বিভাস মজুমদার, অমল হালদার, ও সন্দীপ রায়, - পাড়ার এই তিন প্রবীণ তিন চক্কর হেঁটে সবেমাত্র হাঁপাতে হাঁপাতে পার্কের বেঞ্চে পিছনটা ঠেকিয়েছেন পা-টাকে খানিক বিশ্রাম দেবার জন্যে; তখনই কোনো একজনের চোখ পড়াতে হাল্লা বোল উঠল, - ওই যে আসছে, ওই যে আসছে। ওঠ, ওঠ। খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাঁচোর পাঁচর করে উঠে তিনজনে হাঁটা লাগালেন উল্টো দিকে।
নিত্যানন্দ নন্দী এ পাড়ায় নতুন এসেছেন। সবাই কে তেমন ভাবে চেনেন না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সামনে পিছন দেখে বসবেন না দাঁড়াবেন ভাবতে গিয়েই হন্তদন্ত হয়ে পুরন্দর পুরকায়স্থ এসে সামনে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ওদের দেখেছেন?
- কাদের ?
- আরে বিভাস, অমল ওদের? এই যে এইখানে একটু আগেই বসেছিল।
ভ্যাবলার মত মাথা নাড়ে নিত্যানন্দ। না দেখেনি।
আফসোস ঝরে পড়ে পুরন্দরের গলায়। - কি যে হয়? আমি এলেই ওরা যেন ভ্যানিশ হয়ে যায়। হঠাৎ নিত্যানন্দ কে খেয়াল করে বলে, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। আপনি কি নতুন এসেছেন এদিকে?
নিত্যানন্দ সলজ্জ হাসি দিয়ে বলে, - এই কিছুদিন।
- ও তাই বলুন। পুরন্দর নিজেই হাত জোড় করে পরিচয় দেয়। ইস, দেখেছো আপনি যে আমাদের এলাকায় এসেছেন আমি জানিই না।
পুরন্দর দু তালু মুচড়ে বলে, - তাহলে আপনার সাথে তো একদিন বসতেই হবে দাদা। আপনি পাড়ায় নতুন। নিত্যানন্দ ঘাড় নেড়ে বলে, - হ্যাঁ সেতো ঠিকই আছে। তারপর কী মনে হয় সন্দিগ্ধ নিত্যানন্দের মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, - আমি কিন্তু কোনো ধর্মে বা রাজনীতিতে নেই।
হাসতে হাসতে ভালো করে সিটে বসে হাঁটুতে হাত বুলিয়ে পুরন্দর বলে, - না, না। কী মিল দেখুন। আমিও ওসবে নেই। ধর্ম আর রাজনীতি দুটোই বিচ্ছিরি রকম বাজে জিনিস।
নিত্যানন্দ কী বলতে যাচ্ছিল, পুরন্দর প্রায় না শুনেই বলে, - দেখুন আমি হচ্ছি জীবনের দূত।
- সে কি রকম?
- বুঝলেন না তো? আমি আসলে মৃত্যু কে পাহারা দেই।
- সেটা কিরকম?
- এই ধরুন আপনি চাকরি করেন তো ? নিত্যানন্দ মাথা নাড়ে।
- তাহলে আপনি বুঝবেন। চাকরি শেষ হলে কোম্পানি আর কত ফেরত দেয়? সামান্য কিছু প্রভিডেন্ট ফান্ড আর ভাগ্য ভালো থাকলে কিছু ছিটে ফোঁটা গ্রাচুইটি। এইতো? আমার কোম্পানি তে নাম লেখান সামান্য কিছু দিয়ে। তারাই শেষ বয়েসে দেখবে আপনাকে।
- কোম্পানি কি ভাবে দেখবে ?
- সামান্য কিছু মাসে মাসে বা বছরে দিয়ে যেতে হবে। তারপর পায়ের ওপর পা তুলে শেষ জীবন কাটান। মরে গেলে তো পোয়া বারো।
নিত্যানন্দ ভয়ার্ত স্বরে বলেন, - বলেন কি ? কার ?
