- নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর কোন মানুষই খুব বেশি ভালোবাসতে পারে না অন্য কাউকে। দেশ নয়, জাতি নয়, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন এমন কী মা-ছেলে, বাবা-মেয়ে; পৃথিবীর সব সম্পর্ক যতটা উপর উপর মাখামাখি দেখা যায়; ভিতরে ততোটা গভীর নয়। সবটাই মিথ্যে। সবটাই সাজানো, নকল। আসলে প্রতিটি মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে। আর সে তার এই নিজের ভালোবাসার ইমারতটা গড়ে তোলার প্রয়োজনে ভালোবাসে পৃথিবীকে। মাটি না পেলে শূন্যেতো আর ঘর গড়া যায় না।
আমি বললাম, আপনি জানেন কত ভালোবাসা আজীবন আমাদের মনের কোণে কল্পনাতেই বেঁচে থাকে। ভার্চুয়াল লাভ যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।
অরিত্র মুখ বেঁকাল, ওসব কবি সাহিত্যিক ফিল্মমেকার দের হয়। আম লোকের অতো সময় নেই।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমাকে উপহাস করলেন তাইতো?
অরিত্র স্বাভাবিক ভাবেই বলল, যা বাস্তব, যা জীবন দিয়ে বুঝেছি তাই বললাম।
আমি মুখের হাসি অম্লান রেখেই বললাম, কি বুঝেছেন। বলুন শুনি।
অরিত্রর মধ্যে ভালোবাসা শব্দটার প্রতি বিন্দু মাত্র কোন কোমলতা নেই। ও আগের মতই একই ভাবে বলল, বললামতো। সব মিথ্যে সাজানো। আমরা আমাদের প্রয়োজনে পৃথিবীর কিছু মানুষের সাথে সামাজিক ভাবে কিছু সম্পর্কে যুক্ত হই। যেমন আমাদের সেফটি সিকিউরিটি রিলাক্সেশন এর জন্য আদিম গুহামানব গৃহ নির্মাণ করেছিল। তেমনি পশুদের মত হারেম থেকে হারামিগুলো সংসার নামক এই সংসাজার নাট্যশালাটি এক একটা সম্পর্কের ইঁট দিয়ে পরিকল্পনা মাফিক প্রয়োজন মেটাতে গড়ে তোলে। আর এই ইঁট গুলোকে যে সিমেন্ট দিয়ে পরস্পর পরস্পরের সাথে জুড়ে রেখেছে তাকেই ভালোবাসা নাম দিয়ে চালাচ্ছে।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আর এই সিমেন্ট বস্তুটির স্যাংটিটি সম্পর্কে আপনার মনে সন্দেহ আছে?
অরিত্র সংক্ষেপে বলল, - ঘোরতর।
আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম, - কিন্তু অরিত্র আপনি স্বীকার করেন আর নাই করেন, পৃথিবী যেমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বলে আমাদের কে টেনে রেখেছে, আমরা পৃথিবী থেকে ছিটকে অন্তরীক্ষে হারিয়ে যাচ্ছি না। তেমনি ফেবিকলের অটুট বন্ধন ভালোবাসা সংসারে আমাদের আবদ্ধ করে রাখেনি কি?
অরিত্র আরো বেশি এক্সাইটেড হয়ে পড়ল। - Love is a lie. It's totally fake. Just a way to fulfill our expectations. আমাদের প্রত্যাশা গুলো পূর্ণ করার একটা উপায় মাত্র। সোনাগাছির বেশ্যা যেমন তার বাবুকে ঘরে ঢুকাচ্ছে; কারণ তার কিছু অর্থনৈতিক চাহিদা আছে যা ওই বাবুটি ফুলফিল করবে। বাবুর physical needs আছে যা ওই বেশ্যাটা পূরণ করবে। Same সেই একই লোকটা যখন বাড়ির বউ এর সাথে শুচ্ছে; বাড়ির বউ ও তাকে বেশ্যার মতো allow করছে! Basic cause টা কি তার আর বেশ্যার আলাদা? মোটেই নয়। তবে যে একই কারণে বাড়ির বউ ও বেশ্যা অনিচ্ছা থাকলেও লোকটাকে বিছানায় সুযোগ দিচ্ছে; বেশ্যার বেলায় গর্হিত আর বাড়ির বউয়ের বেলায় পবিত্রতায় তা ঝলমলে হয়ে উঠছে কোন প্রাতিষ্ঠানিক বলে? বাড়ির বউটিও যখন economic freedom পাবে; তার ভাত কাপড় সে নিজেই জোগাড় করতে পারবে; দেখবেন বিছানা সঙ্গী হিসাবে খুঁজে নেবে Better Performance than her Husband.
আমার মাথাটা যেন টিমটিমে ব্যথা করতে লাগল; গা বমি বমি ভাব। আমি মাথার পেছনে দুটি হাত প্রসারিত করে মাথাটাকে তার ওপর একটু হেলিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। অরিত্রর মতো এভাবে ভাবতে শুরু করলে মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। তবুও নুহ্যমান মাথাটা আর একবার খাড়া করে বলতে সচেষ্ট হলাম। - অরিত্র পৃথিবীতে সুন্দর বলে কি কিছুই নেই? পবিত্র বলে কি কোন কিছুই হয় না? পদ্ম কিংবা গোলাপের বিকশিত হওয়ার পেছনে কাদা আছে কাঁটা আছে; কিন্তু আপনি কি তাদের সৌন্দর্য কে অস্বীকার করতে পারেন!
