রাত্রি

লিখেছেন:অরিজিৎ মল্লিক

 

 

আচমকা অঘটনটার পর রাত্রি একেবারে মুষড়ে পড়েছিল; টানা সাতদিনের লড়াইয়ের পর র’-এর সিনিয়ার ইনটেলিজেন্স অফিসার কমলেশ মজুমদার হৃদরোগে মারা গেলেন। এরপর টানা প্রায় চারমাস কেটে গেছে, রাত্রি কোনভাবেই নিজের কাজে আর মন বসাতে পারছিল না। কমলেশ মজুমদারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে সে কাজ করেছে নয় নয় করেও টানা প্রায় আট বছর, দেরাদুন আইএমএ-তে তার ফাইনাল ট্রেনিং-এর পর থেকেই। 

টিং টং!! কলিং বেলটা বাজতেই উমানাথ এসে দরজা খুলল। না, কেউই নেই, তবে একটা ছোট্ট গিফট প্যাক দরজায় নামানো। ওটা নিয়ে এসে সে বলল, - দিদিমণি, এটা কেউ রেখে গেছে। রাত্রি অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আলতো করে মোড়কটা খুলল। পিচবোর্ডের বাক্সে একটুকরো ছোট্ট কাগজ, তাতে লেখা - শ্রীতমা। এই কোডওয়ার্ড বেশ ভালোই জানা ওর। কিন্তু কমলদা ছাড়া এখন আর এসব ভালো লাগেনা। আবার তমাল বসুর বার্তাকে অগ্রাহ্যও করা যায়না। অগত্যা রাত্রি বেড়িয়ে পড়ল নিউ মার্কেটের দিকে। একটা ক্যাব নিয়ে পনেরো মিনিটের রাস্তা দুপুরের জ্যামে লাগলো প্রায় চল্লিশ মিনিট। সামনে কালীপুজো। রাস্তায় ট্রাফিক, লোকজন সবই বেশী। কোলকাতার পুজো কতো বছর যে দেখা হয়নি। আজকাল তো কলেজের বন্ধুদের সাথেও দেখা হয়না। এখন অবশ্য সে বাদে বাকি সকলেই ম্যারেড। 

শ্রীলেদারস্‌-এর ভিতরে অনেকটাই ভিড়। দোতালায় উঠে এলো সে। কিন্তু তমালবাবু কে দেখতে পেলোনা। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে জুতো দেখতে লাগল। একটা ভালো ট্রেকিং স্যু নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে সে হারিয়ে গেলো ছ’মাস আগের কমলদার সাথে হিমাচল ট্রেকিং-এর দিনগুলোতে। হঠাৎ একটা হালকা ধাক্কা দিলো কেউ, পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়! রাত্রি তমাল বসু কে দেখল যেন, ভিড়ের মাঝেও তিনি এখনো সপ্রতিভ। রাত্রি এগিয়ে গেল ব্যাগের দিকটায়। কিছুটা হালকা স্বরে তমাল বাবু বললেন, ভেরী স্যাড ফর কমল। আমাদের জন্য বিরাট একটা লস্‌। কিন্তু আমি চাই তুমি আবার ফেরো রাত্রি। তারপর একটা পেন ড্রাইভ এগিয়ে দিয়ে বললেন, জাভেদ ইজ্‌ ব্যাক।

 

এপ্রিল ২০০২

চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ 

গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে ঢালাই রাস্তার কাজ চলছে। ঘরঘর করে চলছে ঢালাই মেশিন। লেবাররা একে একে সিমেন্ট, বালি আর স্টোন চিপস ঢালছে মেশিনে। সকাল থেকেই একপ্রস্থ ঝামেলা লেগেছিল কাদের আর জাভেদের মধ্যে। হঠাৎ করেই কাদেরের মাথা থেকে স্টোন চিপস এর ভারি ঝুড়িটা গিয়ে উলটে পড়ল জাভেদের গায়ের ওপর। যেন গরমে একটা লাভার বিস্ফোরণ ঘটল। জাভেদ হালা, কুত্তার পোলা ইত্যাদি কুৎসিত চিৎকার করতে করতে কাদেরের মাথায় বসিয়ে দিলো পাশে পড়ে থাকা পিলারের এক চরম ঘা! কাদের মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আর তার পরের গন্ডগোলের মাঝে কিভাবে যেন জাভেদ হারিয়ে গেল। তারপর থেকে তাকে আর কেউ সেই এলাকায় দেখেনি। পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও জাভেদের টিকির সন্ধান পেলনা।

 

নভেম্বর, ২০০৩

অজানা পাহাড়ি ক্যাম্প

কক্সবাজার,বাংলাদেশ 

সারি বাঁধা অনেকগুলো তাঁবু। তারই মধ্যে কয়েকটি তাঁবুর বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মেয়ে মরদের দল। একধারে রান্না চলছে। তার কিছুটা দূরে ট্রেনিং চলছে সকালের। চারটে দলে ভাগ হয়ে এই ট্রেনিং হচ্ছে। একটা কোণায় চলছে শুটিং প্র্যাকটিস, একে-৪৭-এর র‍্যাট্‌ র‍্যাট্‌ আওয়াজে চারিদিক গমগম করছে। হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানালো হুজির (হারকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি) এরিয়া কম্যান্ডার ফখ্রুল ইসলাম। আর শরীর টানটান করে স্যালুট করল জাভেদ খান। সে এখন ফখ্রুল এর খুব কাছের সৈনিক।

ফখরুল ইসলাম। বয়স ৫০ ছুইছুই কিন্তু টানটান চেহারা। ১৯৮৮ তে আফগানিস্তানে একে-৪৭, এলএমজি আর রকেট লঞ্চারে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। বছর চারেক আগে বিশিষ্ট সাহিত্যিক শামসুর রহমান কে হত্যার ছক করেও সেটা সফল করতে পারেনি। কিন্তু দু বছর আগে রমনা পার্কে যেই বোমা বিস্ফোরণ হয় তার মাস্টার মাইন্ড সে। সেখানে জনা দশেকের প্রাণ গেছিল। এবার আরো বড় কিছুর প্ল্যান করছে ফখ্রুল আর সেটা তার প্রিয় সৈনিক জাভেদ কে মাথায় রেখে।

সন্ধ্যে সাতটার আশেপাশে, বাইরে তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তাতে শীত আরও জাঁকিয়ে বসেছে। তাঁবুর বাইরের ছাউনিতে তখন সার বেঁধে মুরগীর রোস্ট করা চলছে, খুব সম্ভব কাবাব তৈরি হবে। পরপর পাঁচটা জিপের কনভয় এসে দাঁড়ালো তাঁবুর সামনে। একে একে নামছে জলপাই রঙা পোশাকে হুজি সৈনিক। পিঠে সকলের এ কে সিরিজের রাইফেল। একদম মাঝের জিপটা থেকে নামলেন মুফতি আব্দুল হান্নান, চিফ কমাণ্ডার অফ হুজি। নেমেই গটগট করে ঢুকে গেলেন ফখরুলের জন্য নির্দিষ্ট করা বিশেষ তাঁবুটায়। সেখানে আজ একটা উচ্চ পর্যায়ের গোপন মিটিং স্থির করা আছে। হান্নান ফখরুলের সামনের টেবিলটায় কিছু কাগজ নামিয়ে রাখলেন, ফখরুল মন দিয়ে খুঁটিয়ে কিসব যেন দেখল আর তারপর বলল, ভাইজান, কিছু মনে কইরেন না ইহানে বেশ কিসু লিঙ্ক মিসিং দ্যাখতাসি। হান্নান প্রত্যুত্তরে জানতে চাইলেন, মিশনটার জন্য তুমি কারে কারে বাচছো? ফখরুল একটা হাততালি দিতেই তাঁবুর বাইরে পাহারায় থাকা লোকটা ভেতরে ঢুকে এল। জাভেদরে ডাকো। বাইরে অপেক্ষায় থাকা জাভেদ ভেতরে আসতেই ফখরুল বলল, এরে আল্লা তালাহ্‌ এই মিশনটার জন্যই পাঠাইসে। হান্নান জাভেদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। তার চোখের মধ্যে প্রচণ্ড দৃঢ়তা, বুদ্ধি আর নৃশংসতার মেলবন্ধন। সেকারণে অনেকেই হান্নানের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভয় পায়। জাভেদ কিন্তু একদৃষ্টে সেলাম ঠুকে চীফের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইলো। হান্নান মুচকি হাসলেন। কিছুক্ষণ পর ওরা তিনজন রোল করা কাগজগুলো খুলে আলোচনা শুরু করলো। কিছু ম্যাপ খোলা হল। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি  হচ্ছে।    

