উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (ছবি - উইকিপিডিয়া)
উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের শুরুর কয়েক দশকে কলকাতায় কিছু শিক্ষিত এবং উদ্যোগী পরিবারের চেষ্টায় যে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ঘটনা তার আগে বা পরে আর কখনই তেমন দেখা যায়নি। এই পরিবারগুলির মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ধর্ম পরিচয়ে ব্রাহ্ম। এদের মধ্যে, আজকের ভাষায় বললে, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ছিল দেখার মত। যেহেতু তখন চিঠি লেখার চল ছিল আর এইসব পরিবারে সেইসব চিঠি সংরক্ষিত হয়েছে, ফলে আমরা এখন এই পরিবারগুলির সদস্যদের মধ্যে সংযোগের কথা জানতে পারি। সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নিজে একদিকে যেমন লেখালেখির কাজ, নিজের স্কুল পরিচালনার কাজ, কিংবা পত্রিকা সম্পাদনা ইত্যাদি করতেন, সেইরকম তিনিই আবার অন্যদিকে এই পরিবারগুলির মধ্যে যোগসূত্র ধরে রেখেছিলেন। সেইসময়ের কলকাতার, ভারতের বা বিশ্বের অজস্র গুণী ব্যক্তির সাথে ওনার নিয়মিত পত্রালাপ চলত। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ অজস্র মানুষের সাথে দীর্ঘকালীন সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব যে সেই সময়ের কলকাতার আরেকটি বিখ্যাত ব্রাহ্ম পরিবার, রায়চৌধুরী বা রায়েদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ঠিক কেমন ছিল।
ময়মনসিংহ থেকে উপেন্দ্রকিশোরের কলকাতা আসার পথটা ছিল তৎকালীন বঙ্গদেশের আর দশটা গ্রামের ছেলের মতই জলপানির হাত ধরে। স্কুলের পড়া শেষ করে তারপর স্কলারশিপ নিয়ে কলকাতায় কলেজ। আর এই কলকাতায় এসেই আরও অনেক প্রতিভাবান, আধুনিকমনস্ক তরুণের মত উপেন্দ্রকিশোর আকৃষ্ট হলেন ব্রাহ্মধর্মের প্রতি। সেটা বোধহয় তখন অনিবার্যই ছিল। যদি সেই ১৮৮০ দশকের কোনও তরুণ কলকাতায় একটু আধুনিক আলোচনা, গান, নাটক, বিজ্ঞানের কথা ইত্যাদি শুনতে চাইতেন, তাহলে ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব এড়িয়ে কলকাতায় থাকা একরকম অসম্ভব ছিল। বাকি কলকাতায় তখন আর কী ছিল? পার্ক স্ট্রিট, ধর্মতলা ইত্যাদি তখন ইংরেজদের আবাস। তারা বাড়িতে ডেকে চা খাওয়াতে পারে, কিন্তু আপন করে তো আর নেবে না। তার ওপর তাদের মধ্যে অনেকেই বেশ জাতিবিদ্বেষী। সবচেয়ে বড় কথা, ইংরেজদের যেসব লোক ভারতে এসেছে, তারা কেউই তাদের দেশের প্রতিভাবান লোক নয়। এরা হল কলোনিয়াল শাসন চালানোর মত ঝড়তিপড়তি লোক। এরা ঠিক উচ্চমনের কলকাতার বাঙালির মননশীলতার স্তরের নয়। সুতরাং তাদের সমাজে গিয়ে খুব বেশি ফায়দা হবে না। অন্যদিকে কলকাতায় নানা জাতের লোকের বাস। ইহুদি, জাপানি, চীনা, রাজপুত, বর্মার লোক ইত্যাদি। সবাই এসেছে ইংরেজ রাজধানীতে ব্যবসা করে খেতে। সেখানে বাঙালি আলোচনা বা আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের আলোচনা হবে না। এরা লাভ লোকসানের হিসাব করতে এসেছে। এদের কাছে খুব জোর জাহাজের আসার খবর, কাপড়ের দাম বা নেশার দ্রব্যের খবর