অরিত্র বলল, - আমি রাজহাঁস বা পরমহংস নোই। যারা জল থেকে দুধ আলাদা করে খেতে পারে তারা এসব কথার উত্তর দিতে পারবে। আমার কাছে সবকিছুই ভেজাল। খাদ ছাড়া সোনার গয়না হয় না। খাদ টা বাদ দিয়ে সোনার আংটিটা বিশ্বাস করলে একটি মিথ্যাকে গ্রহণ করব। যত বেশি ডিজাইন ততো বেশি খাদ। নিরেট সোনা দিয়ে যেমন ডিজাইন হয় না তেমনি মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বও কখনোই নিরেট সততা, নৈতিকতা, পবিত্রতা, স্বচ্ছতা ভালোবাসার ভাবমূর্তি নয়। সব কিছু কম বেশি মেলানো মেশানো থাকে। জানেন তো মানুষের শরীরে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার বাস।
অরিত্র রায় পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। সুদর্শন সুপুরুষ বাঙালি বলতে যা বোঝায়; তিনি তাই। লুকটা অনেকটা প্রদীপ কুমার এর মতো। একবার দেখলেই চোখ আটকে যাবে। চোখ ফেরানো মুশকিল।ব য়স ত্রিশ বত্রিশ এর কাছাকাছি। মুম্বাই থেকে ফেরার পথে ট্রেনে আমার অরিত্রর সাথে পরিচয়। কিন্তু পরিচয় দীর্ঘ দিনের না হলেও অরিত্র খোলা মেলা কথা বলতে সময় নেয়নি আমার সাথে। তার বড় কারণ বোধহয় আমি অরিত্রর থেকে বড় হলেও বয়সের ব্যবধানটা খুব বেশি নয়। আমি মুম্বাই গেছিলাম একটা কর্পোরেট হাউসের সাথে কথা বলতে। তারা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে আমার "দেবী চৌধুরানী"-র চিত্রনাট্যটি শুনেছে। পছন্দ। তবে কয়েকটি বাণিজ্যিক শর্ত রয়েছে তাদের। আর দশটা প্রযোজকের যে সাধারণ শর্তগুলো থাকে। তার বাইরে কিছু নয়। তবে আর দশটা বাঙালি পরিচালকের মতো আমার ক্রিয়েটিভ তাগিদ এই চাপের কাছে মাথা নত করে বসবে কিনা; সেটাই এখন প্যারাডক্স হয়ে উঠেছে। প্রযোজক সংস্থা চায় নায়িকা মুম্বাই থেকেই নিতে হবে। তবে আমি হিরো নতুন কাউকে introduce করার কথা ভাবছি। কারণটা আপনারা সকলেই বুঝতে পারছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরানী নায়িকা নির্ভর কাহিনী। এখানে হেভি-ওয়েট হিরো নিয়ে বাজেটকে ভারাক্রান্ত করার কোন মানেই হয় না। বরং সেই টাকাটা অন্য ক্ষেত্রে লাগালে কাজে দেবে। ভালো একজন কোরিওগ্রাফার ভালো একজন ডিওপি বা director of photography ধরতে পারলে বরং ছবিটা আরো খুলে যাবে। তা অরিত্র কে আমি যখন আমার কম্পার্টমেন্টে আবিষ্কার করলাম; প্রথম দেখাতেই আমার মনে হয়েছে আমি ব্রজেশ্বর পেয়ে গেছি। অরিত্রের লুকে দেবী চৌধুরানীর নায়কের যে বাঙালি softness আমি খুঁজছি তা চূড়ান্তভাবে রয়েছে। উল্লেখ্য; দেবী চৌধুরানী ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়।পরবর্তীকালে সুবোধ চন্দ্র মিত্র এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। একটা historical, periodical drama র ক্ষেত্র সময় টাকে তুলে ধরতে location, costume, seat setting, furniture এর মতো character য়েও বিশেষ details এর খেয়াল রাখতে হয়। অরিত্রর ভেতরের কাটখোট্টা দর্শনটার সাথে ব্রজেশ্বর চরিত্রটি না গেলেও; বাইরের জমিদার সুলভ সফিস্টিকেশনটার সাথে একটা বিনম্রতার মার্জিত ভাব রয়েছে যা ব্রজেশ্বর চরিত্রটির সাথে খুব সুন্দর মানিয়ে যাবে বলেই মনে হয়। ১৯৪৯ সালের ২৯ এপ্রিল দেবী চৌধুরানী নামে প্রথম একটি বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। এতে প্রফুল্ল বা দেবী চৌধুরানীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুমিত্রা দেবী এবং ব্রজেশ্বরের ভূমিকায় ছিলেন প্রদীপ কুমার। ১৯৬৬ সালের সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র নায়ক-এর প্লটে একটি কাহিনী রয়েছে; যেখানে দেবী চৌধুরানী অভিনয়ের সময় ব্রজেশ্বরের বাবা হরবল্লভের ভূমিকায় একজন সিনিয়র অভিনেতাকে নায়ককের ভূমিকায় অভিনেতা উত্তম কুমার কে ধমক দিতে দেখা যায়। ১৯৭৪ সালে মুক্তিপায় দীনেন গুপ্ত পরিচালিত দেবী চৌধুরানী। এই সিনেমায় দেবী চৌধুরানী প্রধান চরিত্রে রয়েছেন সুচিত্রা সেন, ব্রজেশ্বর চরিত্রে রঞ্জিত মল্লিক। এছাড়াও হরবল্লভ চরিত্রে কালী ব্যানার্জী, ভবানী পাঠকের চরিত্রে বসন্ত চৌধুরী অভিনয় করেন। অরিত্রর চেহারাটা রঞ্জিত বাবুর মতো না হলেও প্রদীপ বাবুর মতো অনেক অংশে বলা যায়। শোনা যায় সত্যজিৎ রায় নাকি এক প্রযোজকের সাথে সুচিত্রা সেনের কাছে প্রথম দেবী চৌধুরানী-র অফার নিয়ে গেছিলেন। শর্ত ছিল তার ছবির শুটিং চলাকালীন সুচিত্রা সেন অন্য কোন ছবিতে কাজ করতে পারবেন না। এক খাপে দুই তরোয়াল থাকতে পারে না, আর তাই বোধহয় ছবিটা শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আমি দুম করে অরিত্র কে একটা প্রশ্ন করলাম, - আচ্ছা অরিত্র আপনার প্রেমিকা আছে?
অরিত্র বলল, - হ্যাঁ। But I don't believe in love. Only physical relations.
একটি সাফারি হার্ড সাইডেড ট্রলি স্যুটকেসের ভেতর থেকে একটা রামের বোতল বার করে অরিত্র আমার উদ্দেশ্যে বলল, চলবে? আমি বললাম, No thanks.
অরিত্র বলল, সেকি মশাই সিনেমা বানান আর মদ, মাংস, মেয়েছেলে না ছুঁলে হবে।
আপার বার্থে যে মাড়োয়ারি ভদ্রলোকটি এতক্ষণ ঝিমোচ্ছিলেন, বড় বড় চোখ পাকিয়ে বললেন, - এসব এখানে allow না আছে। টিটি পাকড়াও করলে ফাইন করবে।
অরিত্র বেপরোয়ার মত খিস্তি করে বলল, Fuck the TT. ঢক ঢক করে জল ছাড়া দুই ঢোঁক রাম বোতল থেকে সরাসরি গলায় ঢেলে মাড়োয়ারি বাবুটির দিকে চেয়ে ইশারায় বলল, - চলবে নাকি?