 

ডিসেম্বর ২০০৩

গিলগিট বালোচিস্থানের দুর্গম স্থান

কারাকোরামের অপূর্ব সৌন্দর্য্য এক নৈসর্গিক শোভা তৈরি করেছে। ওপরওয়ালা যেন খুব যত্ন করে সাজিয়েছেন, তবে মানুষের থেকে এই সৌন্দর্য্যকে তিনি সরিয়ে রেখেছিলেন যুগ যুগ ধরে। এই কারাকোরাম প্রায় ৫০০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, আর সে পাকিস্থান, ইন্ডিয়া ও চায়নার সীমানাকে ভাগ করেছে। এখানে আকাশ পুরোপুরি নীল, ডিসেম্বর মাসের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় প্রকৃতির অপরুপ শোভা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সাদা চাদরে মোড়া কারাকোরামের সেই সৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করা ধৃষ্টতা। সেই শোভার নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করে হঠাৎ বুলেটের অবিরাম যান্ত্রিক শব্দ আকাশ বাতাসকে রুষ্ট করে চলতে থাকল। আইএসআই এর এক গোপন ডেরায় তখন চলছে শুটিং প্র্যাকটিস। বলে রাখা ভালো, এই গোপন ডেরার কথা বালোচিস্থানের নর্থ ফ্রন্টিয়ার কর্পস খুব ভালো করেই জানে কিন্তু জেহাদি আন্দোলনকে ‘’আমন” করার লক্ষ্যে ইউনাইটেড স্টেট্‌স আর্মির থেকে তাকে সযত্নে সরিয়ে লালন করা চলছে। 

‘ইনশা আল্লাহ’ বলে একজন মেজর সাবাশি দিয়ে উঠল, এর নাম মোল্লা আনসার খাঁ। এ কে ৫৬ টা রেখে একজন এগিয়ে এসে সেলাম ঠুকল সৈনিকি কায়দায়, আনসার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে যা বলল সেটা বাংলা করলে দাঁড়ায়, আমি অনেক বছর ধরে অনেককে ট্রেনিং দিয়েছি। এখন দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করি, কিন্তু এক দেখায় আজও বুঝতে অসুবিধা হয়না। আল্লাহ তোমাকে ওপর থেকে পাঠিয়েছেন কাফির দের সাজা দেওয়ার জন্য। বলেই আনসার জড়িয়ে ধরল যাকে সে হল জাভেদ খান।

আজ প্রায় মাস দুয়েক জাভেদ গিলগিটে আছে। এই দুমাসে কখনও আইএসআই এর সাথে কখনও হিজবুল মুজাহিদিনের কমান্ডার চিফদের সাথে মিটিং করেছে, রাতের পর রাত বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে মিশন নিয়ে। তাছাড়া ট্রেনিং নিয়েছে অত্যাধুনিক মেশিনগান, কালাশনিকভ রাইফেল, গ্রেনেড আর রকেট লঞ্চারের।

 

হুঞ্জা ভ্যালি

জানুয়ারি ২০০৪

হঠাৎ ইউ এস আর্মির র‍্যাডারে ট্রেনিং ক্যাম্প এসে যাওয়ায় সকলকে ছত্রভঙ্গ হতে হল। জাভেদ চীফের নির্দেশ মত হুঞ্জায় চলে আসে। হুঞ্জায় এসে প্রথমে সে ওঠে একটা ছোট হোটেলে আর তারপর সারদুল বালোচের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। হুঞ্জা নদীর প্রায় ধারেই বাড়িটা অবস্থিত, সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি। বাড়িটা দেখলেই একটা রুচিবোধের নমুনা বোঝা যায় মালিকের। সারদুল একজন আয়ুষ ডাক্তার আর দীর্ঘদিন ধরেই তার আই এস আই, হিজবুলের সাথে সুসম্পর্ক আছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে কেউ কোনোদিন অনুভব করতে পারেনি। সুপুরুষ জাভেদ যেদিন এই বাড়িতে প্রথম আসে সেদিনই বাড়ির ব্যালকনিতে থাকা কান্দিলকে দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যায়। কান্দিল সারদুলের মেয়ে। সারদুলের বিবি বেশ কয়েকবছর আগে মারা গেছে, তখন কান্দিল অনেকটাই ছোট। সেই থেকে সারদুল সরাসরি হিজবুল বা আই এস আইএর সাথে সম্পর্ক রাখতে পারেনি। তথাপি পুরনো সমীহ বা দুর্বলতাটা তার আগের মতই রয়ে গেছে। সারদুল এখন পুরোদস্তুর একজন ব্যাস্ত ডাক্তার। হুঞ্জাতে তার যথেষ্ট পসার আছে। এমনিতেই সুন্দর আবহাওয়ার কারণে আয়ুর দিক থেকে হুঞ্জা ভ্যালির মানুষ দীর্ঘজীবী হন তবে এই আয়ুষ চিকিৎসাও একটা অন্যতম কারণ হতে পারে। 

প্রথম কদিন জাভেদ কিছুই করলো না। বেশিরভাগ সময়টা সে ঘুমিয়ে কাটালো। মন খারাপ লাগলে হুঞ্জা নদীর পারে পাথরের ওপর গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। এখানেই এক বিকেলে কান্দিলকে সে দেখেছিল একমনে জলের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে। পরন্ত বিকেলের মায়াবী আলো কান্দিলকে ছুঁয়ে পাথরের ওপর গিয়ে পড়েছে। একটা লালচে পৃথিবী আর খরস্রোতা হুঞ্জার শব্দে কান্দিলকে মনে হচ্ছিল জন্নতের কোন অপ্সরা। জাভেদ আর থাকেনি, ওই সৌন্দর্য ওকে যেকোনো সময় দুর্বল করে দিতে পারে।

অনেক রাত পর্যন্ত কেমিক্যাল নিয়ে অ্যানালিসিস করেছে সে, কিন্তু কোনোভাবেই এতদিন ডেটোনিটরের পজিসন অফ প্লেসিংটা বুঝতে পারছিল না, আর কটা দিন ক্যাম্প চললে গ্রেনেড তৈরিটা তার কাহে জলের মত হয়ে যেত। সে সার্কিট তৈরির বইটা আবার খুললো, খুব মন দিয়ে পড়ল। এবার খুব সাবধানে ডেটোনেটরকে প্লেস করল। স্পেশাল কেমিক্যালটা মাঝখানের প্রকোষ্ঠে ঢালল, আরতারপর পারকাসান ক্যাপটা সাবধানে প্লেস করে স্প্রিংটায় জুড়ে দিল। জাভেদের মনের কোণায় এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। সে খুব সন্তর্পণে ফিলিং হোল দিয়ে এক্সপ্লসিভ ঢেলে নিয়ে শেষে স্ট্রাইকার লিভার জুড়ল। ব্যাস কমপ্লিট। জাভেদের চোখ উত্তেজনায় চিকচিক করছে। সে পাগলের মত হাসতে লাগল। হঠাৎ দরজায় কেউ যেন আওয়াজ করলো! সে বলল, কে? উত্তরে কান্দিল বলল, দরজা খোলো। জাভেদ দরজা খুলতেই কান্দিল জিজ্ঞাসা করলো কিছু হয়েছে কিনা? উত্তর না দিয়ে সে কান্দিলকে দেখতে লাগলো। রাতের বসনে তাকে আরও অপরূপ মায়াবী লাগছে। আনন্দের অনাবিল খুশিতে আজ সে কান্দিলকে জড়িয়ে ধরল। থতমত খেয়ে কান্দিল কোনভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘরে দৌড়ে পালালো।