- আরে বুঝলেন না? আপনার মশাই। আপনি তো দিব্যি চলে গেলেন। অ্যাক্সিডেন্ট বা রোগে ভুগে, তখন কে দেখবে আপনার পরিবার কে? আপনার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব? উঁহু, কাউকে পাশে পাবেন না। সবাই তখন মেসি হয়ে খেলছে। আছে আছে করতে করতে পাশ কাটিয়ে কেটে পড়বে।
নিত্যানন্দ অবাক। - আমি চলে যাবার পর আমার পরিবারের পাশে আপনি থাকবেন ? কি ভাবে?
পুরন্দর সামান্য লজ্জিত হয়ে বলে, - মানে আমার কোম্পানি থাকবে। একটা মোটা টাকা আপনার পরিবারের হাতে তুলে দেবে। দেবেই দেবে কোনো মিস নেই। আর কে করবে এরকম বলুন?
নিত্যানন্দ ঢোঁক গিলে বলে, - আপনি কি এল আই সি বা ওই ধরণের কোনো জীবন বিমার কথা বলছেন?
- ঠিক ধরেছেন। আপনি বুদ্ধিমান লোক। চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পুরন্দরের। - এরকম শান্তির জায়গা আপনি পাবেন না। মাসে মাসে সামান্য কেটে যাবে বুঝতেও পারবেন না। পুরো সরকারি ব্যাপার, কোনো ধাপ্পা নেই। বেঁচে থাকলে মেয়াদ শেষে যা দিয়েছেন তার থেকে ও বেশি বোনাস। ভাবুন একবার। আবার লোন ও নিতে পারবেন। বাড়ি গাড়ি করুন কেউ কিছুটি বলতে আসবে না। এই ধাপ্পা বাজির জগতে এরকম গঙ্গা শুদ্ধ কাউকে পাবেন আর? বেশ গর্বের সাথে বলে পুরন্দর, - আমরা মানুষের কথা ভাবি। সততার একটা দাম নেই?
নিত্যানন্দ বোকার মত ঘাড় নাড়ে, - ঠিকই তো।
পুরন্দর দম নেবার ফাঁকে নিত্যানন্দ পেড়ে ফেলে, আমাকে এখুনি বাজার যেতে হবে। পড়ে কথা শুনি?
এক গাল হেসে পুরন্দর বলে ছি, ছি। দেখুন দিকি আপনাকে আটকে রেখেছি। আপনি আসুন। পড়ে কথা হবে। নিত্যানন্দ নিজের হাঁটার দ্বিগুণ স্পিডে হেঁটে উধাও হয়ে যায়।
*
পুরন্দরের সঙ্গে আলাপের কথা তুলতেই হৈ চৈ পড়ে যায়। - কি বলল? ধরেনি চেপে? আলাপ হতেই আরম্ভ করে দেয়নি? মৃদু হাসি দিয়ে বলে নিত্যানন্দ, - বলেছে তো। আমি চুপ করে শুনে বাজার করবার ছুতোয় পালিয়ে বেঁচেছি।
অমল বাবু বললেন, - শিগগিরই আসবে দেখুন আপনার বাড়ি। ওনার বাড়ির আশেপাশে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
- কি?
- কোনো ভূতের উপদ্রব পাবেন না।
সন্দীপ বললে, - ওরে বাপস! আপনি জানেন না ওই জীবন বিমার এজেন্ট যেখানে থাকে সেখানে ত্রিসীমানায় ভূত অবধি থাকে না?
- বলেন কি?
- ধরতে পারলে আর মানুষ জন্ম হবেই না ভূত ই থেকে যাবে।
অমল বাবু আর বিভাস বাবু হাসতে থাকেন। - জীবন ওষ্ঠাগত বোঝেন ?
- আপনাদের সেরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে নাকি ?
- আমাদের আগেই ছিল পলিসি। ওনার সঙ্গে দেখা হবার পর আমাদের বউ, ছেলে, মেয়ে সবার করিয়ে ছেড়েছে। নানা বাহানায় কত রকম পলিসি নিয়ে এসে লোভ দেখাবে যে আপনি বিরক্ত হয়েই করে ফেলবেন। এমনকি এখন বাড়ির কাজের লোকের জন্যে করাবে বলে খুঁজছে আমাকে।
নিত্যানন্দের গলা শুকিয়ে আসে। কাঁচুমাচু হয়ে বলে, - এর মধ্যে একদিন আসবে বলেছে বাড়িতে। কি হবে দাদা ? অমল বাবু জিজ্ঞাসা করে, - আপনার কি লাইফ ইনস্যুরেন্স কিছু আছে?