মাড়োয়ারি ভদ্রলোকটি এতক্ষণ অরিত্রর দিকে বড় বড় চোখে চেয়েই ছিল। মনে মনে মনে হলো সেও প্রসাদ প্রত্যাশা করেছিল। একগাল হেসে রাম ভক্ত হনুমান বললেন, - দেন গলাটা একটু ভিজিয়ে নিই। অরিত্রর মুখ বড় খারাপ। বলল, গলা তলা সব ভিজিয়ে নিন।
অরিত্র ভদ্রলোকের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মদ্যপান করলো কেবল নয়, বড়বাজারে ভদ্রলোকের কারবার আছে শুনে নিজের visiting card ও তাকে দিল। আমার মনে হচ্ছিল সত্যজিৎ রায়ের নায়ক সিনেমায় উত্তম কুমারের মদ্যপানের দৃশ্যটি Censor Board ছেড়ে দিল কিভাবে। যদি সিনেমায় ধর্ষণের দৃশ্য ধর্ষণ কেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে, চলন্ত রেল গাড়িতে মদ্যপানের দৃশ্য নিশ্চয় তবে মদ্য পান কে promote করছে। আমাদের Censor Board এখনো নেহাতই শিশু। নাবালকত্বে ভুগছে। সে কথা মনে হওয়ায় আমার যখন হাসি পাচ্ছে অরিত্র আমার পাশে এসে বসলো। মাড়োয়ারি লোকটা আউট। সে এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
অরিত্র আবার আমার উদ্দেশ্যে বলল, আপনি মশাই একেবারেই innocent। আপনার তো গেরুয়া ধারণ করে হিমালয়ে থাকা উচিৎ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন মদ খেলাম না বলে? একেবারে ছুঁই না তা নয়। occasionally খাই। ট্রেনে খেলাম না এই কাজ টি এখানে নিষিদ্ধ বলে।
অরিত্র স্বাভাবিক সাবলীল ভঙ্গিতে বলল, পৃথিবীতে যত নিষিদ্ধ বস্তু রয়েছে তার প্রতি মানুষের ঝোঁক ততো বেশি।
অরিত্রর কথাটি শুনে আমার পেছনে ফেলে আসা এসপিএস এন্টারটেইনমেন্ট এর মিস্টার ভাটিয়ার সাথে হওয়া হোটেল তাজ ল্যান্ড এর কথা গুলো মনে পড়ে গেল। ভাটিয়া বলেছে, - মানুষের অবদমিত কামনা বাসনা গুলো কে সফল করে পেতে মানুষ সিনেমা দেখতে আসে আর সেটাকেই পুঁজি করে নিয়ে একটা সিনেমা বক্স অফিস হিট করে। নায়িকাকে দেখলেই দর্শকের টং করে দাঁড়িয়ে যাবে। এমনটা। দেবী চৌধুরানী কে বিকিনি পরিয়ে সমুদ্র পাড়ে নাচ করান। দেখবেন ছবি কেমন রমরম করে চলে।
আমি চোখ কপালে তুলে বলেছি; দেবী চৌধুরানী বিকিনিতে নাচবে?
ভদ্রলোক আরো জোরের সাথে বলেছেন, - আলবৎ নাচবে।
আমি হতাশ হয়ে ম্লান মুখে বলেছি, - কিন্তু তাতো কাহিনীর সাথে যায় না।
ভদ্রলোক বললেন, - কেন যাবেনা? দেবী চৌধুরানী ডাকু রানী বজরায় চরে ঘুরতে পারেন আর জলে নেমে দলবল নিয়ে একটু জলকেলি নাচা গানা করতে পারবে না। আচ্ছা বিকিনি না পরলে ফিনফিনে একটা গামছা পরিয়ে দিন। তারপর গঙ্গায় দো চার ডুবকি লাগাতে বলুন। রাম তেরি গঙ্গা মেইলি। ট্রান্সপারেন্ট বুক, পাছা সব দেখা যাবে। দেখবেন হলে সিটি বাজবে; পয়সা পড়বে।
আমি আরো কিছুটা ইতস্তত করে বললাম, - হল কনসেপ্টটা এখনতো বদলে যাচ্ছে। এখন টিভি, মোবাইল, ওটিটি ফ্যামিলি দর্শকদের কথা মাথায় রেখে সিনেমা বানানো উচিত নয় কি? তাছাড়া প্রফুল্ল বা দেবী চৌধুরানীর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য আমি যাদের কথা ভাবছি মাধুরী, বা ঐশ্বর্য এরা প্রত্যেকেই middle age। খোলামেলা পোশাক বা দৃশ্যে আদৌ কি তাদের মানাবে?
ভাটিয়া চোখ বড় বড় করে বললেন, - দেখেন পয়সা-লাগাব একটা potentiality তো থাকতে হবে। মসলা ছাড়া ফিল্ম চলেনা। ব্যবসার প্রয়োজনে আপনাকে তা করতে হবে। প্রয়োজন হলে নায়িকার Breast Augment; Silicon Breast Implant করান। ঝুলে যাওয়া মাই দেখবেন আবার ঘাই মারবে। ঘায়েল করবে ....
কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় আমি একা একাই হাসছিলাম।
অরিত্র বলল, - আপনি হাসছেন যে বড়।
আমি বললাম, - আচ্ছা অরিত্র। যৌনতার ব্যাপারে আপনি খুব খোলামেলা মনের। তাইতো?
