লেখকের কৈফিয়ত
এই উপন্যাসিকা আদতেই কারোর জীবনচরিত নয়, কোনো বিশেষ আদর্শ প্রচারের মাধ্যমও নয়। ইতিহাস বা ধর্মতত্ত্বের নির্ভুল অনুসন্ধানের বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও ছিল না লেখকের। এই গল্পের ছত্রে ছত্রে আছে কেবলমাত্র কিছু বিচিত্র এবং কিছু সাধারণ ঘটনা, কিছু চরিত্র, এবং এক তরুণ সন্ন্যাসীর সম্পূর্ণ অজানা এক দেশে পদার্পণের অভিজ্ঞতা—সেই অভিজ্ঞতা যেমনই হোক, যত অদ্ভুতই হোক।
বিবিধানন্দ নামের উনিশ শতকের এক নবীন বাঙালি সন্ন্যাসী বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদান করতে মার্কিন মুলুকের শিকাগো যাত্রা করেন। তাঁর যাত্রাপথ, সেই অচেনা দেশে তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর চারপাশের মানুষদের প্রতিক্রিয়া—এই আখ্যান তারই কিছু খণ্ড চিত্র গেঁথে রচিত। তবে গল্পটি কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এগোয় না, এবং এর কোনো তথাকথিত উপসংহারও নেই। কিছু মানুষ এই সন্ন্যাসীর জীবনের গল্পে আসে পার্শ্বচরিত্র হয়ে, কিছু ঘটনা ঘটে, কিছু প্রশ্ন ওঠে—যেগুলোর উত্তর আছে না নেই, তা লেখকের ভাবনায় ছিল না।
উৎসাহী পাঠকবর্গ যদি এই কাহিনিতে কোনো নির্দিষ্ট অর্থ খুঁজে পান অথবা উদ্দেশ্য আরোপ করতে চান, সেটি সম্পূর্ণভাবে তাঁদের একান্তই নিজস্ব ব্যাখ্যা। লেখকের তেমন কোনো দায় নেই
প্রাক্কথন
কন্যাকুমারীর সমুদ্রতটের খুব কাছে সর্বগ্রাসী সমুদ্রের ভেতর মাথা তুলে আছে একটা ছোট দ্বীপের মতো প্রকাণ্ড পাথরখণ্ড। নির্জন দ্বীপ সমতুল্য সেই পাথুরে ভূখণ্ডের ওপরে আধশোয়া গায়ে বসে একমনে ধ্যানরত নবীন বাঙালি সন্ন্যাসীটির নাম বিবিধানন্দ। বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের অল্প বেশি, ফর্সা। পাশে ছেড়ে রাখা তাঁর গেরুয়া বসন এবং তার ওপর লম্বালম্বি রাখা একটা সাধারণ লাঠি, যা দরকারে লোটাকম্বল বাঁধবার কাজে আসে। তাঁর তপস্যা শুধুই আত্মপোলব্ধির জন্য নয়, বরং এক চূড়ান্ত উপলব্ধির সন্ধানে—জীবনকে জানা এবং জীবন থেকে মুক্তির অর্থ খুঁজে পাওয়ার এক আকুল আপ্রাণ চেষ্টা।
ঠিক তখনই, এক অদ্ভুত বিদঘুটে অনুভূতি তাঁকে তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে বাধ্য করাল। চোখ খুলেই আমাদের সন্ন্যাসী ছোকরাটি দেখলেন, সমুদ্র থেকে উঠে আসছেন এক ন্যাক্কারজনক, রীতিমতো ন্যালাক্ষ্যাপা লোক। বুকে জীর্ণ পৈতে ঝুলছে, খাটো ধুতি পরনে, পাতলা চুলের মধ্যচল্লিশের মানুষটির চেহারা দেখে দেবতা দূরে থাক, আত্মভোলা এক ক্ষতিহীন এবং খ্যাপাটে দার্শনিক বলেই মনে হয়।
কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটা হলো—লোকটার হাতে ধরা এক বিশাল পেতলের থালা, যার উপর রাখা এক সুবিশাল তেলে ভাজা মুচমুচে দোসা!
দোসার রং সোনালি, ভেতরে গলে যাওয়া মশলাদার আলু আর ভাজা বাদামের পুর—সাথে ছোট একটা বাটিতে নারকেলের চাটনির স্নিগ্ধ শুভ্রতা। দোসার গরম সুগন্ধ এমনভাবে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল যে, বিবিধানন্দ হঠাৎই উপলব্ধি করলেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে মোক্ষ নয়, দোসার সন্ধানেই ধ্যান করছেন!