- আছে তো। বাবা করিয়ে দিয়েছিল। ওটা করে কয়েক বছরের মধ্যে মরে গেলেই লাভ। পলিসি শেষ হলে যা পাওয়া যায় তাতে তেমন কোনো উপকার নেই বললেই চলে। প্রায় অসহায়ের মত বলে, - আমি আর করতে চাই না।
সন্দীপ বলে, - বাঁচা খুব মুশকিল। খুব স্ট্রং মার্কেটিং অ্যাটিটিউড। তাহলে এই বয়েসে শুধু এর জন্যে ওনার সাথে মুখ দেখা দেখি বন্ধ করতে হয়। তাও রাজি হবে কিনা কে জানে? জান প্রাণ দিয়ে মাটি কামড়ে থাকে। লজ্জা সরম খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।
বিভাস বাবু যোগ করে, - মাসের প্রথম সপ্তাহ হলেই সে হাজির হয়ে যাবে দাঁত কেলিয়ে প্রিমিয়ামের চেক এর জন্যে। ভুল করে ভুলেও যায় না কোনো বার।
*
গেল গেল রব উঠল। মনে হল ফুটপাতের কোনায় লেগে পুরন্দর পড়েছে। একদম হুমড়ি খেয়ে। হাতের ফাইল, চশমা সব চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে।
দেখি দেখি, বলে লোকজন সরিয়ে দু হাত বাড়িয়ে দেয়। কি কান্ড বলুন তো? পুরন্দর মুখ তুলে দেখলে সাক্ষাৎ দেব দূতের মত নিত্যানন্দ নন্দী হাত বাড়িয়ে। - আস্তে আস্তে। দেখুন তো উঠতে পারছেন তো ?
- আসুন, হাত টা ধরুন।
নিত্যানন্দ সহানুভূতির সঙ্গে বলে, - যেরকম ফুলেছে তাতে তো মনে হচ্ছে নির্ঘাত ডিস-লোকেশন বা ভাঙা।
- বলেন কি? এত কষ্টের মধ্যেও পুরন্দরের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বলে, - তাহলে কি প্লাস্টার করতে হবে ? সেটা হলে তো এক মাস বিছানায়। নিজের ভাবনায় নিজেই শিহরিত পুরন্দর। তাহলে পলিসি প্রিমিয়াম? কিছুটা আর্তনাদের মতন শোনায়।
নিত্যানন্দ পায়ে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে, - ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন যেন এর বেশি না হয়। আর হ্যাঁ, আপনার মেডিক্লেম করা আছে তো? তাহলে চলুন, চিন্তার কিছু নেই।
কুঁইকুই করে নীচু স্বরে পুরন্দরের জবাব আসে, - না ওটা নেই তো।
- নেই? কি বলছেন?
বিস্ময়ে পুরন্দর সোজা দাঁড়িয়ে পড়ে। - তাহলে সর্বনাশের মাথায় বাড়ি।
- কেন মাথায় বাড়ি কেন?
- হবেই বলছি না। তবু ধরুন আপনি সামনের নার্সিং হোমে গেলেন। ডাক্তার এক্সরে করে বললে অপারেশন করতে হবে নাহলে জোড়া লাগবে না। হবেই বলছিনা। আপনি তো কোথাও দ্বিতীয় মতামত নেবার মতন অবস্থায় নেই। ধরুন আপনি রাজি হলেন। ব্যস আপনাকে নিয়ে পেড়ে ফেলল থিয়েটারের টেবিলে।
প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় পুরন্দরের গলা। - থিয়েটারে কেন ?
- অপারেশন হবে না? ডাক্তার, নার্স, আরো কত লোক আসবে। দেখবে। তারপর অজ্ঞান করে পা ছিঁড়ে স্ক্রু বসাবে। তারপর ধরুন ধরে রাখল দিন সাতেক বা দশেক।
পুরন্দর এর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোয় না। নিত্যানন্দ যেন গা ছমছমে ভূতের গল্প বলছে। আবার শুরু করে, - এমনিতে কিন্তু খুব আরাম। কয়দিন ঠান্ডা ঘরে ভালোমন্দ খেয়ে কাটল। এবার চলে যাবার দিনে এল সেই বহু প্রতীক্ষিত, সেই খাল নয়, পুকুর নয়, একেবারে বিল। ভাগ্য ভালো হলে একলাখ চল্লিশ, পঞ্চাশ আর খারাপ হলে কত হবে সেটা ভাবতেই পারছিনা।
পুরন্দর নিজের পায়ের ব্যথা ভুলে বিলের কথায় শিউরে ওঠে। - বলেন কি?