অরিত্র চানাচুর খাচ্ছিল। আমার দিকে চানাচুরের ঠোঙাটা এগিয়ে দিতে দিতে অরিত্র বলল, - খোলামেলা কিনা জানিনা তবে প্রেম সেক্স এসব ব্যপারে আমার কোন typical feudal middle class mentality নেই। খাওয়া হাগা ঘুম-এর মত জীবনের জৈবিক প্রক্রিয়া গুলো যে নিয়মে ঘটে সেই একই ভাবে প্রেম পায়, সেক্স পায়। আমি জানি আমার প্রেমিকা আমার থেকে কোনো better opportunity কোথাও পেলে ছাড়বে না। আমিও ছাড়ি না। যেখানে সুযোগ পাই হাত মারি। এইতো ট্রেনেতেই একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেবার সুরাট থেকে ফিরছিলাম কলকাতা; এই আপনার মতই মাঝ বয়সী একজন মহিলার সাথে ট্রেনে পরিচয় হল। এরকমই ফাঁকা কম্পার্টমেন্ট। গল্প জুড়ে দিলাম। কয়েকটি nasty nasty jokes মারছিলাম। আর বৌদিটা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছিল। আমার থাইয়ের ওপর কয়েকবার চাপড় মারল। প্যান্টের চেনের উপর হাত ঠেকিয়ে দিল কয়েকবার। এসব appeal আমি বুঝি। এই সুযোগ কে ছাড়ে বলুন। একেবারে ঘপাৎ করে চেপে ধরলাম। মাইটাই টিপে ঠাণ্ডা করে দিলাম।
হাতের চানাচুর শেষ করে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আমি বললাম, - সেক্স নিয়ে আপনার কোনো বাছবিচার নির্বাচন নেই?
অরিত্রর দাঁতের ফাঁকে চানাচুরের কারিপাতা বোধয় আটকে গিয়েছিল। দাঁতের ফাঁক থেকে সেটা বের করে ফেলতে ফেলতে অরিত্র বলল, - এই যে আপনি বাইরে বেরিয়েছেন। খিদে পেলে খাবেন তো? নাকি উপোশ করে থাকবেন? কখন কলকাতায় পৌঁছবেন, বাড়ি পৌঁছে খাবেন। আমি স্যার উপোশ করতে পারবো না। খিদে পেলে খাব। সে ফুটের খাবার হোক বা রেলের খাবার। কোন ছুৎমার্গ নেই। Physical needs. ভালোবাসা তো কেবল একটা ছুতো। আমি ভণ্ডামি করতে পারবো না। সরাসরি বলে দেব আমার বাই উঠেছে লাগবে।
অরিত্রর কথাগুলো শুনতে শুনতে ওকে অভিনয়ের proposal টা দেব কি দেব না ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললাম। - অরিত্র আপনার get-up টা আমার সিনেমায় কাজে লাগাতে দেবেন?
অরিত্র গম্ভীর হয়ে বলল, - অভিনয়?
আমি বললাম, হ্যাঁ। দেবী চৌধুরানী Main lead male টা। ব্রজেশ্বর।
ভেবেছিলাম হিরোর ভূমিকা শুনলে অরিত্রর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। সে উৎসাহিত হবে সিনেমাটি নিয়ে। কিন্তু অরিত্রর তেমন কোন ভাবান্তর ঘটলো না। সে গম্ভীর থেকে আরো গম্ভীরতর হয়ে বলল, - I hate films। ফিল্ম লাইন টাকে আমি ঘৃণা করি।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, - কিন্তু কেন? জানতে পারি?
অরিত্র বলল, সে অনেক কথা।
আমরা সম্ভবত বিলাসপুর ছত্তিসগড়ে। ঝমঝম করে যন্ত্র দানবটি কলকাতার দিকে এগিয়ে চলেছে। এসি কামরায় হঠাৎ করে আমার গরম লাগতে শুরু করে। অরিত্রর গল্প শুনতে শুনতে আমার যেন দম আটকে আসতে শুরু করল। My mother is a famous serial actress। আশি নব্বই-এর দশকে বাংলা সিনেমায় মা বা বৌদির চরিত্র তাকে ছাড়া ভাবা যেত না। আমি খুব ছোট থেকে মায়ের সাথে স্টুডিও পাড়ায় যেতাম। টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়াটা আমার হাতের তালুর মতো চেনা। সিনেমা জগতটা আমার নখদর্পণে।
আমি কৌতূহলের সাথে জানতে চাইলাম, - কি নাম আপনার মায়ের?
অরিত্র বললেন, - সরি। আমি নামটা বলতে চাই না।
আমি জোরাজুরি না করে বললাম, - আপনার বাবা কি করেন অরিত্র?
উত্তরে অরিত্র বলল। বাবা sick। এখন আর কিছু করেন না। বাড়িতে থাকেন।
আমি বললাম, - আপনাদের সাথে? মানে আপনার মা আর আপনার সাথে?
অরিত্র সংক্ষেপে বলল, হ্যাঁ। তাছাড়া অন্য কোথাও থাকার তার আর সে সামর্থ্য নেই।
আমি অরিত্রর ব্যাপারে আরো কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। এমনিতেই একজন গল্পকার, চিত্রনাট্যকার, ফিল্ম নির্মাতার সব ব্যাপারে কৌতূহল আমার মনে হয় আর দশজনের থেকে অনেক অনেক বেশি। অরিত্রর কাছে তার পরিবারের কথা আরো কিছু জানতে চাওয়া ঠিক হবে কী? অরিত্র আমাকে তার পরিবারের কথা অধিক কিছু জানাবে কী? আমি আদৌ এসব চিন্তা ভাবনা না করে অরিত্রর কাছে জানতে চাইলাম। - আপনার বাবা কি এক সময় আকাশবাণী কলকাতায় খবর পড়তেন? থিয়েটার অভিনেতা ছিলেন? সেখান থেকে বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে তিনি নায়ক হিসাবে কাজ করেছেন। তাইতো? ঠিক বলছি তো?
অরিত্র বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ওর চুপ করে থাকাই যেন আমাকে বলে দিচ্ছিল আমার অনুমান সম্পূর্ণ সঠিক। তার মা শ্রীরাধা রায় আর বাবা স্বরাজ রায়। স্বরাজ বাবুর এক সময় যেমন সুদর্শন চেহারা ছিল তেমনি ছিল মোহময় কণ্ঠস্বর। বেশ কিছুক্ষণ অরিত্রকে চুপকরে থাকতে দেখে আমি বললাম, আপনার বাবা কিন্তু যথেষ্ট সম্ভাবনাময় অভিনেতা ছিলেন! কিন্তু কেন জানি না হারিয়ে গেলেন।
অরিত্রর চুপ করে থাকার কারণটা এতক্ষণে বুঝলাম। সেটা আসলে ভেতরে ভেতরে গুমরে থাকা। বহুক্ষণ বুকে গরম লাভা চেপে রাখা আগ্নেয়গিরির মতো অরিত্র burst out হলো। - মদ খেয়ে খেয়ে লোকটা নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। এখন হেগে মুতে ছড়াচ্ছে। বাবাকে নিয়ে কাজ করার জন্য; বাংলার তাবড় তাবড় প্রথম সারির পরিচালকেরা শুনেছি আমাদের বাড়ির সামনে লাইন দিয়ে থাকত। কী হলো? নিজেও মরেছে শালা আমাদেরও মেরেছে। এই আমার চোখের সামনে দেখেছি একটা সুন্দর সাজানো গোছানো সংসার কে ছন্ন-ছাড়া হয়ে যেতে। মা-তো প্রথমটা সিনেমায় নামতে চায়নি। বাবার যখন কাজ নেই সংসার চলছে না, আমার স্কুলে যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার দশা, তখন বাধ্য হয়েই..... কী করবে! মা-রতো আর কোন লাইন জানা ছিলনা। আর কয়েকজন ওৎ পেতে ছিল সুযোগের সৎ ব্যবহার করবে বলে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কারা? প্রযোজক না পরিচালক?