তিনি বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি আমাকে কিছু বলতে এসেছো?”
দার্শনিক লোকটা কিছু না বলে কেবল এক আঙুল তুলে ইশারা করলেন—খানিক দূরে পশ্চিমের দিকে। তবে আকাশের দিকে নয়, সাগরের পারে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্ট্রিট ফুডের দোকানের দিকে, যার সাইনবোর্ডে তামিল হরফে বড় বড় করে লেখা:
"মাদ্রাজি মার্ভেল: উদান থোসাইবিন ঠিকাড়ম!" (“মাদ্রাজি মার্ভেল: সেরা দোসার ঠিকানা!”)
বিবিধানন্দ কপাল কুঁচকে বললেন, “ওপারে? আমাকে কি ওপারে সমুদ্রতটে যেতে হবে?”
লোকটি মুচকি হেসে দোসার প্লেট তাঁর হাতে দিয়ে আবার সমুদ্রের জলে মিলিয়ে গেলেন!
যুবক তাকিয়ে থাকলেন চরম বিস্ময়ে। এই কি তবে ঈশ্বরের ইঙ্গিত? তবে কি মোক্ষ নয়, দোসাই পরম সত্য?
তবে কি “অহম ব্রহ্মাস্মি” নয়, “অহম থোসাইভক্তঃ”?
ঠিক তখনই, পাশে থেকে একটা কর্কশ বাজখাই গলা তাঁর সব ভাবগম্ভীর চিন্তা স্রোত প্রতিহত করে প্রকট হল—
"অন্না, ইরু নাডকাল এথুভুম শাপ্পিডাভিল্লাই! ওরু থোসাই ভাঙ্গি শাপ্পিডা কল্লি!" (“বাবু, দু'দিন কিছু খাইনি! একটা দোসা কিনে খাওয়ান!”)
বিবিধানন্দ তন্দ্রা ভেঙে দেখলেন—সবটাই ক্ষণিকের দিবাস্বপ্ন। তিনি বসে আছেন মাদ্রাজের সমুদ্রতটে, বালির ওপর। তাঁর হাতে কোনো স্বর্গীয় দোসা নেই। নিজের মাধুকরীর শেষ দুটো পয়সা ভিখারির হাতে দিয়ে বিবিধানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তিনি ভাবলেন, "এ জীবনে মুক্তি হয়তো অসম্ভব। তবে এক প্লেট দোসা আমার পেটের এই আর্তরোদনের উপশম ঘটাতে পারত।"
এদিকে ভিখারি দূরে গিয়ে “মাদ্রাজি মার্ভেল” স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
"অন্নে, তেংগাই কনজাম চুটনি কুড়াই!" (“ভাই, নারকেল চাটনি দাও!”)
বিবিধানন্দ ব্যাজার মুখে একবার নিজের পেটে হাত বুলিয়ে নিজের অদৃষ্টকে অস্ফুটে খানিক গালি দিয়ে নগরের পথ ধরলেন।
বুদ্ধদেব বোধিলাভ করেছিলেন পিপাসার্ত হরিণ দেখার পর। বিবিধানন্দ উপলব্ধি করলেন দোসার অভাবের যন্ত্রণা।
মোক্ষের পথ বন্ধ হলেও, পথপসারিত খাদ্যের দোকানগুলো অন্তত খোলা ছিল!
১.
মাদ্রাজের রোদ যেন কলকাতা রঙ্গমঞ্চের কুশীলবদের দেহের উপর ফেলা নির্মম কোনো স্পটলাইট! উত্তর কলকাতার মানিকতলার গৃহত্যাগী তরুণ নীরেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে বিবিধানন্দ এক ভক্তের বাড়ির বারান্দায় বসে যেন ছাঁকা তেলে ভাজা কুমড়ো ফুলের বড়া—নরম, গরম, আর নিজেই নিজের অবস্থায় বীতশ্রদ্ধ ! মাঝে মাঝেই গেরুয়া বসনের গলার কাছের অংশ দু’আঙুলে টেনে একটু ফাঁক করছেন, যেন প্রকৃতির বাতাস প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু বাতাসের কি আর এত কৃপা! তাঁর করুণ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাঁকে খালি পেটে অঙ্ক কষতে বসিয়েছে।
পাশে রাখা আধ-গ্লাস ঘোলেরও গরমে এমন অবস্থা যে এখন একে ‘দইয়ের স্যুপ’ বললেও কম বলা হয়!