- বলছি এমন হবেই তা নয়। তবে হতেই তো পারে। তখন ?
- জীবন বীমা দিয়ে হবে না ?
মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়ে নিত্যানন্দ। পুরন্দরের চোখে জল এসে যায়। - এমন টা হবে ভাবিই নি।
- না, না খালি জীবন বীমা নিয়ে ভাবলে হবে? হাসপাতাল একটা কোপ মারবে, আপনি ফিনিশ। এই বড়লোক ছিলেন দশ দিনে হয়ে গেলেন রাস্তার ভিখিরি। ভাবুন একবার।
উদাস লাগে পুরন্দরের। হঠাৎ নিত্যানন্দ উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, একটা উপায় আছে। আলোর ঝিলিক দেখে পুরন্দর বলে, - কি বলুন ? এর থেকে বাঁচার উপায় কি আছে ?
গুপ্তধন পাবার মত চোখ মুখ উদ্ভাসিত হয়। - বলে একটা উপায় আছে। আপনার সঙ্গে চেক বই আছে?
- হ্যাঁ। ওটা নিয়েই তো বেড়িয়েছিলাম ব্যাংকে যাবো, তারপর আপনার বাড়ি যাবো আলাপ করতে। তার মধ্যে এই ঘটনা।
- শুনুন আপনি বন্ধু মানুষ বলে বলছি। কাউকে বলবেন না।
- বলুন।
- আমার বন্ধু কাজ করে একটা মেডিক্লেম কোম্পানিতে। আমি সেখানেই যাচ্ছি একটা কাজে। আর ঘটনা চক্রে আজকেই পঞ্চাশ বছর উদ্যাপনে ওদের নিউ পলিসি করার ক্ষেত্রে দশ পার্সেন্ট কম প্রিমিয়াম নেবার শেষ দিন। আজ করলে কিছুটা কম হবে। দেখুন কী করবেন? আপনার ভাগ্য ভালো আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে কাকতালীয় ভাবে।
ব্যথায় মুখ বেঁকিয়ে বলে পুরন্দর, - আজ পলিসি করলে কি আমার চিকিৎসার টাকাটা পাওয়া যাবে?
- সেটাই তো আমার খেল। এখুনি নিয়ে চেক ফেলতে পারলে হয়ে যাবে, কারণ আপনার বিল হতে হতে কয়েকদিন বাকি।
অত যন্ত্রণার মধ্যেও হাত ব্যাগ থেকে চেক বই বার করে নিত্যানন্দের পিঠে রেখে পুরন্দর চেক সই করে দিয়ে দেয়। বলে, - আপনি যে আমার কি উপকার করলেন কি বলব।
- না, না। লজ্জায় অধোবদন নিত্যানন্দ বলে, - এটা ভাগচক্রেই হয়েছে।
এর মধ্যে পুরন্দরের এক বন্ধু এসে জুটে যায়। নিত্যানন্দ ওনাকে দেখে বলে, আপনার বন্ধু যখন এসেছে তখন আপনাকে এখানে বসিয়েই আগে দৌড়ে যাই চেকটা জমা দিতে। পুরন্দর ঘাড় নাড়ে। নিত্যানন্দ সামনের একটা অটো ধরে মিলিয়ে যায়।
বন্ধু বলে, ওনাকে তুমি চেনো?
- হ্যাঁ, আমার হবু ক্লায়েন্ট।
বন্ধু বলে, দুর থেকে মনে হল উনিই তোমাকে ঠেলে দিলেন যেন।
বিস্মিত পুরন্দর বলে, - যাহ, কী বল। উনি খুব উপকারী মানুষ।
- হ্যাঁ, আমি চিনি। মেডিক্লেম এজেন্ট। মনে রেখো উনি কিন্তু ভীষণ অ্যাগ্রেসিভ এজেন্ট। পলিসির জন্যে উনি পারেন না এমন কাজ নেই।
ব্যথা ভুলে পুরন্দর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মুখে কথা সরে না।