মিলতে পারে। আর দক্ষিণ কলকাতার দিকটা তখন জঙ্গল, ডোবা, খাল-বিল। মাঝে মাঝে বাঘরোল, শিয়াল আর বাঘের পদচারণা। ফলে যদি সপ্তাহান্তে একটু গান-বাজনা করতে হয়, লোকের সাথে খিস্তি খেউড় বা পরনিন্দা না করে সাধারণ ভদ্র আলোচনা করতেই হয়, উপায় হল ওই ঠাকুরবাড়ি বা ব্রাহ্ম মন্দিরের আড্ডায় যাওয়া। সেই সময়ে রেনেসাঁ পুরুষের মধ্যে বিদ্যাসাগর ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই ১৮৭৩ সাল থেকেই উনি কার্মাটারে। আর বিদ্যাসাগর ঠিক সপ্তাহান্তে গান-বাজনা করার লোক নন। আরেকজন ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। কিন্তু উনিও তো সরকারি চাকরিতে আজ চুঁচুড়া, কাল যশোর।
তরুণ উপেন্দ্রকিশোর বেহালা হাতে নিয়ে তাই একটা সময়ে ঠাকুরবাড়ি যাওয়া শুরু করলেন। আর সেখানেই আলাপ বছর বাইশের তরুণ রবীন্দ্রনাথের সাথে। রবীন্দ্রনাথের তখন সবে বিয়ে হয়েছে আর সেই ১৮৮৪ সালেই ওনার জীবনে একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা নেমে এসেছে - কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু। ফলে সেই তরুণ আরও বেশি করে ব্রাহ্মসঙ্গীত ইত্যাদিতে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছেন আর উপেন্দ্রকিশোর সেইসব সঙ্গীতের আসরে বাজনা বাজাচ্ছেন। একজন একুশ আর আরেকজন তেইশ। এই বয়সে কী আর বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে? বিশেষত যদি সৃষ্টিশীলতার প্রতিভা থাকে?
ইতিমধ্যে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি উপেন্দ্রকিশোরের ভালবাসা আরও বেড়েছে। উনি সেই ধর্ম গ্রহণ করেছেন। আর বিবাহ হয়েছে ব্রাহ্মদের মধ্যে একজন বিখ্যাত সদস্য, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির মেয়ে বিধুমুখী দেবীর সাথে। এরপর উপেন্দ্রকিশোর যতই ব্রাহ্ম অনুষ্ঠানে যুক্ত হলেন, নানা বই লিখলেন, ব্রাহ্মসঙ্গীত লিখলেন, ততই রবীন্দ্রনাথের সাথে বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল। রবীন্দ্রনাথ বন্ধুদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে তাদের সৃষ্টির প্রতিভার বিকাশকে উজ্জীবিত করতেন। তাই তরুণ উপেন্দ্রকিশোরকে দিয়ে উনি “নদী” গ্রন্থের ছবি আঁকালেন। এছাড়া জোড়াসাঁকোয় যে কোনও অনুষ্ঠান মানেই রবীন্দ্রনাথের নতুন গান, আর সেই গান মানেই উপেন্দ্রকিশোরের বেহালা। উপেন্দ্রকিশোর সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের স্বরলিপিও লিখেছিলেন। আসলে সেই সময়ে সেই ব্রাহ্ম পরিমণ্ডলে এটাই স্বাভাবিক ছিল। একজন গান লিখবেন, আরেকজন বাজনা বাজাবেন, আরও আরেকজন সেটা ছাপবেন ইত্যাদি। এভাবেই সেই কয়’বছরে বাঙালি সৃষ্টিশীলতা শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছিল। অবশ্য একটা ব্যবসায়িক দিকও ছিল এইসব কাজের। উপেন্দ্রকিশোরের মত যে সব বাঙালি তরুণ ধর্ম পরিবর্তন করতেন, অনিবার্য ভাবেই তাদের পারিবারিক অশান্তি হত এবং পিতার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য কমে যেত বা বন্ধ হয়ে যেত। ফলে লেখালেখিটা তাদের শখে নয়, কিছুটা প্রয়োজনেও। রবীন্দ্রনাথ এটা বুঝতেন এবং এদের সাহায্য করতেন।
ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় হয়েছে রায় পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের। উপেন্দ্রকিশোর যদিও পালিত জমিদার পিতার সূত্রে “কিশোর” নামটি পেয়েছিলেন, কিন্তু উনি ফিউডাল সমাজে বিশ্বাসী ছিলেন না। নিজের পরিবারে ডাইন্যাস্টি শুরু করার কোনও ইচ্ছা ওনার ছিল না। ফলে ছেলে-মেয়েদের নামে উনি সেই “কিশোর” কথাটি বাদ দিয়েছিলেন এবং উপাধি থেকেও “চৌধুরী” শব্দটি ছেঁটে ফেলেছিলেন। এমনকি বায়োলজিক্যাল পিতার দেওয়া “রঞ্জন” মধ্যনামটিও উনি বাদ দিয়ে, ছেলে মেয়েদের নাম দিলেন আধুনিক আর্বান বাঙালি অনুপ্রেরণায়। ওনার ছেলেমেয়েদের নাম দেখলেই সেটা বোঝা যায়। সেই সময়ে বন্ধু রবীন্দ্রনাথের “রাজর্ষি” উপন্যাস প্রকাশ পেয়েছে। সেই উপন্যাসের এক চরিত্রের নামে উনি ছেলের ডাকনাম রাখলেন “তাতা”। এই তাতাই সুকুমার রায়। তাতা পরে রবীন্দ্রনাথের সাথে বহু ব্যাপারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বেন।
সুকুমার রায় (ছবি - উইকিপিডিয়া)
সুকুমার রায় কলেজ জীবন থেকেই সংস্কৃতির সাথে যুক্ত। কখনও করছেন ননসেন্স ক্লাব আবার কখনও ব্রাহ্ম সঙ্গীত লিখছেন। ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে উনি সেই অনুষ্ঠানে বেশ ভালোভাবে যুক্ত ছিলেন। এরপর সুকুমার গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ নিয়ে ম্যানচেস্টারে গেলেন ছাপার কাজ শিখতে আর ঠিক তার পরের বছর রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে গেলেন নিজের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে। সেখানে অবশ্যই এই দুই বাঙালির মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হল, বহু সময় এরা একসাথে কাটালেন। ১৯১২ সালে লন্ডনে সুকুমার “স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ” নামে একটি বক্তৃতা দিলেন, যেটা পরবর্তীকালে একটা স্থানীয় কাগজে প্রকাশিতও হল। শোনা যায় এই সময়ে লন্ডনে পয়লা মের অনুষ্ঠানে সুকুমার কবির সামনে “জনগণমন” সঙ্গীত নিজের গলায় শুনিয়েছিলেন। অবশ্য সেটা তখন শুধুই একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত! এছাড়া উনি রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন, যদিও সেই অনুবাদ কোথায় হারিয়ে গেছে তা জানা নেই। ইংল্যান্ডে সুকুমার, রবীন্দ্রনাথ এবং প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশঃ এই তিনজনের বন্ধুত্ব খুব দৃঢ় হল এবং তিনজনেই আমৃত্যু একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরপর এল ১৯১৩ সাল।