ঠিক এমন সময় গৃহস্বামী ভেঙ্কাটেশ্বর আইয়ার প্রবেশ করলেন হাঁপাতে হাঁপাতে, যেন সদ্য ম্যারাথন দৌড় শেষ করে এসেছেন।
“স্বামীজী!” গৃহস্বামী হাতজোড় করে বললেন, “আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন একজন—সিংহলের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।”
“বৌদ্ধ সন্ন্যাসী?” বিবিধানন্দ ভ্রু উঁচিয়ে নিজের পাগড়ি ঠিক করলেন। (যা তাঁর ঘন কোঁকড়ানো চুল সামলানোর জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত ছিল না!)
“তা কী চায়? তর্ক জুড়তে নাকি দুপুরের খাবার?
যা-ই হোক, নিয়ে আসো। যদি তর্ক করতে আসে, তাহলে একগাদা ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে।
আর যদি খাওয়ার লোভে আসে, তাহলে আমি প্রস্তুত! খানিক মামুলি গল্পগুজব হলে ক্ষতি কী?”
শিষ্যটি দ্রুত প্রস্থান করলেন, আর মিনিটখানেকের মধ্যে উঠোনে প্রবেশ করলেন এক লম্বা, রোগা, মাথা কামানো ব্যক্তি—চোখেমুখে অসীম শান্তি, কিন্তু ঠোঁটে একরকম রসিকতার ছাপ।
তিনি বিনম্রভাবে হাতজোড় করে মাথা নোয়ালেন।
“স্বামীজী,” সন্ন্যাসীটি বললেন, তাঁর সিংহল ঘেঁষা ইংরেজি উচ্চারণ কানে কানে মন্ত্রের মতো শোনাচ্ছিল, “আমি বোধি বজ্রধর। আপনাকে সম্মানজ্ঞাপন আমার জন্য সৌভাগ্যের।”
বিবিধানন্দও হাতজোড় করে সহাস্যে বললেন, “আহা, বজ্রধর! সেই ব্যক্তি, যিনি বৌদ্ধদের গুহা থেকে টেনে এনে বোধগয়ার আলো দেখালেন! বাহ, বাহ, স্বাগতম!
বসুন, তবে সাবধান—এখানকার চেয়ারগুলো আমাদের দর্শনের মতোই: শক্তপোক্ত, তবে চিন্তার ভারে ভেঙে পড়তে পারে!”
বজ্রধর হেসে ফেললেন, সাবধানে চেয়ারে বসে বললেন - স্বামীজী, আপনার রসিকতা বেশ ধারালো! তবে চেয়ারগুলো তো দৃঢ়ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে—আমাদের পাতি আর পাঁচটা মামুলি ধ্যানধারণার মতো নয়।
বিবিধানন্দ মুচকি হেসে গম্ভীর স্বরে বললেন -
আমার অনেক থিওরিই আছে, মহাশয়! তবে এই মুহূর্তে আমার পেট নতুন এক দর্শন গড়ে তুলছে—মাদ্রাজের ঘোল আর রাজস্থানের মরিচ মিশে একসাথে যদি বেঁচে থাকতে পারে, তাহলে বিশ্বভ্রাতৃত্বও সম্ভব!
তাঁদের যুগল হাসির শব্দ যেন সমুদ্রতটের হালকা বাতাস, গুমোট গরমেও একটু স্বস্তি এনে দিল।
কিছুক্ষণ কথার পর বজ্রধর মূল প্রসঙ্গে এলেন।
“স্বামীজী, আপনি কি শিকাগোর ধর্ম সংসদের কথা শুনেছেন?”
“শিকাগো?” বিবিধানন্দ ভ্রু কুঁচকে বললেন, “ওই যে গোমাংস আর ঠান্ডা হাওয়ার দেশ? সেখানে আমাদের মতো চালচুলোহীন সন্ন্যাসীদের কী দরকার?”
তারপর গম্ভীর স্বরে সংযোজন করলেন, “তবে, যদি ব্যাটারা আমাদের খাইয়ে দাইয়ে কিছু পুণ্য বা পরমার্থ অর্জন করতে চায়, তাহলে ব্যাপারটা একেবারে মন্দ নয়!”
