নজরুলের ধর্মচিন্তা, একই বৃন্তে দুটি কুসুম

লিখেছেন:জয়ন্ত দত্ত

 

নজরুল ইসলাম (ছবি - দ্য টেলিগ্রাফ)  

নজরুল সত্য ও সুন্দরের কবি। তিনি বলেছেন, "আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। … আমার বাণী সত্যের প্রবেশিকা, ভগবানের বাণী।"

কবি নজরুলের অন্তরে যে মানুষ নজরুল, তাঁর প্যাশন কি? তাঁর প্যাশন হিন্দু মুসলমানের ঐক্য। নজরুল তাঁর কবিতায়, গানে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে, ভাষণে, নিভৃত আলাপচারিতায় এত অজস্রবার এই ঐক্যের কথা, মিলনের কথা বলেছেন যেন মনে হয় এই বিষয়টি ছিল তাঁর সমগ্র সত্তা জুড়ে।

১৯২৯ এর ডিসেম্বরে এলবার্ট হলে নজরুলকে দেওয়া সম্বর্ধনা সভায় নজরুল বললেন "আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই আমি নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।"

"কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ওদুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। কেননা একজনের হাতে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে ছুরি।"

নজরুল গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন এই বাংলা এই ভারতবর্ষ মিলিত হিন্দু মুসলমানের মাতৃভূমি। তবে তাদের মধ্যে অপ্রেম কেন? তিনি নিজে এই অপ্রেমের শিকার হয়েছেন বারবার, উভয় সম্প্রদায়ের হাতেই। যুদ্ধশেষে বঙ্গবাহিনী ভেঙে দেওয়া হল। শেষ হয়ে গেল নজরুলের সৈনিক জীবন। নজরুল এসে উঠলেন কলকাতায় বন্ধু শৈলজানন্দের মেসে। শৈলজানন্দ সাদরে জায়গা দিলেন তাঁর পাশের সিটে। কিন্তু দিলে হবে কি? কয়েকদিনের মধ্যে মেসের চাকর আপত্তি তুললো, সে নজরুলের এঁটো বাসন ধোবে না। নজরুলকে মেস ছাড়তে হল, ছাড়তে হল নিরাপদ ও আনন্দময় আশ্রয়। নজরুল ১৩৩০ সালে লিখলেন---

জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছ জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়ত মোয়া।

এই ছোঁয়াছুঁয়ির প্রসঙ্গে 'নবযুগ' পত্রিকায় প্রকাশিত ছুঁৎ মার্গ প্রবন্ধে নজরুল ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছিলেন, "হিন্দু মুসলমানকে ছুঁইলে তাহাকে স্নান করিতে হইবে, মুসলমান তাহার খাবার ছুঁইয়া দিলে তাহা তখনই অপবিত্র হইয়া যাইবে, ....মনুষত্বের কি বিপুল অবমাননা!"

সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর আরো বজ্রগর্ভ উচ্চারণ---


"অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ
কান্ডারী! আজি দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ
হিন্দু না ওরা মুসলিম?ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বলো, ডুবিছে মানুষ,সন্তান মোর মা'র।।"

১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় দাঙ্গা বাঁধলো হিন্দু মুসলমানের। নজরুল তার অল্পদিন আগে হুগলি থেকে কৃষ্ণনগরে এসে বসবাস করছেন। লাঙ্গল পত্রিকা বেরিয়েছে ১৯২৫ এর ২৫শে ডিসেম্বর। লাঙ্গলের অফিস ৩৭ নম্বর হ্যারিসন রোড। কাজ দেখতে নজরুলকে প্রায় প্রত্যহ কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় আসতে হয়। দাঙ্গা দেখে নজরুল বিমূঢ়। তিনি কোন দলে? তাঁর ডান হাত কি মারবে বাঁ হাতকে ?তাঁর বাঁ দিকের বুক কি আঘাত হানবে ডান দিকের বুকে? এমন করে ভাবতে নজরুলই পারেন। কৃষ্ণনগর থেকে তিনি চিঠি লিখলেন শৈলজানন্দকে, "... আমি এবার কলকাতায় গিয়েছিলাম – আল্লা আর ভগবানের মারামারির দরুন তোমার কাছে যেতে পারিনি।" একি ক্ষোভ? একি বেদনা? নিপুণ ব্যঙ্গে মুড়ে একি দুই সম্প্রদায়ের প্রতি কষাঘাত?