সারদুলের সাথে খুব বেশি কথা হয়না জাভেদের। সে নিজের ঘরেই থাকে সারাদিন। সন্ধেবেলায় ফায়ার প্লেসটার সামনে সারদুল বসে গুনগুন করে একটা গান গাইছে। ওপর থেকে জাভেদ এসে বসলো টেবিলটার উল্টোদিকে। হাসিমুখে সারদুল ওকে ভাঙ্গা হিন্দিতেই জিজ্ঞাসা করলো তার কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। উত্তরে জাভেদ কেবল মাথা নাড়ল। আজ শীতটা জাঁকিয়ে পরেছে, কিচেন থেকে কান্দিল এলো ‘টূমুরো চাই’ নিয়ে। এটা একধরনের চা যা কিনা থাইম পাতা নামক একধরনের সুগন্ধি পাতা দিয়ে তৈরি করা হয়। এই কদিনে কান্দিল জাভেদকে অনেকভাবে বোঝার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনোভাবেই সফল হয়নি। কথা বলার চেষ্টা করলেও জাভেদ কোনোভাবেই সেই সুযোগ তাকে দেয়নি। সেদিনের সেই ঘটনায় এমনিতেই জাভেদ ভীষণ লজ্জিত। কান্দিল হাল্কা নীলচে চোখে অনেকবার তার পছন্দের কথা বোঝানোর চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। আজকে সে স্পেশাল ডিনার ডিস করবে, সেটা কান্দিল দুপুর থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। সেই মোতাবেক বুরুস শাপিক, হই লো গরমা আর শারবাত তৈরি হল। আজ সে ডিনার পেশ করতে করতে তার আব্বাকে লুকিয়ে জাভেদকে দেখে দুষ্টুমির হাসি ছুঁড়ে দিল। তার চোখে আজ অন্যরকম ইশারা। হুঞ্জার স্রোতের শব্দে সেই ভালবাসার কথা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বহুবার বললেও সেটা জাভেদ কে কোনোদিন মুখে বলা হয়নি। কিন্তু আজ যেন মন থেকে শব্দগুলো ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।

 

শাওলিন টেম্পল,

হেনান প্রভিন্স, চায়না

জুলাই শেষ সপ্তাহ ২০০৪

পাহাড় ঘেরা শাওলিনে এখন ভোর ৫টা বেজে ১০ মিনিট। প্রায় ৯ জনের একটা টিম, বিশেষত মেয়েদের টিম পাহাড়ি রাস্তায় এক কিলোমিটার দৌড়চ্ছে, ওদের জন্য বরাদ্দ ২০ মিনিট! একে অপরকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, প্রত্যেকে যেন এক একটা তেজিয়ান যৌবনের প্রতিমূর্তি। দৌড় কমপ্লিট হতেই একটা বিশেষ খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে ওদেরকে চতুষ্পদের মত ক্রলিং করে করে নামতে হবে। সকালের এই প্রথম ধাপের কসরৎ গুলো করতে প্রথমে অনেকটাই অসুবিধা হত, মাসল ক্র্যাম্প হত, কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এইভাবে সারাদিন ৭ ঘণ্টা করে কঠোর ট্রেনিং চলে সপ্তাহে ৭ দিন, বছরে ৩৬৫ দিন। ক্রলিং করে যে প্রথম এল সে হল স্যাভেন চি আর তার ঠিক পরেই এলো রাত্রি, কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম এই প্রচণ্ড শীতেও। 

রাত্রি আজ একবছর শাওলিন টেম্পলে উশুতে গ্রাজুয়েসন করছে। এখানে ঢোকাটা এই বয়েসে এতো সহজ ছিলোনা, কিন্তু কমলেশদার ইয়ান সি নামক একজন শাওলিন ড্রিল সার্জেন্টের সাথে পরিচয় থাকায় ওর সুবিধা হয়। বস্তুত রাত্রি ছোটবেলা থেকেই মার্শাল আর্টের সাথে যুক্ত আর বর্তমানে তার ব্ল্যাক বেল্টও আছে। তথাপি শাওলিন টেম্পলে উশু তার অনেকদিনের স্বপ্ন আর সেটা বাস্তবায়িত হয়েছে কমলেশদার জন্যই। উশু হল কুং ফুর একটা স্পোর্টস্‌ ভারসান। এখানে এসে অবধি অক্লান্ত পরিশ্রম আর সারাদিন ব্যাপি কঠোর ট্রেনিং-এ রাত্রির শরীর এখন আগের চেয়েও বেশি ছিপছিপে। কসরৎ রত রাত্রি কে একটা ধারালো ছুরির মত দেখাচ্ছে, তার পেশিগুলো এখন আরও মজবুত।

আজকে শাওলিনে বড় অনুষ্ঠান, মৃত অ্যাবটদের স্মরণ করে। প্রতিবছরই মার্চে এই শ্রদ্ধা অনুষ্ঠান করা হয়। প্রায় ২০০ এর মত পাথরের প্যাগোডা যেগুলো এক এক জন অ্যাবটের স্মরণে স্থাপিত, বিভিন্ন চিনামন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে বা বলা যেতে পারে গানের আদলে ওঁদের কে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। 

আজকের শাওলিন আগের চাইতে অনেক বেশি ব্যবসায়িক এক কেন্দ্র। শাওলিনকে খুলে দেওয়া হয়েছে দেশ বিদেশের পর্যটকদের জন্য। থিয়েটারে এখন মঙ্কদের নানারকম কসরৎ অভিনয়ের আদলে দেখানোও হয়। একসময়ের এই বৌদ্ধ মন্দিরকে এখন বৌদ্ধ ভূমিতে পর্যবসিত করা হয়েছে, তথাপি এর ঐতিহ্য ঠিক আগের মতই আছে। 

আজ অনুষ্ঠানের পর রাত্রিদের ব্যাচকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। আজকেই ওদের শেষ দিন। মনটা আজকে অনেকটা খারাপই লাগছে স্যাভেনের জন্য, ওই ছিল রাত্রির সবথেকে কাছের বন্ধু।

এক অস্ট্রিয়ান ভদ্রলোক, - বেঞ্জামিন এসে দাঁড়ালেন শাওলিনের মেন গেটটার বাইরে। তখন সব মঙ্করা এক এক করে বাইরে আসছে, কোমর নিচু করে অভিবাদন করছে বাইরে দাঁড়ানো তাদের গুরুদের। রাত্রি বেঞ্জামিন কে দেখতে পেল, চোখের ইশারায় তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলল। 

রাত্রি বুঝল এবার তাকে কাজে ফিরতে হবে। নেহাত কমলেশদা ছিল, তাই তার এই বিশেষ স্বপ্নটা পূরণ করা গেল। কমলেশদাই চীফেকে অনুরোধ করে এই এক বছরের ছুটিটা মঞ্জুর করিয়ে নিয়েছিলেন। বেঞ্জামিনের কালো অডিটায় চেপে ওরা দুজন বেইজিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

 