বজ্রধর হেসে মাথা ঝাঁকালেন। “না, স্বামীজী! এটা ধর্মীয় নেতাদের বিশ্ব-সমাবেশ। তাঁরা সেখানে বিভিন্ন বিশ্বাস এবং দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে চান—খ্রিস্টধর্ম, ইহুদি মতবাদ, ইসলাম, এমনকি বৌদ্ধধর্মও! আমি ভাবলাম—বেদান্তের কণ্ঠ ছাড়া কি আদৌ ধর্ম সংসদ হতে পারে?”
বিবিধানন্দ একটুখানি মুচকি হাসি নিয়ে পিছনে হেলান দিয়ে বললেন,
“আমি কেন? নিশ্চয়ই এমন অনেক পণ্ডিত আছেন, যাঁরা আমি যত কচুরি গান্ডে পিণ্ডে গিলেছি, তার চেয়ে ঢের বেশি বই পড়েছেন! তাঁরা কেন যাবেন না?”
বজ্রধর শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
“কারণ আপনার হৃদয়ে আগুন আছে—অজ্ঞানতাকে পোড়ানোর মতো বিধ্বংসী আগুন! আপনার কথায়, আপনার লেখায়! আপনি যখন বলেন, মানুষ শুধু শোনে না—ভেতর থেকে জেগে ওঠে!”
বিবিধানন্দ নাটকীয়ভাবে হাত নেড়ে বললেন,
“জেগে ওঠে? আহা, যদি আমার কথার এত দম থাকতো, তবে ভারতের অর্ধেক জনগণ এখনও ইতিহাসের পাতায় ঘুমিয়ে নাক ডাকত না!”
বজ্রধর হাসলেন।
“হয়তো! কিন্তু আমেরিকা ভারত নয়। ওরা ঘুমায় না—দৌড়ায়। অজ্ঞতার দেওয়ালে ধাক্কা খায়, তারপর আবার দৌড়ায়! আপনি, স্বামীজী, ওদের পথপ্রদর্শক হওয়ার জন্য একদম সঠিক মানুষ।”
বিবিধানন্দ সোজা হয়ে বসলেন, গভীর চিন্তায় পড়লেন।
“ঠিক আছে, তাহলে আপনি যান না! আপনিই তো শান্ত, গম্ভীর, প্রায় নির্বাণলাভী! একেবারে আমেরিকানদের উপযুক্ত!”
বজ্রধর হেসে বললেন, “আমি যাবো, তবে আমেরিকানরা নতুন চিন্তাভাবনা পছন্দ করে। যখন আমি কথা বলবো, তারা সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু আপনি?”
একবার থেমে তিনি চোখ কুঁচকে হাসলেন এবং বললেন “আপনি ঝড় তুলবেন! তারা বুঝতেই পারবে না কীভাবে সামলাবে।”
বিবিধানন্দ খিলখিল করে হেসে বললেন, “ঝড় তো অনেক সময় তছনছ করে দেয়। শিকাগোতে সত্যিই ঝড় তুলতে চাও?”
“একদম!” বজ্রধর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “ভারতের কণ্ঠ এখন শোনা দরকার! আর আপনি সেই কণ্ঠ।”
বিবিধানন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন, তারপর তাঁর না কামানো দাড়ি চুলকে বললেন,
“ঠিক আছে, বজ্রধর! যদি ঈশ্বর চান, আমি যাবো।
যদি সফল হই, তুমি কৃতিত্ব নেবে। আর যদি ব্যর্থ হই…?”
বজ্রধর হেসে বললেন, “তাহলে আমি আমার কর্মে মনোনিবেশ করব !”
বিবিধানন্দ তাঁর হাতটা শক্তভাবে ধরলেন ।
এভাবেই শুরু হল এক মহাযাত্রা। এক ঝড়ের অপেক্ষায়, শিকাগোর পথে!
২.
মাদ্রাজের গ্রীষ্মকালীন তাপ বিবিধানন্দকে ক্ষণে ক্ষণে আঘাত করছিল।
ঘন, আর্দ্র বাতাস বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত হাওয়ার সাথে মিশে গিয়ে এমন অনুভূতি তৈরি করছিল যেন গোটা পৃথিবীটাই তাঁর শরীরকে আঁকড়ে ধরে আছে। তিনি একটি ছোট কাঠের টেবিলের সামনে বসেছিলেন, বাড়ির দ্বিতীয় তলায়, জানলা আংশিক খোলা।
বিবিধানন্দ একটা কলম তুলে নিয়ে, কালি ডুবিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলেন। তাঁকে একটি চিঠি লিখতে হবে, তবে কোনো সাধারণ ব্যক্তিকে নয়—বিক্রম সিং, ক্ষেত্রীর মহারাজাকে, তাঁর বন্ধু এবং সত্যের অনুসন্ধানে সহযাত্রী। বিবেকানন্দ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি লিখবেন, আর এখন শব্দগুলো যেন প্রবাহিত হওয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে সঠিক মেজাজটা ধরবেন?
