প্রধানত দুটি রচনা। প্রথমটি হলো - ‘বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ-বিচারবাদ’ (Materialism and Empirio-Criticism, এটি এর পরে MEC দিয়ে চিহ্নিত হবে)। এবং দ্বিতীয়টি হলো - দার্শনিক নোটবুক (Philosophical Notebooks, এটি এর পরে PN দিয়ে চিহ্নিত হবে)।
MEC রচিত হয়েছিল ১৯০৮ সালে। এই বইটির প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল দুটি -
ক) প্রকৃত বস্তুবাদের সংরক্ষণ।
এবং খ) তৎকালীন পদার্থবিদ্যার জগৎ থেকে সংগৃহীত কিছু ধারণার সাহায্য নিয়ে মার্কসীয় বস্তুবাদেরই বিরোধিতা করার যে উদ্যোগ চলছিল তাকেই আটকানো।
মজার কথা হোলো, পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে লেনিনের এই বইটির (MEC) বিরোধিতায় বলা হয়েছিল যে, লেনিনীয় বস্তুবাদ আসলে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী। ঐ বিরোধীপক্ষের মতে, MEC তে উপস্থাপিত বস্তুবাদ আসলে মার্কসীয় বস্তুবাদই নয়। বরং বুর্জোয়া-স্বার্থবাহী "মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বস্তুবাদ"। এবং এই "মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বস্তুবাদ” নামটিও দেওয়া হয়েছিল বিরোধীপক্ষ থেকেই। এই চমকপ্রদ বিষয়টির বিস্তৃত আলোচনা অন্যত্র করবার ইচ্ছে রইলো।
এখন আমরা এখন PN সম্পর্কে কিছু কথায় ফিরবো।
৩
দার্শনিক নোটবই (Philosophical Notebooks == PN), লেনিন লিখিত একটি দার্শনিক রচনা, যা আসলে একটি সংক্ষিপ্তসার (Conspectus)। কিন্তু কিসের সংক্ষিপ্তসার? সংক্ষিপ্তসার একটি হেগেল অধ্যয়নের – হেগেলের 'Science of Logic' গ্রন্থের। এটি অবশ্য কোনও পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক গ্রন্থ নয়। এই সংক্ষিপ্তসার লেনিন লিখেছিলেন ১৯১৪ – ১৬ সালের মধ্যে। তবে ১৯২৯ – ৩০ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ লেনিনের মৃত্যুর আগে বইটি মানুষের কাছে অজ্ঞাত ছিল।
যদিও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মত সুপরিচিত দর্শন বিশেষজ্ঞের মতে লেনিন – রচিত এই নোটবইটির উদ্দেশ্য অস্পষ্ট বা সুনিশ্চিত নয়।
কিন্তু একাধিক সূত্র থেকে অনুমান করা যায় যে (১) সমকালীন বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতির মূল্যায়ন, (২) মার্ক্সীয় জ্ঞানতত্ত্বের অন্তর্গত প্রতিফলন তত্ত্বের অসম্পুর্ণতা (কিম্বা তখনও পর্যন্ত মার্কসবাদ অনুশীলনে প্রতিফলন তত্ত্বের যান্ত্রিক প্রয়োগের) দূরীকরণের উদ্দেশ্যে, এবং (৩) সঠিক চিন্তার যোগ্যতা কিভাবে অর্জিত হয় – এই গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণাটিকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই লেনিন এই নোটবইটি লিখেছিলেন। অন্ততপক্ষে এই তিনটি ( আরো কয়েকটি যদিও ধরতে পারা যায়) উদ্দেশ্য যে লেনিনের ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
নোটবইতে লেনিন জ্ঞান সম্পর্কিত বস্তবাদী প্রতিফলন তত্ত্বর বিষয়ে বলেছেন, "এযাবৎ মার্কসবাদীরা প্রতিফলন-তত্ব সম্বন্ধে বিশেষ খেয়াল করেননি, মানুষের জ্ঞান যে একপেশে প্রতিফলন-মাত্র নয়, জ্ঞান যে ডায়ালোক্টিক্যাল সে কথাটা তাঁরা অবহেলা করেছেন।" (এবং চূড়ান্ত অর্থে সম্ভবত এইভাবেই লেনিন জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে, দর্শনের আঙিনায় চলে আসা অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism) আর বুদ্ধিবাদ (Rationalism) -এর দ্বন্দ্বের নিরসন করেন।)