ভিয়েনা

অগাস্ট প্রথম সপ্তাহ, ২০০৪

ঝাঁ চকচকে ভিয়েনা ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট। কাঁচের অটোমেটিক গেটটা দিয়ে বেঞ্জামিন আর রাত্রি বেরোলো। বাইরে ওদের জন্য গাড়ি রেডিই ছিল, সেই নির্ধারিত কালো সেডানটায় চেপে ওরা রওনা হল শোয়েসসাট শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে থাকা ভিয়েনা শহরের সিটি সেন্টারের দিকে। মাত্র তিরিশ মিনিটের পথ। তারই মধ্যে ওরা পৌঁছে গেলো বেটোফেন, মোৎজার্তের স্মৃতিবিজড়িত শহরে। সকাল থেকেই বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ডার্ক কালারের একই রকম বাড়িগুলোকে বেশ চমৎকার দেখাচ্ছে। রাত্রি অষ্ট্রিয়ায় এই প্রথম এলো। বাস স্টপ থেকে দুজন ওদের পিছু নিয়েছিল। রাত্রি বুঝতে পেরে পেছনে সন্তর্পণে ঘুরে তাকাতেই দেখল, লং কোট পরে মাথায় টুপি দেওয়া তাদের একজন, কমলেশ মজুমদার, আর অন্যজন ব্লেজার পরিহিত মোহিত দুবে। মোহিত আর রাত্রি ব্যাচমেট, কমলেশদা চোখের ইশারা করায় ওরা প্রত্যেকেই নিজেদের মত হেঁটে চলল দ্যা লিও গ্র্যান্ড হোটেলের দিকে। পাঁচতলায় পাশাপাশি দুটো রুম নেওয়া ছিল। আপাতত ওরা তারই একটাতে রেস্ট নেওয়ার ভঙ্গিতে সোফায়, আর বিছানায় নিজেদের এলিয়ে দিল। বিছানার স্পর্শ পেতেই ক্লান্তিতে রাত্রির দুচোখ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ যখন খুলল তখন সূর্যাস্ত অনেকক্ষন হয়ে গেছে। কমলেশদা আর মোহিতকে সে দেখল না। অতঃপর ওয়াশ রুমে গিয়ে সে ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে নিল। খুব খিদে পেয়ে গেছিল। তাই মেনু দেখে একটা উইনের স্নিটজেল (এক ধরনের মাংসের কাটলেট) আর সসেজ অর্ডার দিল রাত্রি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বয় এসে সেগুলো সার্ভ করে দিয়ে গেল। এরই মধ্যে দরজায় বেল বাজলো। কমলেশদারা ফিরে এসেছেন। ওদের দেখেই রাত্রি বলল আরেকটা অর্ডার করে দিই? উত্তরে কমলেশদাই জানালেন ওরা বাইরে খেয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর ওরা তিনজনে মিলে বাইরে বেরোল। প্রথমে তারা গেলো আলবারটিনা মিউজিয়াম, পরে ভিয়েনা ষ্টেট অপেরার বাইরে গিয়ে ওরা মেইন গেটের বাইরে কারোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তবে মোহিত অপেরার ভিতরে গেছে কমলেশদার নির্দেশে।

গাড়িতে আসতে আসতে পেছনের সীটে কমলেশ বলেছিল একটা বিশেষ ইনপুটে তাদের এখানে আসা, আল কায়দা আর হুজির প্রত্যক্ষ মদতে একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছে। এফবিআই ইনটেল র’কে সতর্ক করেছে, সেই মত কাশ্মীর থেকে দুজনকে অ্যারেস্ট করে যেটুকু জানা গেছে তাতে ভিয়েনাতে কিছু একটা ঘটনা ঘটবে। কোন ফিদাইন হামলা হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায়না। বেঞ্জামিনের সম্পর্কে আগেই রাত্রিকে জানানো হয়েছিল, বেঞ্জামিন হলেন অস্ট্রিয়া আর্মি ইণ্টেলিজেন্স অফিসার। আপাতত সব প্রস্তুতি তুঙ্গে।

অপেরাতে তখন প্রায় ২৫০০ সঙ্গীত অনুরাগীর ভিড়, একজন বিখ্যাত জার্মান শিল্পী আজ ক্লাসিকাল গাইবেন। শো শুরু হয়ে গেল। স্টেট অপেরার বাইরে পুলিশে ছয়লাপ। তখনই একটা সাদা মার্সিডিজ প্রবল গতিতে এদিকে ছুটে এল। যখন আর প্রায় ৫০০ ফুট মত বাকি, গাড়ির ড্রাইভার দরজা খুলে দিল ঝাঁপ। পুলিশ গাড়িটিকে লক্ষ্য করে বুলেট বর্ষণ করতে লাগল। কমলেশ ও রাত্রি ঠিকঠাক পজিসান নিয়ে ড্রাইভারকে তাক করে পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়ছিলেন। কিন্তু ড্রাইভারের কাছে অটোমেটিক মেশিন গান থাকায় তারা তার সাথে মোকাবিলায় পেড়ে উঠছে না। রাত্রি কমলেশকে কভার দিতে বলে ওকে লক্ষ্য করে ছুটে গেলো। বিপদ আঁচ করে ড্রাইভার গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পেছন ফিরে দৌড়তে শুরু করলো। রাত্রি ওর থেকে আর খুব বেশি দূরে নেই! ছোটা পর্ব চলছে, এমন সময় উল্টো রাস্তা থেকে আসা একটা বাইকের থেকে গুলি বর্ষিত হল, তাতে সেই ড্রাইভার ঝাঁঝরা হয়ে গেল। রাত্রি কোনরকমে জাম্প কেটে বিলবোর্ডের মোটা থামটায় না লুকোলে নির্ঘাত সেও প্রাণে মরত। সেই গাড়িটিকে কোনভাবে ব্যারিকেডের কাছ পর্যন্ত ঝাঁজরা করে দিয়ে ক্ষান্ত করা গেল। পরে গাড়িতে প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক পাওয়া যায়। 

ড্রাইভারের পরিচয় পাওয়া গেলো, দিমিত্রি মারটিন। দিমিত্রি একজন অস্ট্রিয়ান নাগরিক, তার বাড়ি থেকে পরে বেশ কিছু নথি উদ্ধার করা হয় যেগুলো পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় আল কায়দা এই ঘটনার পেছনে ছিল। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দেখে রেইকি করতে আসা দিমিত্রির পাশে আরেকজনকে দেখা যায়। পুলিশ তার পরিচয় জানতে পারে, সে হল ক্লডিয়াস। ক্লডিয়াসকে পাওয়া গেলো ইনস্‌ব্রুকে, সে একটা ডেরায় আত্মগোপন করে ছিল। ক্লডিয়াসকে জেরা করার টিমে বেঞ্জামিন, কমলেশ, রাত্রি আর মোহিত তিনজনেই আছে। মূলত কমলেশ আর বেঞ্জামিনই জেরা পর্ব চালাচ্ছে, কিন্তু যখন সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠছে না তখন একজন ষণ্ডা মার্কা অস্ট্রিয়ান পুলিশ ঘুসিতে ঘুসিতে ক্লডিয়াসের শরীরটাকে একরকম চুরমার করে দিচ্ছে। ওর সারা শরীর বেয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, মুখটা ফুলে গেছে অসম্ভব ভাবে। একসময় আর সইতে পারলো না, ক্লডিয়াস এবার ভেঙে পড়ল। 