নকরুল মুখে যা বলতেন, কাজেও তা করতেন। একালের নেতাদের মতো নন। তিনি বিয়ে করেন হিন্দু রমণী প্রমীলা সেনকে। প্রমীলা দেবীর জেঠিমা বিরজা সুন্দরী দেবীকে মা বলতেন। শুধু মুখেই বলা নয়, অন্তরের নিভৃততম প্রদেশে শ্রদ্ধার আসনটি পাতা ছিল তাঁর জন্য। শাশুড়ি গিরিবালা দেবী তাঁদের বিয়ের পর থেকে তাঁদের সঙ্গেই থাকতেন। নজরুল প্রমীলা যখন যেখানে বাসা বেঁধেছেন গিরিবালা সেখানেই গেছেন তাঁর রাধাগোবিন্দকে নিয়ে। ১৩৩১ সালের জন্মাষ্টমীর দিন নজরুলের প্রথম পুত্রের জন্ম হয়। তার নাম রাখেন কৃষ্ণ মহম্মদ। তাঁদের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল জন্ম ১৯২৬ সালের (১৩৩৩) ৯ই অক্টোবর। মাত্র চার বছর বয়সে অকাল মৃত্যু হয় বুলবুলের। তারপর আরও দুই পুত্রের জন্ম হয়। তাদের নাম রাখেন কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। পুত্রদের নামের মধ্যেও দুই ধর্ম, দুই সম্প্রদায়, দুই সংস্কৃতির সহাবস্থান।

নজরুল লিখেছেন ----

শ্যমামায়ের কোলে চড়ে
জপি আমি শ্যামের নাম
মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু
ঠাকুর হলেন রাধেশ্যাম।
মহামায়ার মায়ার ডোরে
আনবে বেঁধে শ্যামকিশোরে
কৈলাসে তাই মাকে ডাকি
দেখব সেথায় ব্রজধাম।

পাশাপাশি এমন কবিতা কে লিখতে পারেন এক নজরুল ছাড়া? বাংলা কাব্য জগতের ব্যতিক্রমী প্রতিভা নজরুল ছাড়া? একদিকে লিখেছেন "কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন" অথবা "শ্মশানে জাগিছে শ্যামা", "বল রে জবা বল"-এর মত হৃদয়দ্রাবী শ্যামা সংগীত; অন্যদিকে লিখেছেন "তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে" অথবা "মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই" এর মত অনবদ্য ইসলামী সংগীত। কবির কোন জাত নেই এই আপ্তবাক্যের এমন জ্বলন্ত প্রমান নজরুল ছাড়া সারা পৃথিবীতে এমন করে আর কোন কবি দিয়েছেন?

বরাবরের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ার এক বছর আগে ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত হল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী উৎসব। সভাপতির ভাষণে নজরুল বললেন "যদি আর বাঁশি না বাজে"। বড় করুণ, বড় মর্মস্পর্শী এই ভাষণ। কবি যেন বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর বাঁশি বাজানোর দিন শেষ হয়ে আসছে। এই ভাষণেও তিনি তাঁর প্রিয় বিষয়কে ভোলেন নি। তিনি বলেছিলেন, "হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব – অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে – এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম – অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম, আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর।"

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে অমৃত নির্ঝর অজস্র ধারায় ঝরেছে কবির লেখনী থেকে, কন্ঠ থেকে সে ধারাকে কি আমরা তাঁর উত্তরসূরীরা মরূপথে হারিয়ে যেতে দেব? সে হবে এই ফরিস্তার প্রতি চরম অসম্মান। এই মরমী কবির সারা জীবনের সাধনা বাণীরূপ ধরেছিল যে গানে আসুন আমরা সেই অবিস্মরণীয় গানের অমৃতবাণীকে আত্মস্থ করি আর তারপর তাকে ছড়িয়ে দিই ভারতবর্ষের আকাশে বাতাসে, গ্রামে গঞ্জে, নগরে প্রান্তরে। এই দ্বন্দ্বদীর্ণ ভারতভূমির দিকে দিগন্তরে ধ্বনিত হোক ---

"মোরা, এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমনি হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ীর টান।
মোরা, এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।"

 

0 Comments
Leave a reply