সুধা থেকে বসুধা

লিখেছেন:অর্পিতা চক্রবর্তী

 

 

কতো ঘন্টা কেটে গেছে জানা নেই, ধীরে ধীরে সুধার জ্ঞান ফিরছে। মাথাটা বড্ড ভারি লাগছে। এদিকে ঘরের মধ্যে ছড়ানো ছিটানো মদের গ্লাস, মাংসের হাড়ের টুকরো। উফ ঘেন্নায় গাটা গুলোচ্ছে। কিন্তু রাহুল কই। রাহুল, এই রাহুল, -  কোথায় তুমি? বাথরুম থেকে বেরোল রাহুল।

কি অবস্থা ঘরটার। এ কোথায় এলাম? তোমার মামা মামী কই? আমাদের বিয়ের আয়োজন কোথায়? কি খাইয়েছ বলো তো আমাকে?  আমার মাথাটা কেমন করছে।

একটা বিকট হাসি হাসল রাহুল। কিন্তু এ কোন রাহুল? এসব কথা চিন্তা করতে করতেই ঘরে ঢুকে এলো এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, সঙ্গে সম্ভবত তার স্ত্রী। ও এনারাই তাহলে রাহুলের মামা মামী। সুধা খাট থেকে নেমে ওনাদের প্রনাম করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু ততক্ষণে ওর শরীরের সওদা হয়ে গেছে। শুধু দেহ না, দেহের সাথে মনেরও সওদা হয়ে গেলো। ওরা দুজনে তখন টেনে হিঁচড়ে সুধাকে একটা গাড়িতে তুলছে। সুধা চিৎকার করছে, - বাঁচাও রাহুল, আমাকে বাঁচাও। কিন্তু না, রাহুল তখন থুতু দিয়ে গুনছে লাভের অঙ্ক। গাড়িটা আস্তে আস্তে উধাও হয়ে গেলো। আর ঐ নরপিশাচ রাহুলটাকে দেখা যাচ্ছে না। এরপর সুধার ঠিকানা হলো কলকাতার পতিতালয়ে। প্রতিরাতে ওর শরীরের দাম উঠেছে। সুধা বলতে চেয়েছিলো ওর বাড়ির ঠিকানা, রাহুলকে ভালোবাসার গল্প, ওর সৎ মায়ের অত্যাচার, ওর মাতাল বাবার কথা। কিন্তু কেউ শোনেনি, পালাতে চেষ্টা করেও হলো ব্যর্থ। 

এইভাবেই কেটে গেছে দশ দশটা বছর। গ্ৰামের সহজ সরল সুন্দরী সুধা আজ কলকাতার পতিতালয়ের বসুধা। প্রতি রাতে এখানে অনেক নামীদামী মানুষের আগমন হয়, আবার দিনের বেলা তারাই বিশিষ্ট ভদ্রলোকের আসন অলংকৃত করেন। সুধা থেকে বসুধা হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিল রাহুল; যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো সুধা। প্রতি রাতে এখানে একটা নতুন রাহুলের আগমন ঘটে। মুখে বাহারি রঙ, আর সঙ সাজা - এই নিয়ে চলছিল তার দিনগত পাপক্ষয়।

সেদিন পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছিলো সে। বেধরক মার জুটেছিলো কপালে। না, কেউ বাঁচাতে এলো না। সবাই দূর থেকে তামাশা দেখছিল। যদিও সবশেষে হাল ধরেছিল হীরা মাসি। এই পতিতালয়ের এক কোণে তার বাস। এককালে যথেষ্ট দাপুটে ছিল, আজ বয়স হলেও হীরার দাপট কমেনি। সেদিন ঐ মাস্তানদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেছিলো হীরা। সুধা ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরে সেদিন খুব কেঁদেছিল। হীরা ওকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছিলো। ওর সব কথা শুনেছিলো। সুধা আবারও ফিরতে চেয়েছিলো ওর পুরোনো জীবনে। কিন্তু হীরা ওকে বুঝিয়েছিলো তা আর হওয়ার নয়। যার থাকা বা না থাকায় পৃথিবী নিস্পৃহ, সে এই সংসারের বোঝা মাত্র। আর রাহুলের মতো ব্যাপারীরা কাউকে ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসা ওদের ব্যবসার পণ্য মাত্র। 