ক্লডিয়াসের কথায়, ওরা যেই প্ল্যান করেছিল সেটা তিনটে মূল ধর্মের মানুষের ওপর কেন্দ্র করে। স্টেট অপেরাতে সাধারণত কয়েক হাজার মানুষের ভিড় হয় আর যারা আসে তারা মুলত ক্যাথলিক, সেই ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের খতম করতে পারলে হাজার হাজার জিউরা শান্তি পায়। আর ক্লডিয়াস এই পবিত্র কাজের জন্য ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখে আসছে, তার বাবাও একজন কট্টর জিউ ছিল। দ্বিতীয় হামলা হবে বাংলাদেশে, কোথায় সেটা তার জানা নেই আর শেষ হামলা ইন্ডিয়াতে। তার কাছ থেকে অনেক চাপ দিয়ে একটা নাম পাওয়া গেলো, ফখরুল ইসলামের। ফখরুল মাস তিনেক আগেও ভিয়েনাতে ছিল, ওর সাথে আল কায়দার দুজন বড় মাপের নেতাও দেখা করে কিন্তু ক্লডিয়াস ওদের চেনেনা। ফখরুলই মুলত দিমিত্রি আর ক্লডিয়াসের সাথে যোগাযোগ রেখে চলত। গোপন ফোন কলের মাধ্যমে ওদের নির্দেশ দিত।

 

হুঞ্জা ভ্যালি

অগাস্ট প্রথম সপ্তাহ, ২০০৪

জাভেদ আজ প্রায় মাস সাতেক এখানে আছে, সে মিশনে থাকতে পারেনি। ওপার থেকে চীফের বার্তা এসেছিল, সে মেনে নিতে না পারলেও চীফ বলেছিল, সবুর করো মিয়াঁ, ইনশা আল্লাহ্‌ তোমার লগেও আল্লাহ তালাহ আরও বড় কিসু রেডি করতাসে। জাভেদ আর কথা বাড়ায় নি। তার জীবনে এখন অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। না চাইতেও সে কান্দিলের রূপের কাছে হেরে গেছে, পড়ে গেছে কান্দিলের প্রেমে, আর ওদের প্রেমের আগুন বয়ে নিয়ে চলেছে গোটা হুঞ্জা নদীটা, তবে সারদুল এর কানাকড়িও আঁচ করতে পারেনি। সারদুলের নাকের ডগায় প্রেমের আগুন ছুটছে প্রায় প্রতিটা রাত জুড়ে। কান্দিল কোনদিনও জাভেদের কাছে জানতে চায়নি ও কেন এখানে এসেছে, ও কী করে বা ওর বাড়ি ঠিক কোথায়। যদিও এগুলোর উত্তর প্রশ্ন করলেই যে পাওয়া যেত তেমনটা না। কান্দিলের ভীষণ ছবি আঁকার সখ, নদীর পাড়ে পাথরে বসে থাকা জাভেদের ছবি সে ওই প্যাস্টেলে দেবতার রূপে ফুটিয়ে তুলেছে।

দিনের চাইতে রাত গুলো আরো আপন ওদের দুজনের জন্য। তেমনই এক রাতে গোটা বাড়িটা ঘিরে ফেলল ইউ এস আর্মি আর নর্থ ফ্রন্টিয়ার কর্পসের সেনারা। কেউ টের পাওয়ার আগেই তারা ওপরে উঠে আসে আর তারপর অত্যাধুনিক মেশিন গান থেকে বুলেট বর্ষণ করতে থাকে। কান্দিলের গোটা শরীর সেই গুলিতে যখন ঝাঁজরা হচ্ছে সেই সময় কান্দিলকে একা ফেলে পালাতে বাধ্য হল জাভেদ। হুঞ্জা নদী পার করে সে জঙ্গলে ঢুকে কোনোরকমে প্রাণে বাঁচে। সেদিন জাভেদ বুঝেছিল ভালবাসা কত কঠিন হয়, রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা চিরে তার কান্নার হুঙ্কার রাতটাকে গ্রাস করেছিল। সাতদিন ছয়রাত এক করে কখনও হেঁটে, কখনও লিফট নিয়ে কোনভাবে সে ফিরেছিল তার ফেলে আসা বাংলাদেশের সীমানায়।    

 

সাতক্ষীরা, বাংলাদেশ

অগাস্ট দ্বিতীয় সপ্তাহ ২০০৪

একটা ঘুপচি ঘরে জাভেদ, ফখরুল, ইমতিয়াজ তিনজনের গোপন মিটিং চলছে। ফখরুল জাভেদকে বলল ইনশাল্লাহ,তুমি জোর বাঁচা বাইচ্চা গেসো, আল্লাহর নেক বান্দা তুমি তাই আল্লাহই তোমারে বাঁচাইছেন, তবে হান্নান ভাই, বিপুলভাই, রিপনভাই পুলিশের হেফাজতে। জাভেদ মাথা নিচু করে শুনছিল, বলল আপনাদের তো কইসিলাম কয়েকডা দিন পিছায়ে দেন। জাভেদ!! ধমকের সুরে ফখরুল জাভেদ কে বলল, এটা হান্নান ভাইজানের ডেসিসন। আমাগো কওনের কিসু নাই, তবে আরেকটা প্ল্যান করতে হইব। হাসিনা খুব উত্তেজিত হয়ে আছে, সুনতাসি একডা বড়সড় জমায়েত চায়তেসে ২১ এ। ফখরুল বলল, জাভেদ পারবা না তোমার কামডা শেষ করতে? জাভেদ বলল, পারুম ভাইজান। ইমতিয়াজ বলল “ইনশাআল্লাহ”। সাথে ফখরুল আরো বলল, আমাগো ভিয়েনার মিশন সাকসেস হয়নাই, যেই দুইজন অস্ট্রিয়ান ছিল ওই শালাদের একজন ধরা পরসে, একজনরে আমাগো লোকেরাই মারসে। শালা, ক্লডিয়াসটারে আমরা যদি হাতে পাইতাম! কি যে বমি করসে আল্লাহ্‌ই জানে। এহন থেইক্কা আমাগো অনেক সাবধানে পা ফেলতে হইবো। তোমার খবরডাও আমেরিকাগো কেডা দিসিলো? অনেক প্রশ্ন উঠতাসে। ইমতিয়াজ বলল ফখরুল ভাই, শুনছি ইন্ডিয়ার র’ ও নাকি বাংলাদ্যাস আইসা পরসে? ফখরুল বলল, হ, ওই কুত্তার বাচ্চারাও ইহানে আইসা পরসে, সাথে ইন্টারপোলও। র’ এর চীফ ডারে আমিই গুলি করমু দেইখ্যা নিস, কি যেন নাম, সমরেশ। কুত্তাটা আমারে ভোগাইতেসে অনেক বছর ধইরা। জাভেদ চুপ করে শুনছিল, সে বলল ফখরুল ভাই, ইন্ডিয়ার মিশন ডারে এহন ক্যান্সেল করেন। পরে ভাবা যাইব। ফখরুল চুপচাপ শুনলো।  তারপর বলল, কথাডা মন্দ কও নাই।

 

