নজরুলের জীবনে কলকাতা

লিখেছেন:পল্লব পত্রকার

 

কাজী নজরুল ইসলাম (ছবি - উইকিপিডিয়া) 

জন্মস্থান বর্ধমানের চুরুলিয়া। দাম্পত্য জীবনের কিছুটা সময় কৃষ্ণনগরে কাটিয়েছেন। রাজনৈতিক ও সাংবাদিক জীবনে ঘুরে বেড়িয়েছেন চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহে। অন্তিম জীবন কাটিয়েছেন ঢাকায়। হ্যাঁ, এসব সত্যি। সেই সঙ্গে এটাও সত্যি, নজরুলের নজরুল হয়ে ওঠা এই কলকাতার বুকে।

সেটা ১৯১৭ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জোর কদমে চলছে। নজরুল রানিগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। মাত্র ৬ মাস পরেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা। কিন্তু কোন্ এক দুর্বুদ্ধিতে সহপাঠী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গিয়ে সৈন্যদলে নাম লিখিয়ে এলেন। বড়লোক মাতামহের 'ষড়যন্ত্রে' শৈলজানন্দ স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অসফল হলেন বটে, কিন্তু স্বাস্থ্যবান নজরুলের মনের আশা পূর্ণ হল। তিনি যুদ্ধ করতে চললেন পেশোয়ারের পথে। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ বছর। হয়তো সেই বয়সেই তিনি ভেবেছিলেন যুদ্ধ করার কৌশল শিখে নিতে হবে। তারপর তা কাজে লাগাতে হবে দেশের মুক্তি-সংগ্রামে।

রণাঙ্গনে নজরুলকে বেশিদিন থাকতে হয়নি। ১৯২০ সালের মার্চ মাস নাগাদ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় চলে আসেন। ওঠেন বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দের ডেরায়, রমাকান্ত বোস স্ট্রিট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বোর্ডিং-এ। ওই বোর্ডিং-এ নজরুলকে এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। নজরুল মুসলমান জেনে মেসের চাকর তাঁর এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করে। এবং শৈলজানন্দকে তা পরিষ্কার করতে হয়। পরবর্তী সময়ে এরকম ঘটনা নজরুলের জীবনে আরও দু-একবার ঘটেছিল।

শৈলজানন্দের মেস ছেড়ে নজরুল চলে আসেন ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ আগেই ছিল। তাই একই ঘরে মুজাফফর আহমেদের পাশে আর একটা চৌকি পাততে অসুবিধে হয় না। এই বাড়িতে মুসলিম পাবলিশিং হাউসের অন্যতম মালিক আফজালুল হক এবং কাজী আব্দুল ওদুদও থাকতেন।

কলেজ স্ট্রিটের সাহিত্য সমিতির ওই আশ্রয়টুকুর জন্য নজরুল চিরকৃতজ্ঞ ছিলেন। ১৯৪১-এর ৫-৬ এপ্রিল সমিতির রজত জয়ন্তী উৎসবে নজরুল ছিলেন সভাপতি। ভাষণে সাহিত্য সমিতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ''সেদিন যদি সাহিত্য সমিতি আমাকে আশ্রয় না দিত তবে হয়তো কোথায় ভেসে যেতাম তা জানি না। এই ভালোবাসার বন্ধনেই আমি প্রথম যে নীড় বেঁধেছিলাম এ আশ্রয় না পেলে আমার কবি হওয়া সম্ভব হতো কিনা আমার জানা নেই।''

করাচিতে থাকাকালীনই নজরুল সাহিত্য সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতার পত্রপত্রিকায় তা প্রকাশের জন্য পাঠান। করাচির সেনানিবাসে নজরুলের সাহিত্যচর্চা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য আশ্রিতই ছিলনা, বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের সঙ্গেও ছিল নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এবং সেই জন্যই করাচিতে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়ার কয়েক মাস আগে ১৯২০-র জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সাত দিনের ছুটি নিয়ে নজরুল যখন দেশে আসেন তখন তিনদিন কলকাতায় বন্ধু শৈলজানন্দের বাসায় কাটান এবং ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন। মুজাফফর আহমেদের সহযোগিতাতেই নজরুল ১৯২০-র জুলাইয়ে 'দৈনিক নবযুগ' প্রকাশ করেন। প্রথমে মার্কুইস লেনে, পরে ৬ টার্নার স্ট্রিট থেকে। 'সেবক' পত্রিকার সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রধানত সাংবাদিকতার কাজেই। 'ধূমকেতু' প্রকাশিত হলে নজরুলকেই সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে হয়। ঠিক হয় সপ্তাহে দুদিন কাগজটি বেরোবে। প্রকাশের ঠিকানা ৩ নম্বর কলেজ স্কোয়ার।

'ধূমকেতু'র অফিসে পুলিশ হানা দেয়  ১৯২২ এর ৮ নভেম্বর। ২৩ নভেম্বর নজরুল কারারুদ্ধ হন প্রেসিডেন্সি জেলে। পরে আসেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। বিশেষ শ্রেণীর কয়েদি হিসেবে কয়েক মাসের জন্য। ১৯২৩-এর ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বহরমপুর জেলে। এক বছর তিন সপ্তাহ পরে ১৯২৩-এর ১৫ ডিসেম্বর নজরুল ছাড়া পান।

