প্রেমাশ্রিতের হেমন্ত
“কী জ্বালা দিয়া গেলা মোরে
নয়নের কাজল পরাণের বন্ধু রে
না দেখিলে পরাণ পোড়ে” - প্রচলিত লোকগীতি
কোথাও কি ধুলোর মত ঘুমিয়ে আছি, অক্ষরনীল উষ্ণতার ডাকনামে? জেগে-থাকা কেউ ভুলেই গেছে বুঝি আত্মনিঃসৃত ছায়াপথ! অশ্রুসংকেতে লেখা অসুখ আস্তে আস্তে স্তব্ধ করে দিয়েছে একক অন্নের শিহরণ। বাকি রৌদ্রভিক্ষায় ছায়া খুঁজি বহুদূর।
আমাদের ক্ষুধার কুহক থেকে মাংসের মহাজিজ্ঞাসায় কিছুই লিখি নি। এই অসমাপ্ত আয়ুগহ্বরের কুয়াশায় দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে মুছে ফেলেছি স্তব্ধতার নির্দেশ। তবু এই উর্ণনাভতন্তুতে শীতল আলো জমা হয় জন্মান্তরের প্যারালাক্সে।
এরপরের পারফিউম থেকে তোমার ক্ষুব্ধতা আর ফেরাতে পারি নি।
প্রেমাশ্রিতের শীত
“আমার পরাণডারে আছাড় মারে মনগাঙের ছাও
ভাটি ছাইড়া উজান আইসা যাও” –প্রচলিত ভাটিয়ালি
অনতিক্রম্য স্মৃতিকাতরতা বহুদূর থেকে দেখছে আমাদের। নাভিকুন্ড পুড়ছে অল্প শীতে। আমাদের খাদ্যের উত্তাপ থেকে সরে যাচ্ছে একটা জন্ম, অলখ এক তরঙ্গের দাগ। বেশী পুড়ে যাওয়া মাটির মন্দিরে সঙ্গম-কুহক লেখা এক সরীসৃপ গুছিয়ে নিচ্ছে অসুখজ্যামিতির খোলসের ক্ষীণ চিৎকার।
ধুলোপায়ের ইতিকথা শুনতে শুনতে এক আলোছায়াপথ আনমনা হয়ে গেছে আমাদের চিবুকে, আলজিভে, বৃন্তে, স্বাধিষ্ঠানে। দেখা হবে না কোথাও। একটি স্ফুলিঙ্গের অবসর থেকে কঠিনতম মাংসে আমি ছদ্মবেশ লিখি। তোমার অপরিচয় ঘষি অগণন মৃগশিরা মাখা শস্যক্ষেত্রে। এই ছিন্ন আয়োজন-কল্পনায় আমি গ্রাস করি তোমার দ্বিখন্ডিত বিষ।
বিষ সরিয়ে নিয়েছে মৃগব্যাধ। বন্ধ্যাত্বের দাগ থেকে সন্তানক পুষ্পের আলো তুলে আমি তোমাকে পথ দেখাই। দৃশ্যত মেঘলা অন্তরাকাশ আস্তে আস্তে আর্দ্র করে তোলে আবহাওয়ার নির্দেশিকাগুলি। জিজ্ঞাসায় ক্লান্ত হয়ে ওঠে পায়ের আঙুল।
প্রেমাশ্রিতের বসন্ত
“আমরা মৃত্যুর হিম ঘুম থেকে তবে
কী করে আবার প্রাণকম্পনলোকের নীড়ে নভে
জ্বলন্ত তিমিরগুলো আমাদের রেণুসূর্যশিখা
বুঝে নিয়ে হে উড্ডীন ভয়াবহ বিশ্বশিল্পলোক,
মরণে ঘুমোতে বাধা পাব?” – জীবনানন্দ (‘মৃত্যু স্বপ্ন সংকল্প’)
ক্রোধের শীতলতা দিয়ে আরো কিছুটা স্তব্ধতা অনুবাদ করিয়ে নিচ্ছি আমরা। সোনালী রঙ মেশানোর পর দু’জোড়া পায়ের ছাপ এগিয়ে আসছে আমাদের স্মৃতিহীনতায়। আমরা ছুটে চলেছি। আটপৌরে রক্তের দাগের পাশ দিয়ে, মৃগশীর্ষ নক্ষত্রমন্ডলীর শীতের ভেতর দিয়ে আমাদের খিদেটাকে কামড়ে ধরেছে সেই ছাপ। আরোগ্যহীনতার দাগ থেকে শেষ আলো গড়িয়ে পড়ছে এক ধানদুখী বিকেলে।
রঙের মৃত্যু থেকে আমাদের ফিরিয়ে নিচ্ছে শিল্পীর ধূসর আঙুল। কেঁপে ওঠা জলের ভাষার ওপর দিয়ে আমরা বাঁচিয়ে ফেলেছি বুদবুদের অস্থিরতা। ভোরের স্বপ্নের বৃদ্ধিগন্ধ বেয়ে তিলফুলের নাকছাবি আসছে। আয়ুরেখার আনন্দ-ঘুম থেকে ভেসে উঠছে জন্মান্তরের সন্তানপ্রভ আলো।
একটি সংকেত, একটি আলো, একটি অন্ধকার- একই পাত্রে দুঃখের বিশুদ্ধতা মেপে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে অস্ফুট স্মৃতিহীনতায়। সময় থেমে গিয়েছে। কিম্বা অপেক্ষা করছে, কখন জলের পাতলা সর ভেঙে ভেসে উঠবে একটি সাপের মাথা। সেই সাপ রক্তপাতের অধিকার চেটে ফিরে যাবে অদৃশ্যে।