অরিত্র বলল, - প্রযোজক ও নয়, পরিচালক ও নয়। বাবার বন্ধু। তিন জন অভিনেতা। দুজন ভারতীয় আরেকজন বাংলাদেশী। বাড়িতে এসে জপাত বৌদি চলো চলো; তোমাকে দেখতে ভালো। থিয়েটার করেছ। অভিনয়টা আমরা তো জানি তুমি খারাপ করোনা। লেগে থাকলে তোমার ফিল্ম লাইনে হবে।
আমি বললাম, - ফিল্মে অভিনয় করা নিয়ে আপনার বাবার সম্মতি ছিল?
আবার বাবার কথা তোলায় অরিত্রর বিরক্তি প্রকাশ পেল। - ঠুঁটো জগন্নাথ লোক। তার আবার সম্মতি অসম্মতির কেউ পরোয়া করে নাকি। তার তখন আর কোন মুরোদ নেই। ঘরের জিনিসপত্র মায়ের গয়না বেচে মদ খেত। আর দিতে না চাইলে মারধর করতো। তার কাছে বউ অভিনয় করে, না শরীর বেচে টাকা রোজগার করছে এসব কিছু যায় আসে না।
আমি সংকোচের সাথেই বললাম, আপনার মায়ের উত্থানের পেছনে এই তিনজন অভিনেতার ভূমিকার কথা আপনি যে বলছেন, তাদের নাম গুলো কি আমি জানতে পারি?
পূর্বের ন্যায় অরিত্রের চোখে মুখে বিরক্তি অব্যাহত ছিল।অরিত্র বলল, - উত্থান?না পতন?
আমি বললাম, - পতন কেন হবে! আপনার মা তো আপনার বাবার চেয়ে বেশি ছবিতে কাজ করেছেন। এখনো জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের মধ্যে উনি একজন ।
অরিত্র বলল, হ্যাঁ… জনপ্রিয়তা টাকা পয়সা কিছু পেয়েছে বটে। তবে তার থেকেও হারিয়েছে অনেক বেশি কিছু। ওই তিনটে লোক দিনের পর দিন আমার মা কে ভোগ করতো।
অরিত্র excited হয়ে উঠছে আবার। নেশাটাও চড়েছে কিছুটা মনে হলো। মাঝে মাঝে কিছু কথা জড়িয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু দম দেওয়া পুতুলের মতো অরিত্র একাই বকবক করে চলল।
- শুভঙ্কর দে স্টুডিও ফ্লোরের মধ্যেই মায়ের নাভির কাপড় সরিয়ে দিত। সে সব অবাঞ্ছিত দৃশ্য এডিটে ছেঁটে ফেলা হত তাই সিনেমায় মেলে না। সুবিমল লাহিড়ী বাড়িতে ঘনঘন আসতো আর সুযোগ পেলেই মা কে জড়িয়ে ধরত। প্রথমটা মা আপত্তি করতো বটে। বলতো এসব কী হচ্ছে ঠাকুরপো। পরে মেনে নিয়েছিল। তাদের জন্য যদি দুটো কাজ পায়, বিনিময়ে তারা তো কিছু আবদার করবেই। আর ওই শালা বাংলাদেশের সালামগীর। ওই শুয়োরের বাচ্চাটা ইন্ডিয়াতে আসতো মায়ের টানে। প্রতিটা ছবিতে মাকে ওর চাই। আউটডোরে রাতের বেলা হোটেলে আমাদের রুমে এসে ঢুকত। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে থেকেছি কতদিন জানেন। একদিন দেখি মা কে Naked করে বুক দুটো তে দই মাখিয়ে কুত্তার মত চাটছে। কি বলতো জানেন; বলতো ডিয়ার অফ-স্ক্রিন আমাদের রিলেশন যত ভালো হবে; অন-স্ক্রিনে আমাদের কেমিস্ট্রি ততো জমে যাবে। প্রতিটা ছবিতে মাকে শুয়োরটা বউ এর রোল-দিত মাই খাবে বলে। একটু বড় হয়ে যেতেই মা আমাকে আর শুটিংয়ে সাথে নিত না। .....আমি ফিল্মের মাকে চু...
কাঁচা কাঁচা খিস্তি করতে করতে অরিত্র নিজের বার্থে গা এলিয়ে দিল। আমার মাথার ভেতরে সব তালগোল পাকিয়ে আবার সেই বমি বমি ভাব। অরিত্র এখন ঘুমাচ্ছে। রামের খালি বোতলটা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। জামার তলায় কোমরে গুঁজে প্রথমে দরজার কাছে গেলাম। বোতলটা লাইনে ফেলে বেসিনে চোখে মুখে কিছুটা জল ছিটালাম। নিজের বার্থে ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম বটে তবে কিছুতেই ঘুম এলো না।
আমার চোখ কিঞ্চিৎ লেগে গিয়েছিল ভোরের দিকে। অরিত্র আমার বার্থের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমায় ডাকদিল। - হাওড়া স্টেশন এসে গেল যে উঠে পড়ুন।
আমি চোখ খুলে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম।
অরিত্র বলল, গাড়ি আসবে না ট্যাক্সি? নাকি ওলা ধরবেন?