একটা পাঁচতারা হোটেল

ঢাকা

রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কামাল গাজি, রহিম মুস্তাফি বাচ্চু, কমলেশ, রাত্রি, মোহিত ভিয়েনার রুদ্ধশ্বাস ঘটনা নিয়ে অ্যানালিসিস করছিলেন। মিস্টার গাজি বললেন, আমাদের উয়িংসে কোনোরকম ইনপুট নেই তবে সিলেটে শাহ জালাল দরগায় ব্রিটিশ হাই কমিশনারের ওপর হামলার পর বিষয়গুলো একটু ঘেঁটে আছে। নির্দিষ্ট কোন পাকা ইনপুট নেই তবে খবর আছে ওরা হান্নান সহ বাকি তিনজনকে ছাড়াবার মরন কামড় দেবে। সাধারন মানুষের মধ্যেও উত্তেজনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তার ওপর আবার ইন্টারপোলের চাপ! বাই দ্য ওয়ে, হোয়াট  অ্যাবাউুট ফখরুল? বলল কমলেশ। বাচ্চু বললেন, ওর কোন ট্রেস পাওয়া যায়নি তবে বাপ যখন আছে ব্যাটাও যে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। প্রজেকটারের মাধ্যমে স্ক্রিনে একে একে ধৃতদের ছবি ভেসে আসছে, একসময় ফখরুলের ছবি ভেসে উঠল, জলপাই রঙা সৈনিক বেশী, ওর সাথে থাকা হান্নান, রিপন আর একটু পেছন দিকে শুধু মুখ ভেসে আছে, জাভেদ। রাত্রি বলল, পেছনের লোকটা কে? উত্তরে কামাল বললেন এর সেরকম কোন লিঙ্ক কোথাও পাইনি, তবে এর আগেও বেশ কিছু ছবিতে একে দেখতে পাওয়া গেছে। নাম জাভেদ খান, বয়েস আনুমানিক ২৬ এর বেশী। এছাড়া আমাদের কাছে জাভেদকে নিয়ে কিছু তথ্য নেই। হুজির কোন লিঙ্কম্যান হবে। তবে পাকিস্তানে এর কিছু গতিবিধি আমাদের নজরে ছিল।

সিলেট সেন্ট্রাল জেলে ওরা দুজন এল। রাত্রি আর মোহিত। কমলেশকে দিল্লিতে এক উচ্চ পর্যায়ের মিটিং সারতে যেতেই হল। আসার আগে ওরা কমলেশকে সিলেট এয়ারপোর্ট-এ ড্রপ করে দিয়ে এল। তিন জঙ্গিকে এখানে আলাদা আলাদা সেলে রাখা হয়েছে। একটা ফ্লোরে রিপন আর বিপুলকে রাখা হয়েছে, আর তার ওপরের ফ্লোরে হান্নান। আলাদা আলাদা, আবার একসাথে দুজন করে বসিয়ে জেরা করলো রাত্রি আর মোহিত। মুখ খোলানো খুবই কঠিন। শুধু কথার পৃষ্ঠে নতুন কথা এনে দিয়ে কথার জাগলারি করার চেষ্টা, সেসব এই ট্রেনড্‌ প্রথম শ্রেণীর জঙ্গিরা বেশ ভালই জানে। হান্নান শুধু বলল, ইন্ডিয়া থেকে আসছেন তো? ভালোয় ভালোয় ইন্ডিয়া ফেরত যান।

 

ঢাকা

২১ অগাস্ট  ২০০৪

বিগত ছয়মাস বাংলাদেশ যেভাবে বোমা গুলিতে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে তার চাপা উত্তেজনা গোটা বাংলাদেশের নাগরিক শিরায় বয়ে চলছিল। সেই ঘি-এ আগুন দিলো শাহ জালাল দরগার গ্রেনেড হামলা আর দ্বিতীয়ত গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের সদস্যদের উপর হামলা। লীগের উপর পুলিশি অত্যাচার সেটাও বোধহয় মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল আর তাছাড়া আওয়ামী লীগ হয়ত এরকমই একটা বিরোধিতার প্লট খুঁজছিল।

আজ ঢাকার রাস্তা সকাল থেকেই বেশ স্নিগ্ধ, রাত্রি বেরিয়েছিল মর্নিং ওয়াকে। তার পরণে একটা কালো স্পোর্টস জ্যাকেট, আর কালো ট্র্যাক স্যুট। কোলকাতা আর ঢাকায় খুব একটা পার্থক্য তার চোখে ধরা পড়ে নি ,আকাশে বাতাসে রাবীন্দ্রিক পরিবেশ, রঙিন রিক্সায় মনে হয় প্রজাপতি ভেসে বেরাচ্ছে। তবে বাতাসে খানিক বারুদের গন্ধও লেগে আছে যেন। 

সকাল থেকে আরেক দফা জেরা পর্ব চালাচ্ছিল মোহিত। এবারে রাত্রি এসে যোগ দিলো। থার্ড ডিগ্রি চলছে। মাথা নিচুতে পা ওপর থেকে ঝোলানো, হাতের নখ ওপড়ানো সব দফায় দফায় হয়েছে। কখনো আলাদা কখনও একসাথে বাংলাদেশ ইন্টেলিজেন্স আর রাত্রি বা মোহিত জেরা করছে। ইন্ডিয়া তে কী প্ল্যান আছে? আর কে কে আছে? কবে প্ল্যান! অপারেশান এক্স কী? একটা সময় রিপন শুধু অস্ফুটে ‘আআ…মি লীগ’ বলেই সংজ্ঞা হারালো। তখন রাত্রি জেরায় ছিল, সে ভাবতে লাগলো কি বলতে চাইল। উত্তর খুজে না পেয়ে পায়চারী করতে লাগলো সেন্ট্রাল জেলের করিডোর দিয়ে, দাঁত দিয়ে বিরক্তিতে নখ কাটছে। হঠাৎ ‘ইউরেকা!!! ইটস আওয়ামী লীগ’। পড়িমড়ি করে ওরা ছুটল, কিন্তু সময় অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে, বিকেল ৫ টা বাজে। পরপর পাঁচটা সেডান  ছুটল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দিকে, আওয়ামী লীগের ওখানে সদর দপ্তর। আজকে এক বিশাল সমাবেশ সেখানে। মুজিব কন্যা বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা দেশজুড়ে জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে আজ এক বিশাল সমাবেশ ডেকেছেন সদর দপ্তরের সামনে। ,এই সমাবেশ থেকেই আন্দোলনের রূপরেখা স্থির হবে আর সেই কারণেই কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি ভাষণ দেবেন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এর প্রায় দুই কিলোমিটার আগেই গাড়ি থামাতে হল, রাস্তাজুড়ে ব্যাপক ভিড়, বড় বড় ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড হাতে সমর্থকরা স্লোগান দিতে দিতে চলেছে। রাত্রি হাতঘড়িটা দেখল, ৫টা বেজে ১৫ মিনিট হল। ওরা সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে সদর দফতরের দিকে ছুটতে লাগল। রাস্তায় বাংলাদেশ পুলিশ ছেয়ে আছে কিন্তু ওদের ধারণা নেই কী ঘটতে চলেছে। যেকোনো ভাবেই মুজিবকন্যা কে আটকাতে হবে, ভিড় যেভাবে হয়েছে তাতে এই ভিড় কে কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়। কিন্তু মাইকে বিপদের ঘোষণা করাও ব্লান্ডার হয়ে যেতে পারে। প্রায় ১০ জনের টিম ছুটছে ভিড় ঠেলে, দুর্বার গতিতে। রাত্রি স্টেজের অনেকটাই কাছে এসে গেছে। প্রায় ৫০০ ফুট হবে, সোজা চওড়া রাস্তাটায় এখন কয়েক হাজার মানুষ, সাদা মুসলিম টুপিতে চারদিক ছয়লাপ। ওরা অনেক চেষ্টা করলেও আর সামনে এগোনো কঠিন হয়ে যাচ্ছে, সকলের চোখ চারিদিকে শ্যেন দৃষ্টিতে কাউকে খুঁজে চলেছে। হঠাৎ একজনকে পেছন থেকে দেখে চেনা লাগলো রাত্রির ,কোথায় যেন দেখেছি! আরে কালকে স্ক্রিনে দেখা জাভেদ না!! হঠাৎ, প্রবল বিস্ফোরণ!!! একটা দুটো… আরো অনেকগুলো, রাত্রি পাশের সরু গলিটায় ছিটকে পড়ল। পর পর ১৩ টা বিস্ফোরন!! চারিদিক প্রবল আওয়াজে তখন ভূমিকম্প হচ্ছে, শরীরটায় প্রবল যন্ত্রণা, মনে হচ্ছে শরীরে স্প্লিনটার এসে গেঁথেছে, সে ওই অবস্থাতেও গলিটা থেকে কোনভাবে বেড়িয়ে সামনের মঞ্চের দিকে এগোচ্ছে, হাতে পিস্তল… উল্টোদিক থেকে আহতদের ভিড় মাড়িয়ে খুব কাছেই সেই চেনা লোকটাকে দেখে রাত্রি প্রথমটায় হকচকিয়ে যায়, গায়ে আঘাতের চাপ চাপ রক্ত নিয়ে হিংস্র চোখে তখন জাভেদ আগুন ছুঁড়ছে রাত্রির দিকে … হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেতেই রাত্রি গুলি ছুঁড়ল। গুরুম গুরুম দুটো… একটা কাঁধের গা ঘেঁষে আরেকটা বাম হাতের পেশিকে ছিন্ন করে বেড়িয়ে গেলো। আচমকা জাভেদ একটা আধলা ইট ছুঁড়ে মারল রাত্রির মুখের দিকে তাক করে। গলার কাছে এসে ইটটা আঘাত হানতেই রাত্রি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো রাত্রি, কিন্তু সে সফল হতে পারলো না। জাভেদ এসে নির্মম ভাবে লাথি মেরে ওর পাঁজর ভাঙ্গার চেষ্টা করে গলিটায় ঢুকে গায়েব হল। চারিদিকে সেইসময় লাশের পাহাড় আর সেই পাহাড়ে পাইন গাছের মত দাঁড়িয়ে আছে আহত ছিন্নভিন্ন শয়ে শয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক।     