১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বরে “সিটি অফ লাহোর” জাহাজে রবীন্দ্রনাথ বোম্বে ফিরলেন। সঙ্গে সুকুমার রায়। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর। এই দীর্ঘ জাহাজযাত্রায় সুকুমার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী। ফলে পরিচয় এবং মনের মিল আরও দৃঢ় হল। বাবা উপেন্দ্রকিশোর তখন কলকাতায়। একদিকে ডায়াবেটিসের সাথে যুদ্ধ করছেন আর অন্যদিকে সেই বছরেই “সন্দেশ” প্রকাশ করেছেন। সেপ্টেম্বরে তারা এসে নামলেন ভারতে। এরপর নভেম্বরে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার খবর এল। কিন্তু অতো কম সময়ে রবীন্দ্রনাথ আর সুইডেন যাওয়ার সময় পেলেন না। ১০ই ডিসেম্বর রইলেন নিজের বাড়িতেই। বরং তার তিনদিন পরে, ১৩ই ডিসেম্বর, উনি সুকুমারের বিয়েতে যোগ দিলেন কলকাতায়। সুকুমার তো ওনার “যুবক বন্ধু”; সেই সাথে তার নতুন বউ, সুপ্রভার গানের গলাও ছিল রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রিয়। কেমন প্রিয়? তাহলে শুনুন। রবীন্দ্রনাথ তো নোবেল প্রাইজ পেলেন, বাংলায় খুব হইহল্লা শুরু হল। পরের মাসে, অর্থাৎ ১৯১৪র জানুয়ারিতে যখন কলকাতায় রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল, তখন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সুকুমার। আর গান গাইছেন? সুপ্রভা রায়। সুকুমার রায় বাবার মতোই আধুনিক প্রযুক্তির খুব বড় সমর্থক ছিলেন। ওনার বিষয় ছিল ছবি তোলা। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক বিরল ছবি আমরা পেয়েছি শুধুমাত্র সুকুমার রায় ক্যামেরা নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন বলে। ছবি তো অনেকেই তুলতে পারত। কিন্তু ক্যামেরার পেছনে সুকুমার রায় থাকা, আর অন্য একজন ফটোগ্রাফার থাকা তো আর এক জিনিস নয়। তাই না?
১৯১৩ সালে দেশে ফিরেই সুকুমারের প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। বাবার হাত থেকে সন্দেশের দায়িত্বভার নিয়ে নিলেন। অবশ্য উপেন্দ্রকিশোর তখন অসুস্থ। ডায়াবেটিস বাড়ছে। আর ওদিকে ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ইনসুলিনের সরবরাহ বন্ধ। ১৯১৫ সালে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হল। সুকুমারের কিন্তু থামার সময় নেই। একদিকে “মন্ডা ক্লাব”, অন্যদিকে সন্দেশ। আর অন্যদিকে ব্রাহ্ম সমাজের কর্তা হিসাবে কাজকর্ম। মাঝে মাঝেই যাচ্ছেন শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথের নানা কাজে যুক্ত, গান শোনাচ্ছেন কবিগুরুকে, স্বামী স্ত্রী মিলেই। সন্দেশে রবীন্দ্রনাথও অনেক লেখা দিচ্ছেন। সন্দেশ তখন আর বাঙালির অলস কল্পনাবিলাসের ম্যাগাজিন নয়। সারা পৃথিবীর খবর দেওয়ার মাধ্যম। এই সময়ে উনি রবীন্দ্রনাথের একটা উপকার করেছিলেন। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে রবীন্দ্রনাথের সদস্যপদ করিয়ে দেওয়া।
চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে বাংলায় সুকুমারের প্রতিভার প্রকাশ। কিন্তু ১৯২১ সালে সত্যজিতের জন্মের পরেই সুকুমারের দেহে দেখা দিল কালাজ্বর। তার চিকিৎসা কোথায়? অন্য আরেক বাঙালি, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে। সুকুমারের তাতে কোনও লাভ হবে না। তাও মাঝে মাঝে যাচ্ছেন শান্তিনিকেতন। একবার এভাবেই গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ছেলের নাম বলে দিন না।” রবীন্দ্রনাথ বললেন, সহজ বা সরিৎ। কিন্তু