তিনি বলেছিলেন, মানুষের দ্বারা প্রকৃতির প্রতিফলনই জ্ঞানের নিকটবর্তী হয়। কিন্তু তার সাথে একথাও বলেছেন যে, প্রত্যক্ষ অনুভূতি থেকে বস্তুর যে জ্ঞান তৎক্ষণাৎ ঘটে সেটি আংশিক বা অসম্পূর্ণ জ্ঞান। মানুষের জ্ঞান কিন্তু ওখানেই থেমে থাকেনা। বরং মানুষের জ্ঞান ক্রমশ বস্তুর প্রকৃত জ্ঞানের আরো নিকটবর্তী হয়, উত্তরোত্তর অগ্রসর হতে থাকে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আরো যে কথাটি তিনি বলেছিলেন তা হলো চিন্তার ঐ অগ্রগমনই হোলো জ্ঞান। আর এইভাবে জ্ঞানের ভিত্তি যে প্রতিফলন, সেই বস্তবাদী জ্ঞানতত্ত্ব (যেটা লেনিনের গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি দার্শনিক বই, Materialism and Empirio-Criticism' এ তিনি জোরের সাথে হাজির করেছিলেন আর সত্য বলতে কি যেটা প্রকৃতি বিজ্ঞানের ভিত্তিও বটে), সেটির পুনরুক্তির সাথে সাথেই জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা, অর্থাৎ জ্ঞানের ক্রমোন্নয়নের গতিশীলতার ধারণাকেও বিকশিত করে তুললেন।
খুব স্পষ্ট করে বললেন, "জ্ঞানক্রিয়ায় কখনোই পূর্ণচ্ছেদ পড়ে না।" এইভাবেই জ্ঞানের অনন্ত সম্ভাবনার স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন, যাকে বৈজ্ঞানিক রুচিসম্মত বলতে আমরা বাধ্য।
৪
পরিশেষে যেটা লিখতে চাইবো, তা হলো লেনিন এই বইতে আরো একটি মূল্যবান ধারণার পুনরাবৃত্তি করেছেন। ঘটনাটি চেতনা আর বস্তু সম্পর্কে। তিনি বললেন, চেতনায় কেবলমাত্র যে বস্তু প্রতিফলিত হয় তা নয়। চেতনা বস্তু সৃষ্টিও করে। (লেনিন বলেছিলেন, "মানুষের চেতনা বাইরের বস্তুজগতকে শুধু প্রতিফলিতই করেনা সৃষ্টিও করে ") এবং এইভাবে তিনি চেতনার সক্রিয়তা আর স্বাধীনতার উপর জোর দিলেন। যদিও এই ধারণাটি মার্কস নিজেই দিয়েছিলেন 'থিসিস অন ফয়েরবাক' এ। তবুও যান্ত্রিক বস্তুবাদের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে উত্তরণের জন্য লেনিন- কৃত এই চেতনা-বস্তুর মিথস্ক্রিয়ার উপর জোরের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা ছিল। প্রয়োজন ছিল তত্ত্ব আর প্রয়োগের আন্তঃসম্পর্কের তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠা – সেটাও লেনিন PN-এর মাধ্যমে বললেন। অর্থাৎ, মানুষের কর্ম যে মানবীয় জ্ঞানের একটি বড়ো অঙ্গ – এই কথাটির উপর লেনিন জোর দিয়েছিলেন এই নোটবইটিতে।
আরো যে উদ্দেশ্যে এই নোটবই লেখা হয়েছিল বলে মনে হয় তা হলো সঠিক চিন্তা কিভাবে করতে হয়, তার দিশা নির্দেশ করা। সঠিক ভাবে চিন্তার দ্বান্দ্বিকতা কি – সেটাই তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
ফিলোসফিক্যাল নোটবুকস্-এর প্রচ্ছদ (ছবি - আমাজন ডট্ কম)