 

দিল্লি

৫ইসেপ্টেম্বর,২০১১ সকাল ৮ টা

ল্যান্ডিং এর সতর্ক বার্তায় ও সিট বেল্ট পরার ঘোষণায় রাত্রির ঘুমটা ভেঙে গেল। সে একটু সোজা হয়ে নড়েচড়ে বসল। আজ অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও ঘুমের মধ্যেও সে জাভেদের জ্বলন্ত ভাটার মত চোখদুটো স্পষ্ট দেখতে পায়। ওই পিশাচস্বরূপ মুখ সে কোনদিনও ভুলতে পারবে না। সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় হারিয়েছে তার ব্যাচমেট মোহিতকে। প্লেন ল্যান্ড করলো ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্টে, বাইরে আসতেই রাত্রির মোবাইলে একটা বিপ শব্দ হল, সে মোবাইল বের করে মেসেজ দেখল, একটা গাড়ির নম্বর। সাবধানে ভিড় এড়িয়ে আরেকটু সামনে এগোতেই একটা টয়োটা সিডানের নম্বরের সাথে তার মেসেজে দেওয়া নম্বর মিলে গেল। রাত্রি উঠে বসল। ভেতরে একজন ভদ্রলোক অপেক্ষায়। হ্যালো! দিস ইস সুরিন্দর কোহলি ম্যাম, ওয়েলকাম টু ডেলহি।

গাড়িটা লোধি রোডের সদর দপ্তরে নয় বরং তুলনায় একটা সরু গলিতে এসে থামল একটা পুরনো দিনের বাড়ির সামনে। সুরিন্দর এগিয়ে গিয়ে গেটম্যানকে কিছু বলল, তারপর ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। ওরা একটা পুরনো গ্যারাজের ভেতর দিয়ে যেতে লাগল, জায়গাটা খানিক অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে সামান্য আলোকিত করেছে পুরনো দিনের দুটো ফিলামেন্ট বালব্‌। এরপর একটা সিঁড়ি ভেঙে দোতালায় উঠে কোলাপ্‌সিবল পেরিয়ে ডানদিকে যেতেই একটা পুরনো লিফট, সেটায় চেপে পাঁচতলায় পৌঁছল ওরা। একটা ক্যুরিয়ার কোম্পানির অফিসের ভেতর দিয়ে ওরা ঢুকল। দুই জোড়া চোখ একটু ভুরু কুঁচকিয়ে দেখল ওদের। ভেতরের একটা টয়লেটে এসে ঢুকল ওরা। একটা ঝুলন্ত আয়না সরিয়ে সুরিন্দর লাল বোতামটা টিপল। তার প্রতিক্রিয়ায় পাশের দেওয়াল থেকে একটা স্ক্যানার বেড়িয়ে এল, আর সেখানে আই কার্ড দেখিয়ে ওরা দুজন একটা সম্পূর্ণ আলো ঝলমলে জগতে প্রবেশ করল। রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংস-এর একটা গুপ্ত অফিস। প্রায় ১৪-১৫ টা ডেস্কের সবগুলোতেই ব্যাস্ততা। আমান নেগি ওদের দেখে এগিয়ে এলেন। কাম ইনসাইড মাই রুম। ওরা দুজন ভেতরে গেল। নেগি, রোহিত চৌহানকে ডাকল। রোহিত ডেমো দেওয়া শুরু করল। “অপারেশন হিন্দ”, হুজি আর আল কায়দার একটা বিশেষ মিশন। এটা একটা পোস্টপন্ড হয়ে যাওয়া মিশন। ২০০৪ মিশন-এক্স এর একটা এক্সটেন্ডেড্‌ ভারসান, আর ইনপুট আছে জাভেদ এটা লিড করছে। রাত্রি ইউ মেট হিম বিফোর না? রাত্রি বলল, ইয়েস স্যার, তবে তমাল স্যারের ইনপুট বলছে, জাভেদ এখন ইন্ডিয়াতেই আর ওর সাথে আরও চারজন এসেছে। তাছাড়া ওনার তথ্য বলছে, মানে আমি পেন ড্রাইভে যা দেখেছি সেটা আপনাদেরও দেখার দরকার আছে। এই বলে রাত্রি পেন ড্রাইভটা রোহিতকে এগিয়ে দিল। একে একে স্লাইডগুলো রোহিত প্লে করতে লাগলো। বেশ কিছু ছবি বাংলাদেশ ক্যাম্পের আর আফগানিস্তানের,সবগুলোতেই কমবেশি জাভেদ আছে, কিছু সি-ফোর টেস্টিং, কিছু গ্রেনেড টেস্টিং - এসবের ছবি, কিছু অডিও ক্লিপিংস এল। সেগুলো প্লে করতেই কাটা কাটা কিছু কথা শোনা গেল, ‘আলহামদুল্লা ভাইজান! আম্মার লগে আইসা গেসি। রেড কটে তিনবার দেখা হইসে, সব ঠিক। আপনে নিশ্চিন্ত থাহেন।’ ভাইজান বলল, পাঁচ দাগেই সেলাই দিও। ইনশাআল্লাহ।’ 

স্যার, আমি যখন থেকে শুনেছি কিন্তু… বলেই রাত্রি মাথায় হাত দিয়ে গাটা এলিয়ে দিলো চেয়ারটায়। নেগি স্যার বললেন, আমার কাছে যা খবর তাতে বেশকিছু বিস্ফোরক বেঙ্গল হয়েই এসেছে। তার মধ্যে প্রায় ১০ কেজি ডেলহি পুলিশ উদ্ধার করেছে। বাট হোয়াট অ্যাবউট দা কনভারসেসন? 

দুটো লাইন খুব খটকা লাগছে, এক রেড কট, আরেকটা ৫ দাগ। এটা স্যার বলার জাগলারি নয় তো, হি মিন্স টু সে রেড ফোর্ট! রাত্রি বলতেই নেগির চোখ চকচক করে উঠল, এক্সসেলেন্ট! দ্যাটস হোয়াই কমলেশ লাইকড ইউ অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবউট দা সেকন্ড ওয়ান? 