আরো কত ভাগ্যহত এভাবেই এই পতিতালয়ে বসুধা হয়ে ওঠে। অথচ এ সেই মাটি যা দূর্গা মায়ের অঙ্গে লাগে।  কাল রাতে হীরা মাসি এই নরক থেকে মুক্তি পেলো। কিন্তু মা-মরা অভাগী সুধা সৎ মায়ের অত্যাচার, মাতাল বাপের ফাইফরমাশ আর প্রতারক রাহলের থেকে পেলো শুধুই বঞ্চনা। এই গোটা পতিতালয়ে একমাত্র হীরা মাসি, যার কাছে এসে সে কেঁদেছে, হেসেছে আবার অভিমান করেছে। আজ সেই হাসি কান্নার সাথীও চলে গেলো।

সময়ের চাকা ঘুরছে তার নিজের নিয়মে। প্রতি রাতের এই নরক যন্ত্রণা, বিকৃত রুচিবোধ, নেশার করালগ্রাসের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত বসুধা। একটা ছোট্ট সুখী সংসার, স্বামীর ভালোবাসা, সন্তান সুখ - এই তো চেয়েছিলো মেয়েটা। অনেক স্বপ্ন নিয়ে সেদিন মাতাল বাবার ঘর ছেড়ছিলো। ঐদিন রাহুল ওকে এমন কিছু খাইয়েছিলো যা খাওয়ার পর ওর আর হুঁশ ছিল না। সর্বনাশের শুরুটা হয়েছিল ওখানেই। এরপর জীবনের প্রতিটি দিন শুধু ধ্বংস দেখেছে মেয়েটা। হীরা মাসির ঘরটাই আজ ওর পৃথিবী। দিন কেটে যাচ্ছিল নরখাদকদের পাশবিক চাহিদা মেটাতে মেটাতে। কত সতীসাধ্বী স্ত্রীর অভিশাপ আজ বসুধার উপর। কিন্তু সেও তো চেয়েছিলো সতী সাধ্বী স্ত্রী হতে.....ভাগ্যের এ কোন নিষ্ঠুর পরিহাস।

সেদিন বৌবাজার ক্রসিং এ দাঁড়িয়ে আছে বসুধা। হঠাৎ একটা চিৎকার শোনা গেলো। সামনেই একটা ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সবাই ছুটছে, বসুধাও কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলো। ওদিকে তখন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রাহুল। পুলিশ কেস বলে কেউ এগিয়ে আসছে না। বসুধা এগিয়ে গেলো। এম্বুলেন্স ডাকলো, রাহুলকে হাসপাতালে ভর্তি করালো। রাহুলের পকেট থেকে পাওয়া গেছে ওর স্ত্রীর নাম্বার। স্ত্রী হাসপাতালে এসে খুব কান্নাকাটি করছে। ওদিকে পুলিশ তার কর্তব্য করছে। অপারেশন চলছে, হয়তো এই যাত্রায় বেঁচে যাবে রাহুল। রাহুলের স্ত্রী এসে বসুধার হাত দুটো ধরে খুব কাঁদছে। ইতিমধ্যে খবর এলো রাহুল আপাতত আউট অফ ডেঞ্জার। বসুধা পুলিশের অনুমতি নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ ছুটে এলো রাহুলের স্ত্রী।

দিদি চলে যাচ্ছেন, একটি বার আপনাকে প্রণাম করতে দিন। আজ আপনার জন্য আমার সিঁথির সিঁদুর রক্ষা পেলো। বসুধা নিজের পা সরিয়ে নিয়ে বললো আমাকে ছুঁয়ো না। আমি এক পতিতা, আর তোমার সিঁথির সিঁদুরের কল্যাণেই আমি আজ সুধা থেকে বসুধা। তোমার স্বামী একজন ফেরিওয়ালা। ভালোবাসাই ওর পূঁজি। আমি শুধু আজ আমার মানবিকতার পরিচয় দিলাম। আমি প্রতি রাতের ভোগ্য বস্তু, কিন্তু আমার মানবিকতা কোন পণ্য নয়। ভালো থেকো। চলি। ঈশ্বর করুক আর যেনো কখনও ঐ মুখ পোড়া মিনশের মুখ আমাকে দেখতে না হয়।

বসুধা চলে গেলো। পাথরের মতো বসে আছে রাহুলের স্ত্রী। ও যা শুনলো তা কী সত্যি? এই কী রাহুলের পরিচয়? একজন প্রতারক? আর উনি, মানে বসুধা, সে কে? পতিতালয়ের পতিতা না কোনো দেবী?

দেবী কী শুধু মন্দিরেই থাকে? না তাঁর স্থান মানুষের মন মন্দিরে? 

 

*****  


 

0 Comments
Leave a reply