কারণ বস্তুবাদ স্বীকার করাটাই যথেষ্ট নয়। চিন্তার জড়ত্ব, স্থবিরতা আর অধিবিদ্যক (metaphysical) চিন্তা পদ্ধতির নেতিকরণ (negation) ঘটাতে না পারলে চিন্তার মুক্তি অসম্ভব। বস্তুজগতের প্রতিফলন শেষপর্যন্ত সত্যে পৌঁছে দেবে কিনা তা নির্ভর করে বিষয়ীর (Subject) সতর্ক আর সামগ্রিকভাবে চিন্তা করার সক্ষমতার উপর। আর সেটা বিষয়ীর সচেতন আত্মনির্মাণ ছাড়া অসম্ভব। সম্ভবত এই আত্মনির্মাণ প্রসঙ্গটিই অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্তের ভাষায় – "আরও স্পষ্ট করে বললে, MEC বইতে গুরুত্ব পেয়েছিল বিষয়বাদিতা (objectivity)। PN পড়লে দেখা যায়, সেখানে হেগেলীয় ভাবনায় স্বয়ম্ভু চেতনার আত্মানুসন্ধানের ধারণাকে ব্যাপক করতে গিয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে বিষয়ীবাদিতার (subjectivity), (বা, চেতনার সক্রিয়তা – লেখক) ভাবনা, যার প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন গেওর্গ লুকাচ ১৯২৩ সালে প্রকাশিত History and Class Consciousness গ্রন্থে এবং যে বইটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হল যে, বইটি প্রবলভাবে হেগেলীয় ভাবনায় প্রভাবিত এবং সেই কারণেই মার্কসবাদ বিরোধী।"
এবং এই আত্মনির্মাণ প্রক্রিয়ার মর্মার্থ আরো স্পষ্ট হয় যখন অধ্যাপক দত্তগুপ্ত বলেন, "... সোভিয়েত মার্কসবাদের সরকারী ভাষ্যে লেনিনের দার্শনিক ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল মূলত বস্তুবাদী হিসেবে, এবং তার মানদণ্ড হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল Materialism and Empirio-criticism বইটিকে। কিন্তু নিছক বস্তুবাদ নয়, আত্মনেতির মাধ্যমে স্বয়ম্ভু চেতনা যে চলমান দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াকে উন্মোচিত করে, তার তাত্ত্বিক ও দার্শনিক গুরুত্ত্ব লেনিন চিহ্নিত করেছিলেন দার্শনিক নোটবইতে। – এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত দার্শনিক লুই আলথুসের হাজির করলেন ১৯৬৯ সালে। "
এই বিষয়ের প্রাসঙ্গিক একটি উক্তি, যা PN -এ রয়েছে এবং যেটি প্রবলভাবে বিতর্কিত, সেটি হচ্ছে - "নির্বোধ বস্তুবাদের তুলনায় বোধশক্তিসম্পন্ন ভাববাদই বোধশক্তিসম্পন্ন বস্তুবাদের অনেক কাছাকাছি মত।" ( Intelligent Idealism is closer to Intelligent Materialism than Stupid Materialism")। এই বিশেষ উক্তিটি কে নিয়েই (প্রধানত) পরবর্তীকালে লেনিনকে ভাববাদী হিসেবে চিহ্নিত করার অসফল প্রচেষ্টা হয়েছিল। যদিও এ বিষয়ে আমরা এখানে আলোচনায় এগোব না। অন্যত্র আলোচনার ইচ্ছে রইলো এই চমকপ্রদ বিষয়টি নিয়ে।
তবে দার্শনিক নোটবই সঠিক ধারণা এবং জ্ঞান গড়ে তোলায় বিষয়ীর পক্ষে যে লড়াই, বা প্রচেষ্টা অপরিহার্য সে বিষয়ে দিশা দেয়। এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য আমরা মরিস কর্নফফোর্থের কাছেও ঋণী। লেনিনের এই ধারণাগুলির আরো উন্নতিসাধন করেন মাও সে তুং। মাও সে তুং মানুষের জ্ঞানার্জনের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা, প্রাথমিক ধারণা, সৃজনশীল অনুমান, প্রয়োগ, সামান্যীকরণ (generalisation), এবং বিমূর্তকরণ (abstractions) - এসবের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়সাক্ষর – নির্ভর প্রাথমিক ধারণা কিভাবে পূর্ণতা পায়, কিভাবে সেই প্রথম ধারণাগুলো ক্রমশই সঠিক জ্ঞানের অভিমুখী হয় --এটিকে আরো সুনির্দিষ্টকরণ করেন।
আর এইভাবেই লেনিন রচিত PN হয়ে উঠেছে এযুগের, বিশেষভাবে আধুনিকতম post-truth আর popular - politics জাত আবেগ – প্রধান এবং অযৌক্তিক মতাদর্শগুলির বিরোধিতার অস্ত্র।