"মহারাজা কে পত্রাঘাত! শ্রদ্ধাপূর্ণ ভাষ্য, কিন্তু অতিরঞ্জিত নয়। অবশ্য, ক্ষেত্রীর রাজা বিক্রম সিংহ শুধুই চোখ বোলাবেন এই রয়্যাল গার্বেজের ওপর, পড়বেন না হয়তো…" নিজের মনেই কথা বলছিলেন বিবিধানন্দ, হাতে লিখনমুদ্রায় ধরা কলম, সামনে খোলা কাগজ।
প্রিয়তম মহারাজ,
আশা করি এই চিঠি আপনাকে যথার্থ অবস্থায় পাবে—যে অবস্থায় আমি দক্ষিণ ভারতের শেষ ট্রেনযাত্রায় ছিলাম, তার চেয়ে অনেক ভালো। আপনি যদি এর চেয়েও অস্বস্তিকর কোনো ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকেন, তবে শুনতে আগ্রহী হব—কারণ আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে ট্রেনের ইঞ্জিনটাই হয়তো একমাত্র ঠিকঠাক চলছিল। অন্যদিকে খাবারের কথা বললে, সে একেবারে কহতব্য নয়। মাদ্রাজের রাস্তার দোকান থেকে তার চেয়ে উত্তম খাবার পেয়েছি।
কিন্তু আমার খাদ্যগত দুর্দশার কথায় আর যাব না…
আবু পাহাড়ে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, কি মনে আছে তো? আমার কিন্তু একদম মনে আছে। আপনি, পুরোপুরি রাজকীয় এবং মহিমান্বিত, আপনার সভাসদদের মাঝে এক সিংহের মতো। আর আমি? এক অগোছালো সন্ন্যাসী, “রাজকীয়” আচরণের ব্যাপারে ন্যূনতম ধারণাহীন। আপনি আমাকে এক ভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন, আর আমি, বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ না করে, এমন গান্ডেপিন্ডে খেলাম যেন আগামীকাল আর আসবে না। আমি এখনও মনে করতে পারি, আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “সন্ন্যাসীরা কি সবসময় এত খায়?”
আর আমি, এক মুহূর্তও না ভেবে, উত্তর দিয়েছিলাম, “শুধুমাত্র তারাই খায়, যারা রাজকীয় খাবারের আশীর্বাদ পায়।”
আহ, স্মৃতিগুলো…
বিবিধানন্দ নিজের মনে হেসে উঠলেন, তাঁদের প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি মনের কোণে ভেসে উঠতেই। তাঁদের বন্ধুত্বের সেই মুহূর্ত ছিল এক চিরায়ত—মজার খুনসুটি, বুদ্ধিদীপ্ত তর্ক, আর নীরবে পারস্পরিক সম্মানের মিশ্রণ। কিন্তু এখন, মাদ্রাজে বসে, তাঁর মন ঘুরে গেল আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে।
আবু-তে প্রথমবার তাঁদের সাক্ষাৎ ছিল একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত। বিবিধানন্দ আরোপিত ফরম্যালিটির খুব একটা ধার ধারেন না, কিন্তু বিক্রম সিং জোর দিয়েছিলেন রাজকীয় অভ্যর্থনায় আর এক মহার্ঘ ভোজের আয়োজনে।
যখন বিবিধানন্দ মহারাজার দরবারে প্রবেশ করলেন, তাঁর মনে ছিল কৌতূহল, কিন্তু একই সঙ্গে কিছুটা নির্লিপ্তিও। বৈভব আর চাকচিক্যের প্রতি তাঁর কোনো টান নেই, তবে বিক্রম সিংয়ের উদার মানসিকতা তাঁর খুব ভালো লেগেছিল।
দরবারের সভাসদরা, যেন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল, অপেক্ষায় ছিলেন কখন বিবিধানন্দ তাঁদের এই “রাজকীয়” পরিবেশকে স্বীকৃতি দেবেন। কিন্তু বিবিধানন্দ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সরাসরি টেবিলের কাছে গিয়ে খাবার তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলেন।
বিক্রম সিং-এর হাসি গোটা ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো।
“জানেন, স্বামীজী, আপনি এমন ভাবে খাচ্ছেন যেন গোটা দুনিয়া জয় করতে চলেছেন, শুধু প্লেট নয়।”
“মহারাজ, যদি গোটা দুনিয়াই পাওয়া যায়, তখন শুধু অর্ধেকেই বা কেন সন্তুষ্ট হব?” বিবিধানন্দ উত্তর দিলেন, রুটি আর সব্জির গ্রাস মুখে নিয়ে। “আর তাছাড়া, খালি পেটে দর্শনের আলোচনা হয় নাকি!”