সেই সময়ে কলকাতায় সাহিত্যিকদের দুটি বিখ্যাত আড্ডা ছিল। একটি 'ভারতী' কার্যালয়ে 'ভারতীয় আড্ডা'। এখানে আসতেন অতুলপ্রসাদ সেন, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশির ভাদুড়ি, হেমেন্দ্রকুমার রায়। অপর আড্ডাটি ছিল 'গজেনদার আড্ডা'। এখানে আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নরেন্দ্র দেব, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এই দুই আড্ডাতেই নজরুলের যাতায়াত ছিল। সেসব আসরে নজরুলের চিত্র এঁকেছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। ''নজরুল আসতে লাগলেন প্রত্যহ এবং দুদিন না যেতেই বোঝা গেল ছেলেটি লাজুক নয় আদৌ… ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই সবাইকে চমকে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, 'দে গরুর গা ধুইয়ে'। কোনো দিকে দৃকপাত না করে প্রবল পরাক্রমে আক্রমণ করেন টেবিল হারমোনিয়ামটাকে। তারপর মাথার ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে গাইতে থাকেন গানের পর গান।… কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের উপরে ঘর, রাস্তায় জমে যেত জনতা। অনেক বড় বড় গায়ক সে ঘরে এসে গান গেয়েছেন, তবু তাঁদের গান শোনার জন্য অত লোক দাঁড়িয়ে যেত না। কিন্তু নজরুলের গানের ভিতরে নিশ্চয়ই ছিল কোনো বিশেষ আকর্ষণীয় শক্তি।…' ('যাঁদের দেখেছি': হেমেন্দ্রকুমার রায়)

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম কখন দেখা হয় তা সঠিক জানা যায়নি। ১৯২০-র মে মাস থেকে ১৯২১-এর জুলাই মাস পর্যন্ত প্রায় চোদ্দ মাস রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে ছিলেন। ইউরোপ থেকে ফিরে ১৯২১ এর জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন কলকাতায় কাটান। ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম দেখা হওয়া সম্ভবপর। সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনা থেকে মনে হয় কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম দেখা হয়। ''জোড়াসাঁকর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসার সময় তেমন বড়ো লোককেও সমীহ করে যেতে দেখেছি। অতি বাকপটুকেও ঢোঁক গিলে কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু নজরুলের প্রথম ঠাকুরবাড়িতে আবির্ভাব সে যেন ঝড়ের মতো। অনেকে বলত, তোর ওই সব দাপাদাপি চলবে না জোড়াসাঁকর বাড়িতে, সাহসই হবে না তোর এমনিভাবে কথা কইতে। নজরুল প্রমাণ করে দিলে যে সে তা পারে। তাই একদিন সকালবেলা 'দে গরুর গা ধুইয়ে' এই রব তুলতে তুলতে সে কবির ঘরে গিয়ে উঠল, কিন্তু তাকে জানতেন বলে কবি বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হলেন না।'' (আমাদের নজরুল': সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়)

১৯২৯ এর ১৫ ডিসেম্বর জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে সম্বর্ধিত করা হয়। বহু কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক কর্মী সভায় যোগদান করেন। সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ''নজরুল প্রতিভাবান মৌলিক কবি। রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় নাই, তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁহাকে কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। আজ আমি এই ভাবিয়া বিপুল আনন্দ অনুভব করিতেছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি বাঙালির কবি।''…

সুভাষচন্দ্র তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ''আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।  কিন্তু নজরুলের 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু'র মতো প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।''

কলকাতায় নজরুল কেবল সাহিত্যিক হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেননি, একজন সুগায়ক হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি কেরানি ও ছাত্রদের বিভিন্ন মেস ও হোস্টেলে গানের আসরে প্রায়ই আমন্ত্রিত হতেন। অনেক অভিজাত পরিবারেও গান করেছেন।

গায়ক নজরুল ১৯২৮-এর আগে গ্রামাফোন কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হননি। যদিও তাঁর গান প্রথম রেকর্ড হয় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২৮-৩২ পর্যন্ত নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির সংগীত রচয়িতা ও ট্রেনার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৩২-৩৩ এই এক বছর তিনি 'মেগাফোন' রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নজরুল এইচ.এম.ভি. এবং মেগাফোন ছাড়াও ১৯৩৯-এ কলম্বিয়া এবং তারপর পাইওনিয়ার, সেনোলা, হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

অসুস্থ হবার পর দশটি বছর নজরুল কলকাতায় প্রায় বিস্মৃত জীবন যাপন করেন। ১৯৪৫-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে 'জগত্তারিনী স্বর্ণপদক' দেন। এরপর কিছু কিছু সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য ছাড়া নজরুলের চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২-র ৭ জুন কলকাতার বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা 'নজরুল নিরাময় সমিতি' গঠন করেন। কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক। এই সমিতির উদ্যোগে ১৯৫২-র জুলাই মাসে কবিকে প্রথমে রাঁচি এবং পরে ভিয়েনায় নিয়ে যাওয়া হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুজিবর রহমানের অনুরোধে ভারত সরকার বিদ্রোহী কবিকে বাংলাদেশে যাবার অনুমতি প্রদান করেন। কলকাতার সঙ্গে কবির সংশ্রব ছিন্ন হয় ১৯৭২-এর ২৪ মে, যেদিন বাংলাদেশ বিমানে করে কবি সপরিবারে ঢাকা রওনা হন। কবির জীবনাবসান হয় ২৯ অগাস্ট ১৯৭৬-এ তাঁর প্রিয় শহর কলকাতা থেকে বহু দূরে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে।

 

0 Comments
Leave a reply