ভাবতে দিন প্লিজ…সেলাই মানে অ্যাকশন কিন্তু ৫ দাগ! বলে রাত্রি আবার মাথায় হাত দিয়ে চিন্তায় ডুব দিল। নেগির কল তখন আই জি সিনহার কাছে চলে গেছে ওদের সতর্ক করার জন্য। কথা চলছে, অমনি রাত্রি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ইটস টুডে স্যার, ইটস ফিফথ্‌! ওইদেশের কেউ কেউ তারিখকে দাগ বলে থাকে স্যার। 

তখন ঘড়িতে ৯ টা ১০ বাজে, রাত্রি আর সুরিন্দর ছুটল লাল কেল্লার দিকে। সিকিউরিটি আই জি সিনহার সাথে কথা বলে অলরেডি বাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। সুরিন্দর ডেলহি পুলিশের সাথে কথা বলে নিতে লাগল ডিটেইলসে। খানিক পরে ওরা পৌঁছে যেতেই দেখল গোটা রেড ফোর্টকে পুলিশের নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছে। ওরা ভেতরে প্রবেশ করল। একটা খটকা রাত্রির মনে কেমন লেগে রয়েছে। সুরিন্দর জিজ্ঞাসা করলো, রাত্রি ম্যাম আর ইউ অলরাইট? রাত্রি বলল দেখো, আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমার। ওরা মোটামুটি চারিদিক ঘুরে কথা বলেছে, ওপরে স্নাইপার টিমের কাছে গিয়েও পর্যবেক্ষণ করেছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৯ টা ৪৫ বাজে। হঠাৎ নেগি স্যারকে আসতে দেখে ওরা নীচে এগিয়ে গেলো আপডেট দিতে। নেগি স্যারের কালো ব্লেজারটা গরমের জন্য হাতে নেওয়া, এভ্রিথিং অলরাইট? হঠাৎ রাত্রির কি একটা মনে হল, স্যার ইটস মে নট বি ফোর্ট, ইট মে বি কোর্ট, আইদার হাই অর সুপ্রিম কোর্ট স্যার। নেগির ভুরু কুঁচকে গেলো, তড়িঘড়ি উয়িংস-এর আরও একটা টিমকে পাঠানো হল সুপ্রিম কোর্টের দিকে আর রাত্রি আর সুরিন্দর ছুটল হাই কোর্টের দিকে। নেগি স্যার পুলিশের বড়কর্তার সাথে কথা সেরে নিয়ে পিএমও ছুটলেন।

মাত্র দশ মিনিটের মাথায় ওরা হাই কোর্ট পৌঁছে গেল। টাইট সিকিউরিটির বন্দোবস্ত বা বলা যেতে পারে তার তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। রাত্রি সুরিন্দরকে ডিসিপি রাউতের সাথে পুরোটা চেকিং করে নিতে বলে নিজে চলল কন্ট্রোল রুমের দিকে। পুরনো তথ্য চেকিং চলছে লাস্ট ২-৩ ঘণ্টার, রাত্রি খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ তার চোখ চলে গেল পাশে থাকা ১৪ নম্বর ক্যামেরার ফুটেজের দিকে। একজন উকিলের পোশাকে কোর্টে ঢুকছেন। রাত্রি জুম করতে বলল আর জুম হতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। জাভেদ। তার হাতে একটা সুইকেস। বাস্টার্ড! বলেই সে চেয়ার ছেড়ে বেড়িয়ে করিডোর দিয়ে দৌড়তে লাগলো ৫ নম্বর মেন গেটের দিকে। তার সারা শরীরের শিরা তখন উত্তেজনায় ফুটছে। রিসেপশনের লাইনে তখন শয়ে শয়ে সাধারণ মানুষের, উকিলের ভিড়। রাত্রি জাভেদকে দেখতে পেল, তার হাতের সুটকেসটা আর নেই। সুরিন্দরসহ বিশাল একটা টিম বম্ব-স্কোয়াড, স্নিফার ডগ নিয়ে চারদিক চষতে শুরু করেছে। রাত্রি দেখল ভিড়ের পাশ কাটিয়ে জাভেদ বেড়িয়ে যাচ্ছে। রাত্রি তার পিস্তল উচিঁয়ে ছুটতে লাগলো, এতো ভিড়ে গুলি করাও যে অসম্ভব।

হঠাৎ, তীব্র বিস্ফোরণ!!! একটা ভূমিকম্পে গোটা চত্বরটা কেঁপে উঠল। কানে তালা ধরে যাওয়া সেই শব্দ এতোটাই প্রবল যে খানিকক্ষনের জন্য সবার কানে একটা সরু তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ ছাড়া আর কোনোকিছুই আসছিল না। রাত্রি শরীরটাকে টেনে তুলে বাইরে যেদিকে জাভেদ বেড়িয়ে গেল সেদিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটল। চারিদিকে পোড়া মাংসের গন্ধ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশ ঢেকে দিয়েছে। সুরিন্দর রাত্রির দিকে দৌড়ে এসে বলল, ম্যাম আর ইউ ওকে? ক্যাচ দ্যাট বাস্টার্ড সুরিন্দর…

সুরিন্দর ছুটে বেড়িয়ে গেলো, পেছনে রাত্রি। সুরিন্দর ওকে দেখতে পাচ্ছে, পেছনে দুরন্ত গতিতে ছুটছে। হঠাৎ একটা বাইক এসে জাভেদের সামনে দাঁড়াতেই জাভেদ চেপে বসল। জাভেদ বসতেই বাইকটা ধোঁয়া উড়িয়ে বেড়িয়ে গেল। রাত্রিকে ডেলহি পুলিশের একটা জিপ তুলে নিতেই গাড়িটা বাইকটাকে চেজ্‌ করতে শুরু করল, গাড়ির  স্পিডোমিটারের কাঁটা তখন ১০০ পার, বাইকও ততোধিক গতিতে প্রায় পাঁচশো মিটার আগে ছুটছে। রাত্রির সারা শরীরে প্রবল যন্ত্রণা, মাথার পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছে, কিন্তু উত্তেজনায় ওর হৃদপিণ্ড দ্বিগুণ গতিতে সারা শরীরের শিরায় শিরায় আগুন হয়ে ছোটাচ্ছে, হাতে মুষ্টিবদ্ধ বেরেট্টা ৯২ সেমি অটোমেটিক পিস্তল। বাইক তখন হুমায়ুন টম্ব পেরিয়ে দিল্লি নয়ডা ফ্লাইওভারে নয়ডার দিকে। দুরত্ব খানিকটা কমেছে। রাত্রি কাঁচের বাইরে শরীরটা বের করে বাইকের দিকে পিস্তল তাক করেছে। কিন্তু দুরত্ব তার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাত্রি ট্রিগারে চাপ দিল, গুরুম গুরুম শব্দে কানফাটানো দুখানা বুলেট হাওয়া চিরে বাইক লক্ষ্য করে ধেয়ে গেল… আরেকটা ফায়ার, এবার জাভেদের পিঠ ফুঁড়ে গুলিটা ওকে ধরাশায়ী করতেই ও বাইক থেকে পড়ে গেল, জীপটা জাভেদের কাছে এসে পড়তেই রাত্রি ওদের বলল - গো, আই উইল হ্যান্ডল, ইউ গো অ্যান্ড ক্যাচ দ্যা বাইক…

যমুনা নদীর বাতাসে তখন কেমন বারুদের গন্ধ, হাওয়া থমকে গেছে। রাত্রি জাভেদের টেনে এগিয়ে যেতে চাওয়া শরীরের কাছে এসে দাঁড়ালো, তারপর বেশ কয়েকটা ফায়ার করে জাভেদকে পুরোপুরি খতম করে ওখানেই ধপাস করে বসে পড়ল। ওর শরীরে আর একফোঁটা শক্তিও নেই, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। পরপর তিনটে কালো পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো সামনে… রাত্রি তখন ওখানেই ঢলে পড়েছে।

 

***** 



 

0 Comments
Leave a reply