সভাসদরা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, কিন্তু বিক্রম সিং আরও জোরে হেসে উঠলেন, সন্ন্যাসীর এই অননুমেয় আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে।
বিবিধানন্দ আবার লিখে চললেন মুখে স্মৃতি রোমন্থণের হাসিটুকু রেখে—
জানেন মহারাজ, আমি প্রায়ই সেই ভোজসভার কথা ভাবি—খাওয়া দাওয়ার কারণে নয়, বরং তারপরে যে হাসিঠাট্টা চলেছিল তার জন্য। আপনি আমার সাথে হাসছিলেন, আমাকে বিদ্রুপ করে হাসেননি, যেমনটা বন্ধুদের মধ্যে হয়। আর এ কারণেই, আমি আপনাকে এত শ্রদ্ধা করি। আপনি বাছবিচার করেন না। আরোপিত ভদ্রতা দেখান না। আপনি নিজেকে যেমন, তেমনই প্রকাশ করেন, এবং আপনার মত উচ্চস্থানীয় ব্যক্তির মধ্যে এটা একটা বিরলতম গুণ।
এখন, কিছুটা গম্ভীর বিষয়ে মানে কাজের কথায় আসা যাক। শীঘ্রই আমেরিকাতে ধর্মীয় সংসদ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এবং আমি সেখানে যোগ দিতে আগ্রহী। আমি জানি আপনি এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন—পশ্চিম কী আমাদের ঐতিহ্যের গভীরতা বুঝবে? কিন্তু বিষয়টা এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।
আমি কৃতজ্ঞ থাকব, আমার বন্ধু, যদি আপনি সেই সহায়তার প্রতিশ্রুতি পুনরায় বিবেচনা করেন—শুধু আর্থিকভাবে নয়, বরং আপনার নৈতিক শক্তি দিয়ে, যাতে আমি এই কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারি। আমি জানি এ এক দীর্ঘ পথ, কিন্তু কখনো কখনো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোই সবচেয়ে বড় পুরস্কারে পরিণত হয়।
আর হ্যাঁ, আমি এখানে মাদ্রাজের বাজারে গিয়েছিলাম, আর যদিও আমগুলো ক্ষেত্রীর তুলনায় কিছুই নয়, তবে নারকেলের জল বেশ ভাল।
বন্ধুত্বে এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতায়,
বিবিধানন্দ
চিঠিটা সিল করে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে একটা মাদ্রাজী চুরুট ধরালেন বিবিধানন্দ। ধোঁয়ার রিং ছেড়ে নিজের মনেই হাসলেন।
বিবিধানন্দের মন আবার আবুতে ঘটে যাওয়া একটা মজাদার ঘটনার দিকে চলে গেল।
বিক্রম সিংহ, সর্বদা গর্বিত মহারাজা, বিবিধানন্দকে এক উটের সফরে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ ধরেছিলেন।
"এটা আমার আস্তাবলের সবচেয়ে ভালো উট, স্বামীজী।"
গর্বিত হয়ে বললেন বিক্রম সিংহ। "এ হল রাজকীয় মহিমার প্রতীক।"
কিন্তু উট বাবাজি, সমস্ত রাজকীয় প্রশিক্ষণের পরেও, একদম হাঁটু গেড়ে বসতে অস্বীকৃতি জানালো।
বিবিধানন্দ হেসে বললেন, "এই উটের কী হয়েছে? এ কী রাজধর্ম ছেড়ে ত্যাগের পথ অনুসরণ করছে নাকি?"