আমার গাড়ি বাড়ি কিছুই হয়নি। ফিল্ম লাইনে নিতান্ত একজন struggler। কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থাকি। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করি। আমি লাইম-লাইটে এখনো পৌঁছাতে পারিনি তাই কোন রকম অসুবিধা হয় না। এত কথা মনে মনে বললেও অরিত্রের উদ্দেশ্যে বললাম, - দেখি কি পাওয়া যায়। যা জুটবে তাতে চলে যাব। একা মানুষ তো, খুব একটা অসুবিধা হবে না।
অরিত্র বলল, আমাকে কোম্পানি ফ্লাইট দেয়। কিন্তু আমি নিই না, জানেন?
আমি বললাম, কেন?
অরিত্র বলল, আমায় এক জ্যোতিষী বলেছে উড়োজাহাজে ফাঁড়া আছে। তাই ওটা এড়িয়ে চলছি। Do you believe in astrology?
আমি বললাম, জ্যোতিষে আমি খুব একটা বিশ্বাস না করলেও ভাগ্যে ভীষণ রকম বিশ্বাস করি। মনে হয় সবকিছুই যেন আগে থেকে ঠিক করা আছে। আমি বলতে চাচ্ছি যে একটি সফটওয়্যারে আগে থেকে যেমন সবকিছু প্রোগ্রামিং করা থাকে অনেকটা সেরকম। একটি সিনেমার চিত্রনাট্যে যেমন ঘটনাক্রম গুলো পরস্পর পরস্পর সাজানো থাকে অনেকটা সেরকম। কোন কোন সময় প্রত্যাশিত ভাবে নায়ক নায়িকার মিলন হয়, কখনো বা অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে যায় অন্য কিছু। যাই ঘটুক তা ঠিক করে একজন ডিরেক্টর। মনে হয় আমাদের মাথার উপরে বসে এরকম কোন এক পরিচালক আমাদের হাসি কান্নার প্লট গুলো সাজাচ্ছেন। আর তা মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন গতি নেই। এই যেমন ধরুন ট্রেনটা হল্টে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুতেই স্টেশনে ঢুকছে না। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন, কিন্তু তাতে ট্রেনের কি! লাইন ক্লিয়ার না হলে, সময় না এলে সে স্টেশনে ঢুকবে না। যা হবার তা হবেই। যা হবার নয় কখনোই হবে না। হাজার চেষ্টা করলেও হবেনা। জানিনা দেবী চৌধুরানী হিন্দিতে মুম্বাইতে গিয়ে করতে পারব কিনা! কারণ ওরা যে সব শর্ত দিচ্ছে তাতে ছবিটা আর আমার মত হবে না। ওদের মত হয়ে যাবে। আসা যাওয়ার Air ticket, থাকা খাওয়ার খরচ সবটাই ওনারা দেবে বলেছিল। কিন্তু কথাবলে যুতসই মনে হলো না। তাই ফেরার ভাড়াটা রিফিউস করে-দিয়েছি। নিজের গাঁটের পয়সায় ট্রেনে করে ফিরেছি বটে; তবে ট্রেনে ফেরার মজাই আলাদা, জানেন? ভারতবর্ষ কে দেখতে হলে এই ট্রেনে ট্রেনে ঘুরতে হবে। আর ট্রেনে না ফিরলে হয়তো আপনার সাথে দেখাই হতো না। ভাবছি ছবিটা হিন্দিতে নয় বাংলাতেই করব।
অরিত্র বলল, বেশ বাংলাতেই করুন। নিজের মতো করে করুন।
আমি এই সুযোগে আর একবার অরিত্র কে বললাম, বাংলায় করলে আপনি ব্রজেশ্বরের পার্টটা করবেন?
অরিত্র বলল, - আমি কিছুদিন চার্বাক-এ গ্রুপ থিয়েটার করেছিলাম বুঝলেন। ওটা আমার বাবা মার ইচ্ছেয়। প্যাশন ট্যাশন কিছু ছিল না। এই অভিনয়ের অপশনটা বাবা মা খোলা রাখতে চেয়েছিলেন। কোন কিছু হচ্ছে নাতো চলো অভিনয় করো। সিরিয়াল করলে ভাত কাপড়ের অন্তত জোগাড় হয়ে যাবে। তাওতো দেখছি রোজ নিত্য নতুন অভিনেতা অভিনেত্রী আত্মহত্যা করছেন!
আমি বললাম, - সেটার মূল কারণ হতাশা। আরো আরো প্রচারের আলোয় আসতে চেয়েও না পারা। এরা এমন সব অভিজাত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন যে পরে আর নিজেকে সাধারণ জীবনে মানিয়ে নিতে, সামলে নিতে পারছেন না। আমি লাইম-লাইট কে অত্যন্ত ভয় পাই, জানেন অরিত্র? সকলের অলক্ষ্যে নিজের কাজটা করে যেতে হবে। মাটিতে পা থাকাটা অত্যন্ত জরুরী। না হলে শূন্যে ঝুলতে হবে।
অরিত্র বলল, চোখের সামনে আমি আমার বাবা-মা কে আত্মহত্যা করতে দেখেছি। তিলে তিলে মদ খেয়ে বাবা শেষ করেছেন নিজেকে। And mother morally...