সুকুমারের পছন্দ হল না। উনি ছেলের একটা ঝকঝকে স্মার্ট নাম দিলেন, সত্যজিৎ। নইলে আজকে আমরা পথের পাঁচালির পরিচালক হিসাবে সরিৎ রায়ের নাম করতাম! তখন রবীন্দ্রনাথের জীবনে একটা উপদ্রব ছিল এই সারা বাংলা থেকে নবজাতকের নাম দেওয়ার জন্য অনুরোধ। তবে সুকুমার স্বাধীনচেতা ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন মানেই সেই নাম মেনে নিতে হবে, এরকম মানসিকতা ওনার ছিল না। ফলে সত্যজিতের নাম তাঁর বাবা সুকুমারের দেওয়া, রবীন্দ্রনাথের নয়। সত্যজিৎ একটু একটু করে বড় হচ্ছেন, এমন সময় চলে গেলেন সুকুমার।
সেটা ১৯২৩ সাল। সুকুমার প্রচণ্ড অসুস্থ। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ পাঠালেন একবার বাড়িতে আসার জন্য। বাড়ি মানে সেই ১০০ গড়পার রোড। উপেন্দ্রকিশোরের তৈরি বিখ্যাত বাড়ি। মনে রাখতে হবে যে রবীন্দ্রনাথ তখন নোবেল পেয়েছেন ১০ বছর হয়ে গেছে। উনি তখন একজন চলমান প্রতিষ্ঠান। যেখানে যান, লোক উপচে পড়ে। রাস্তায় ভিড় জমে যায়। গাড়িঘোড়া আটকে যায়। তাও রবীন্দ্রনাথ তার এই তরুণ বন্ধুর আমন্ত্রণে এলেন। তার রোগশয্যার পাশে বসলেন। তার অনুরোধে গান শোনালেন তাকে। এসেছেন অনেকবার। শেষ বোধহয় এসেছিলেন ১৯২৩ সালের ২৯ অগস্ট। সুকুমারের তখন শেষ অবস্থা। সেই অবস্থায় সুকুমারের শয্যার পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে সুর রচনা করে একটি গান শোনালেন। এর মাত্র ১২ দিন পরেই সুকুমারের প্রয়াণ। বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথ বার্তা পাঠালেন তার বিধবা স্ত্রীকে। শান্তিনিকেতনে স্মরণসভা করলেন।
রবীন্দ্রনাথের সাথে রায় পরিবারের এই শাখার সংযোগ এরপর একটু ক্ষীণ হয়ে এল। এর কারণ রায়দের ভাগ্যবিপর্যয়। ব্যবসা তো আর সবাইকে দিয়ে হয় না। সুকুমারের মৃত্যুর পর ইউ রয় এন্ড সন্স-এর ব্যবসা গুটিয়ে গেল। ঋণের দায়ে হাতছাড়া হল ১০০ গড়পার রোড। সত্যজিৎ বোধহয় সেই দুঃখ কোনোদিন ভুলতে পারেন নি, যে ওনাদের পৈত্রিক বাড়ি বলে আর কিছু ছিল না। ফলে, উনি নিজের ফেলুদার উপন্যাসে সেই গড়পারকে অমর করে দিয়ে গেছেন।
এবার সত্যজিৎ চলে এলেন ভবানীপুরে। সেখানে স্কুলে আর দশটা বাঙালি শিশুর মত রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ইত্যাদি পড়েছেন, আবৃত্তি করেছেন ঠিকই। কিন্তু সেটা বাবার বন্ধু বা ঠাকুরদার বন্ধু হিসাবে নয়। আর দশটা বাঙালি স্কুলছাত্রের মত। তাঁর মা তখন কাজে ব্যস্ত। বেশ কয়েকবার শান্তিনিকেতন গেছেন, রবীন্দ্রনাথের থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছেন, এই পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে পড়ুন। কিন্তু সেটা হয়নি। সুকুমারের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে নড়িয়ে দিয়েছিল। তিনিও তখন একের পর এক পারিবারিক বিপর্যয়ে দিশেহারা। প্ল্যানচেটে আসক্তি হয়েছে। ৬ নভেম্বর, ১৯২৯ তারিখে রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করে সুকুমারের আত্মাকে নামিয়ে আনেন এবং সেই আত্মাকে অনুরোধ করেন ছেলেকে পাঠভবনে পাঠাতে। কিন্তু সেটাও হয়নি। এইখানে একটা অদ্ভুত কথা জেনে নিতে পারি আমরা। সুকুমারের আত্মাকে নামিয়ে এনে রবীন্দ্রনাথ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলেন। আর্থার কোনান ডয়েল যে আত্মা নিয়ে এত কাজ করেন, সেটি প্রকৃত কাজ কিনা! তার মানে, রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ের ইউরোপের পরলোক চর্চার বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং তাঁর অনুসন্ধিৎসা ছিল সীমাহীন।
সত্যজিৎ অবশেষে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ছাত্র হিসাবে এলেন ১৯৪০ সালে। কিন্তু তখন রবীন্দ্রনাথের শেষের দিক। কবি অসুস্থ। প্রায়ই চিকিৎসক আসছে। সুতরাং সেই সময়ে সত্যজিতের সাথে রবীন্দ্রনাথের যে খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল, সেটা নয়। আরও দশটা বাঙালি ছাত্রের সাথে রবীন্দ্রনাথের অনুষ্ঠানে যাওয়া আর লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রণাম করা। এই পর্যন্তই। সত্যজিতের লাইন ঠিক কবিতা লেখা বা সামাজিক উপন্যাস লেখার পথ নয়। ঠাকুরদা এনেছিলেন নতুন ছাপার প্রযুক্তি, বাবা এনেছিলেন নতুন ফোটো তোলার প্রযুক্তি আর এর এক দশক পরেই সত্যজিৎ আনবেন নতুন সিনেমার প্রযুক্তি। ফলে রবীন্দ্রনাথ তার আইকন ঠিকই, কিন্তু সত্যজিৎ যাবেন অন্য পথে। এরপর তো ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ। সত্যজিৎ সেই খবর পেয়েই এক বন্ধুর সাথে শান্তিনিকেতন থেকে ছুটে এলেন জোড়াসাঁকো। কিন্তু ঢুকবেন কী করে? মারাত্মক ভিড়। আর সেই সাথে বাঙালির সহজাত অসভ্যতা। ফলে শেষ দেখা ওই দূর থেকে যেটুকু হয় আর কী। এরপর আর এক বছর সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে ছিলেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে কলকাতায় জাপানী বোমা আক্রমণ শুরু হলে তিনি কলকাতায় ফিরে এলেন এবং কমার্শিয়াল আর্টিস্ট-এর চাকরি নিলেন।
সত্যজিৎ রায়-কৃত তিন কন্যার পোস্টার (ছবি - উইকিপিডিয়া)
১৯৬১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ উদ্যাপন হয়, তখন সত্যজিৎ সরকারি ডাকটিকিট ডিজাইন করলেন, একটা তথ্যচিত্র করলেন আর রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে সিনেমা বানালেন। আর এটা কী স্রেফ কাকতালীয় যে রবীন্দ্রনাথের ঠিক ১০০ বছরের জন্মদিনের মাসেই, অর্থাৎ ১৯৬১ সালের মে মাসে, সত্যজিৎ আবার সন্দেশ নতুন করে প্রকাশ করা শুরু করেন? এই সন্দেশের প্রথম ইস্যুতে মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় “কত্তাবাবা” নামে রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এভাবেই তিন পুরুষ ধরে রায় পরিবারের সাথে জড়িয়ে রইল রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক। তবে বৈশিষ্ট্য হল, এই রায় পরিবার রবীন্দ্রনাথের এত ঘনিষ্ঠ হলেও ঠিক রবীন্দ্রনাথের অনুসারী নয়। এরা তিন পুরুষ ধরে নিজেদের কর্মক্ষেত্র আলাদা করে রেখেছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে থাকলেও তাদের স্বকীয়তা বজায় ছিল পুরোমাত্রায়।
*****