বিক্রম সিংহ উটকে বোঝানোর জন্য সবরকম চেষ্টা করলেন। কিন্তু উট যেন এক অটল সাধু, যে প্ররোচনা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে জানে।
"এই উটটা জানে না আমি কে।"
বিক্রম সিংহ, একটু অস্বস্তি মিশ্রিত রাগে বললেন।
বিবিধানন্দ হেসে বললেন, "সম্ভবত, মহারাজ, উটটা আপনার ইচ্ছার প্রতি অনুগত হতে অস্বীকার করছে, কারণ ও হয়তো আপনার সঙ্গে কিছু সময় ধ্যান করতে চায়।"
অবশেষে, উট হাঁটু গেড়ে বসলো। বিবিধানন্দ, উটের পিঠে চড়ে বললেন,
"এ ব্যাটা আমাদের জীবনেরই মতো: মাঝে মাঝে এমন বিপদে ফেলবে যে হয়রানির এক শেষ। কিন্তু, ধৈর্য ধরে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতায় শেষ পর্যন্ত যেখানে আমাদের যাওয়ার, সেখানেই আমরা পৌঁছাবো। হয় আজ, নয় কাল।”
এই চিঠিটা তাঁদের মধ্যে কৌতুক আর বোঝাপড়ার উদযাপনের একটা টুকরো মাত্র। বিক্রম সিংহের মুখে যদি এক চিলতে হাসি ফোটাতে পারে এই চিঠি, তাহলেই তিনি খুশি। মনে মনে বললেন-
“ভারতের আত্মায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে জ্ঞানগরিমা আছে, আর আছে কৌতুকের মহিমা, যা সবখানে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আর হয়তো পশ্চিম দুনিয়াকে তা দেখানোর প্রয়োজন।”
চিঠিটা পাঠিয়ে দিলেন বিবিধানন্দ, যে চিঠি বন্ধুত্বের এক অনন্য বার্তা বহন করে।
৩.
মাদ্রাজের গরম বাতাস যেন এক ধুরন্ধর রাস্তার ফেরিওয়ালার মতই নির্দয়, যে দামাদামিতে নিজের দক্ষতাকে শীর্ষে নিয়ে গেছে। স্বামী বিবিধানন্দ ঘরের জানালার পাশে বসে খানিক তন্দ্রাছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। উজ্জ্বল রোদ তাঁর মুখে এসে পড়ায় চোখ কুঁচকে তাকালেন, যেন সারা বিশ্ব তাঁকে কাজ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাঁর মন তখন বাইরে ব্যস্ত রাস্তাগুলোর থেকে অনেক দূরে একটিমাত্র কাজ নিয়ে ব্যস্ত—তাঁকে আমেরিকায় পৌঁছতে হবে ধর্ম মহাসভায় অংশ নেওয়ার জন্য।
“আহ, ওরা যদি বুঝত,” স্বামীজী নিজেই নিজের মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন। “এতো আর যাওয়ার জন্য যাওয়া নয়। এটা একটা জার্নি, আমাদের জ্ঞানগরিমা সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পকেট খালি।”
তাঁর চিন্তার স্রোত বাধাগ্রস্ত হল দরজায় এক তীক্ষ্ণ কড়া নাড়ার শব্দে।
“ভিতরে এসো”, স্বামীজী বললেন, ইতিমধ্যেই জানতেন কে হবে সেটা।
ভিতরে এলেন রঘুরামন রাজেন্দ্রন, স্বঘোষিত দানবীর, পণ্ডিত এবং তাঁর নিজের কথায়, পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ দর কষাকষি বিশেষজ্ঞ। রঘুরামনের গোলাকার পেট হাঁটার সময় এমনভাবে দোলে, যেন পবিত্র গরুর মন্থর গতির প্রতিরূপ, এবং তাঁর মুখমন্ডল যেন প্রকৃতির হাস্যরসের এক পরিপূর্ণ নিদর্শন। তার গোঁফ এত দীর্ঘ যে, একে মস্তিষ্কের অংশ বলে ভুল হলে তা অস্বাভাবিক নয়।
“আমি আপনার যাত্রার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি,” রঘুরামন রাজেন্দ্রন বললেন, অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে, হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে।
বিবিধানন্দ এক ভ্রু তুললেন। “যাত্রা? আমি মানসিকভাবে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত। শরীরটাই শুধু কয়েক হাজার টাকার অভাবে আটকে আছে।”