আমি বাধা দিলাম, থাক না এসব কথা।
অরিত্র বলল, - দেখুন আমি ক্যামেরার সামনে কোন দিন দাঁড়াইনি। আমার দ্বারা অভিনয় আদৌ সম্ভব কিনা আমি জানি না।
অরিত্রর কাছ থেকে একটি প্রচ্ছন্ন সম্মতি পেয়ে আমি তাকে আর কিছুটা কনফিডেন্স দেবার চেষ্টা করলাম। - সেটি আমার ওপরে ছেড়ে দিন না। আমি আপনাকে দিয়ে ঠিক অভিনয় করিয়ে নেব।
অরিত্র বলল, - তবে না হয় চেষ্টা করে দেখব।
ঠিক তখনি হল্টের স্থিরতা ভেঙ্গে গোঙাতে থাকা ট্রেনটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সিংহের মতো গর্জন করে অজগরের মতো প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে চলল। অরিত্র বলল, নামেই সুপার এক্সপ্রেস। আট ঘন্টা লেট। আর বগিগুলো দেখছেন সব আদ্যিকালের। নতুন বগির সাথে জুড়ে দিয়েছে। কাপলেট ম্যাচ করছে না। ওই কারণে এত ঝাঁকুনি হচ্ছে। জোরে চালালে যে কোন সময় উল্টে যেতে পারে।
আমার দৃঢ়ভাবে মনে হতে লাগল, মিউজিকের টিউন এর মতো দুটো মানুষেরও একসাথে জীবনযাপন কী একই সাথে কোন কাজ করতে গেলে কাপলেট ম্যাচ করাটা অত্যন্ত জরুরী।
ট্রেনের প্রবল গর্জন, মানুষ আর হকারের আর্তনাদের ভেতরেই হাওড়া স্টেশনে নেমে অরিত্র কে শেষ বিদায় জানাবার আগে আমি শেষবার বললাম, - আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি অভিনয়টা পারবেন করতে। আপনার রক্তে যে অভিনয় রয়েছে অরিত্র।
অরিত্রর নরম মুখটা আবার কঠিন হয়ে উঠতে লাগলো। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। অরিত্র আর একটিও কথা বলল না; তার সাফারি হার্ডসাইডেড ট্রলি স্যুটকেসটা টানতে টানতে হারিয়ে গেল হাওড়া স্টেশনের ভিড়ের ভেতরে।
যারা লাইম-লাইটে পৌঁছেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই মান সম্মান যশ খ্যাতি প্রভাব প্রতিপত্তির পেছনে একটা সাংঘাতিক চুরি, সাংঘাতিক দুর্নীতি, সাংঘাতিক নৈতিক স্খলন হয়তো আছে; চিরকাল ছিল। ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রদীপের তলায় যেমন অন্ধকার থাকলেও মানুষ দীপাবলির প্রদীপ জ্বালাতে ভুলে যায় না, তেমনি সিনেমার গ্ল্যামার, সৌন্দর্য, লাইম-লাইট এর পেছনে নগ্নতা, যৌনতা, কালোটাকা, অনৈতিকতা, ভ্রষ্টাচার, স্খলন যাই থাক না কেন - এর উদযাপন, এর মনন, এর উন্মোচনটাও কম কিসের! সেটাকে অস্বীকার করতে পারি না। সেটাকে অস্বীকার করলে এই বৃহত্তর শিল্প মাধ্যমটির ব্যাপ্তি প্রভাব সম্ভাবনা কে অস্বীকার করতে হবে।
হঠাৎ করে মনে পড়ল অরিত্রর ফোন নাম্বারটা নেওয়া হয়নি। আমার নাম্বারটাও দেওয়া হয়নি ওকে। তবে সত্যিই যদি দুজনার একসাথে কাজ করার থাকে; ঠিক আবার যোগাযোগ হয়ে যাবে। অন্তত অরিত্রকে খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বারবার মনে হতে লাগলো - Darwin's theory of evolution অনুসারে "Survival of the fittest"। প্রতিটি জীব বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। ক্ষিপ্রতার সাথে দ্রুততার সাথে শীর্ষে পৌঁছাতে তাকে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। যুদ্ধে আবার ন্যায়নীতি কী! বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ন্যায়নীতি, সততা, নৈতিকতা নিয়ে যদি আমরা ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো বসে থাকি আমাদের অবলুপ্তিও কালের ঘরে অনিবার্য। পরক্ষনেই মনে হলো পৃথিবীর জন্মের পর মুষ্টিমেয় যেসব প্রাণী এই গ্রহে অবাধে বিচরণ করতো তার মধ্যে সবচেয়ে সফল পরাক্রমশালী প্রাণীটি ডাইনোসর। প্রায় ১৪ কোটি বছর ধরে একক আধিপত্য বিস্তার করে পৃথিবীতে বেঁচেছিল। ডাইনোসরের জীবনে অন্য আরেকটি ডাইনোসর ছাড়া আর কোন হুমকি বা প্রাণনাশের সম্ভাবনা ছিল না। সেই পরাক্রমশালী ডাইনোসরও পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষতো কোন ছাড়। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে হঠাৎ করেই এমন একটি শক্তিধর প্রাণী একেবারে উধাও হয়ে গেল। এত শক্তিশালী একটি প্রাণী ডারউইন তত্ত্ব অনুসারে বাঁচতে পারল না। প্রলয়ঙ্করী কিছু ঘটনা ঘটে। ভূমিকম্প, সুনামি, দাবানল এর ফলে ছাই দিয়ে তৈরি মেঘ সূর্যকে ঢেকে ফেলে এবং এই গ্রহটি এক দশক কাল ধরে নিমজ্জিত থেকেছে অন্ধকারে। গ্রহাণু সংঘাতে পৃথিবীর যে স্থানে এই বিপর্যয় ঘটেছিল বর্তমানে সেটি মেক্সিকো দেশে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মহা-বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবী থেকে ৭৬ শতাংশ গাছপালা ও পশুপাখি হারিয়ে যায়। তবে যেসব প্রাণী এর মধ্যেও বেঁচে থাকতে পেরেছিল তাদের মধ্যে রয়েছে সাপ, কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ব্যাঙ এবং মাছ। এরা সকলেই কিন্তু সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ জীব ডাইনোসর এর থেকে কম প্রতিরক্ষা সম্পন্ন কম শক্তিশালী। ভাবা যায়, সেই ডাইনোসরদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বেঁচে রয়েছে কিছু প্রাণী প্রজাতি! কল্পনা নয়, সত্যিকার এমন ভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেঁচে আছে গভীর সমুদ্রের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। কুমির সদৃশ মাছ অ্যালিগেটর গার, প্রাগৈতিহাসিক হ্যাগফিশ, ল্যান্সেটফিশ, অ্যারাপাইমা, বাউফিন, করাত মাছ বা স’ফিশ, ড্রাগন ফিশ, কুঁজিত হাঙ্গর বা ফ্রিল্ড শার্ক, স্টারজিওন, কেওলাক্ষা, অপদেবতা হাঙ্গর বা গবলিন শার্ক, বানমাছ বা ডাইনোসর ইল প্রভৃতি বিভিন্ন প্রজাতির সর্বসহা মাছ সমুদ্র গহ্বরে শত শত কোটি বছর সেই ডাইনোসরদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বেঁচে রয়েছে! আমাদের প্রত্যেকের ঘরে কিছু না কিছু আরশোলা আছে। দেওয়ালের গায়ে নিমেষে টিকটিকির শিকার হতে আরশোলাকে আমরা কে দেখিনি? একটা আরশোলার প্রতিরক্ষার বা survive করার ক্ষমতা কতটুকু! ডারউইন তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হলেও কোটি কোটি বছর ধরে টিকে রয়েছে আরশোলা। রাখে হরি তো মারে কে। কৌশল, কূটনীতি বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রতি পদে পদে যে আয়োজন এসব দেখে আমি ক্লান্ত হই। আমি আমার কাজের ব্যাপারে কিছুটা নিষ্ঠাবান, কিছুটা আত্মবিশ্বাসী। এর বেশি আমার দ্বারা হবে না। টিকলে টিকবো, মরলে মরবো ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানটাকে খোয়াতে আমি রাজি নই।
হিন্দি সিনেমার বৃহৎ ডাইনোসর এর মতো বাজার ছেড়ে আঞ্চলিক ক্ষুদ্র আরশোলার মতো বাজারে আমার আর্ট আমার সিনেমা না হয় আরশোলার মতোই টিকে থাকার চেষ্টা করবে।
কেবল সিনেমা প্রফেশন? অন্যান্য পেশাতেও প্রতিযোগিতা আছে। প্রতিযোগিতা থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও থাকবে। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলে থাকবে দুর্নীতি ভ্রষ্টাচার টিকে থাকার লড়াই। Fight for survival! একজন সিনেমার নায়িকা, বাড়ির পরিচারিকা কিংবা অফিসের পিএ; এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ খুব বেশি আলাদা কিছু ব্যবহার তাদের সাথে করে না। একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং একশ দিনের কাজ থেকে পার্লামেন্টের টিকিট পাওয়ার পেছনে রয়েছে। মানুষ আপস করে নিচ্ছে একটু স্বাচ্ছন্দ্য, একটু ভালো থাকার জন্য। এটা একটা প্রক্রিয়া। পৃথিবীর প্রতিটি জীব প্রতি মুহূর্তে এই বেঁচে থাকার লড়াইটা করছে। আমার মনে হতে লাগল অন্যান্য প্রাণীকুলের সাথে মানুষের লড়াই-এর তফাৎটা হলো মানুষ কেবল আজকের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার লড়াইটা করছে না। মানুষ ভবিষ্যতেও আজকের মতো দুধে ভাতে থাকার জন্য সঞ্চয়ের লড়াই লড়ছে। পশুদের যৌনতা কেবল প্রজননের জন্য। পশু যদি যৌনতার জন্য লড়ে সেটা তার টিকে থাকার অস্তিত্বের লড়াই। মানুষের ক্ষেত্রে যৌনতার লড়াই ভোগের লিপ্সা। এই ভোগের লিপ্সাই মানুষের লড়াই কে বহুমুখী করে তুলেছে। আমার বার বার মনে হচ্ছে মিস্টার ভাটিয়ার সাথে কোন রফাতেই আমার মন কখনো সায় দেয়নি। লাইম-লাইটে পৌঁছানোর জন্য আমি আমার শিল্পের সাথে কোন রকম আপোষ করবো না।
প্রদীপের তলার অন্ধকার এর মতো; প্রতিটি লাইম-লাইটে থাকা ঝাঁ চকচকে ব্যক্তিগুলোর এক একটি ব্যক্তিগত পাঁজা পাঁজা অন্ধকার ময় জীবন আছে। যে জীবন সম্বন্ধে বাকি সাধারণ মানুষের জানার অদম্য উৎসাহ রয়েছে বটে কিন্তু অন্ধকারের তৈলচিত্র সেই ডার্কনেস গভীর পাঁজা পাঁজা অন্ধকার তুলে ধরার ক্ষমতা সকল শিল্পীর থাকেনা বলেই মনে হয় আমার। আমাদের দেশের জীবন-কাহিনী বায়োপিক গুলো বড় সুচারু সাজানো গোছানো মিথ্যা দিয়ে ঠাসা হয়। না সত্যি বলার ক্ষমতা আছে আমাদের, না আছে সত্যি গ্রহণ করার। অথচ পৃথিবীতে একমাত্র যা যুগ যুগ অনন্তকাল বেঁচে থাকবে, survive করবে তা সত্যি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। আমাদের দেশের অভিনেতা, অভিনেত্রী, নেতা, নেত্রীদের যে ইমেজ জনসমক্ষে তৈরি হয়ে থাকে, যা কিঞ্চিৎ সংবাদমাধ্যম পত্র পত্রিকা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে দিনের পর দিন জনসমক্ষে পরিবেশন করেন, - সেই সব gossip, ব্যক্তিগত প্রেম সম্পর্ক, সম্পর্কের ভেঙ্গে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি মনগড়া গল্পের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে celebrity-দের জীবনের কৃষ্ণগহ্বরের চাইতেও প্রগাঢ় পাঁজা পাঁজা অন্ধকার। যা লাইম-লাইটের তীব্র আলোকেও নিমেষে গিলে খেয়ে নিতে পারে। সেই ব্ল্যাক-হোলের অন্ধকার কখনোই প্রকাশ্যে আসেনা। এলেও তা আবছা অস্পষ্ট।
চোখে মুখে সাবান মাখা অবস্থায় হাতের সাবান টা হাত থেকে পিছলে পড়ে যেতে, বাড়ি পৌঁছে স্নানের ঘরে শাওয়ার নিতে নিতে আমার আবার অরিত্রর মুখটা মনে পড়ে গেল। সেই দ্যোতনাটায় মনটা আবার টনটন করে উঠলো। আবার মনে হলো মুম্বাই আমার স্যুট করবে না। ওদের কাপলেট এর সাথে আমাদের কাপলেট ম্যাচ করে না। ফলে একশ শতাংশ চিৎপটাং হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সাবানের ফেনায় সামান্য জ্বালা করতে থাকা রাতজাগা বন্ধ চোখ দুটো এতক্ষণ অন্ধকারে ছিল। চোখখানা ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে হাতের থেকে ফসকে পড়ে যাওয়া সাবানটা আবার বাথরুমের ফ্লোর থেকে কুড়িয়ে নিলাম। হুঁ, মুম্বাই তে একটা ছবি করতে পারলে রাতারাতি প্রচারের আলোয় আসা যায় বটে, তবে কয়েক মুহূর্তের দৃষ্টিপটের বিঘ্ন কাটিয়ে অতঃপর মনে হচ্ছে পাঁজা পাঁজা অন্ধকার বুকে বয়ে বেড়ানো তার থেকে অনেক বেশি কষ্টকর। দরকার নেই আমার লাইম-লাইট।
*****