রঘুরামন রাজেন্দ্রন হাসলেন, কাগজগুলো টেবিলের ওপর আড়ম্বর সহকারে ফেলে দিলেন। “এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন, স্বামীজী। ছেড়ে দিন। আমি মাদ্রাজের মানুষের কাছ থেকে এত সমর্থন জোগাড় করেছি যে, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। তারা আপনাকে এখানে ভীষণ ভালোবাসে, জানেন তো। আর আমি, স্বাভাবিকভাবেই, অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। আমি শহরের সেরা ব্যবসায়ী, পণ্ডিত, এবং... কয়েকজন মন্দির পুরোহিতকে পর্যন্ত অনুদান রাখতে রাজি করিয়েছি।”
বিবিধানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেন তিনি সেই মুহূর্তেই এক ব্যক্তির থেকে দানের মহত্ব নিয়ে এমন এক বক্তৃতা শুনতে যাচ্ছেন, যে ডলার আর টাকার পার্থক্য বোঝেনা।
“রঘুরামন, আমার বন্ধু,” স্বামীজী শুরু করলেন, “আমি আশা করছি, তুমি এমন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ না যা পূরণ করতে পারবে না। দেখো, আমার তোমার মন্দির পুরোহিতদের প্রতিশ্রুতির চেয়ে একটু বেশি দৃঢ় কিছুর প্রয়োজন। টাকা-ই এখানে আসল বিষয়, বন্ধু।”
রঘুরামন রাজেন্দ্রন বুক ফুলিয়ে এমন এক দীর্ঘ এবং জটিল কাহিনী বলতে শুরু করলেন, যেটা অনুধাবনার্থে “থিয়েটারি দর কষাকষি” বিশেষণটাই যথাযথ।
রঘুরামন বলতে শুরু করলেন, “আমি গিয়েছিলাম এক ব্যবসায়ীর কাছে। তিনি বললেন, ‘রঘুরামন, তোমার প্রচেষ্টার কথা শুনেছি। তুমি একজন সন্ন্যাসীকে পশ্চিমের ধর্ম মহাসভায় পাঠাতে চাও? হয়ে যাবে!’ তারপর আমি এক পণ্ডিতের কাছে গেলাম, যিনি বললেন, ‘আমার পুরো মাসের বেতন দিয়ে দেবো, যা, তুমি জানো, বেশ মোটা অংকের।’ অবশ্য, আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে তাঁর বেতন এত কম যে তা প্রায় মন্দিরের প্রণামীর সমতুল। তবুও, তিনি জেদ করলেন!”
স্বামী বিবিধানন্দ তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। “অপেক্ষা করো... তুমি বলতে চাইছো, এক ব্যবসায়ী আর এক পণ্ডিত, যারা চায়ের মধ্যে চিনি দেবে কিনা তা নিয়েও একমত নয়, তারা এখন আমার যাওয়ার জন্য টাকা দিচ্ছে?”
“একদম!” রঘুরামন রাজেন্দ্রন এমন ভঙ্গিতে বললেন, যেন তিনি নতুন কোনো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র আবিষ্কার করেছেন। “কিন্তু, এই সবের আসল চমক ছিল, যখন আমি মন্দিরের পুরোহিতের কাছে গেলাম। তাকে বললাম, ‘স্বামীজীর তোমার আশীর্বাদ দরকার, কিন্তু আমার তোমার অনুদানও দরকার।’”
“আমি অনুমান করতে পারি,” বিবিধানন্দ শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, “তিনি তোমার সম্মানে একটা সোনার মূর্তি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন?”
“না, না, আরও ভালো কিছু!” রঘুরামন টেবিলে হাত চাপড়ে বললেন, “তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন পঞ্চাশ টাকা ... প্রার্থনায়। ভাবতে পারেন? পঞ্চাশ টাকার দৈব আশীর্বাদ! এটা একেবারে সেরা চুক্তি। এটা পবিত্র অর্থ।”
স্বামীজীর ঠোঁটে অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। “দৈব আশীর্বাদ, তাই তো? সমুদ্রে আটকে থাকা অবস্থায় যখন টিকিটের জন্য টাকা থাকবে না, তখন এই লেনদেনের পদ্ধতি আমায় জানিও হে!”
রঘুরামন রাজেন্দ্রন তাকে একেবারে উপেক্ষা করলেন, নিজের ‘বুদ্ধিমত্তার’ আলোয় মশগুল হয়ে। “আরে শুনুন, স্বামীজী! আসল মজাটা তো বাকি। একজন স্থানীয় কবির কাছ থেকেও প্রতিশ্রুতি পেয়েছি। তিনি বললেন, ‘স্বামীজীর প্রশস্তিতে ভরা এমন সব কাব্য রচনা করব যে তা মাদ্রাজের রাজপথে প্রতিধ্বনিত হবে!’ আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে সেই কাব্য মহাসভায় পৌঁছে দেবো—তারা যদি তামিল ভাষার কাব্যের সৌন্দর্য বুঝতে পারে।”
স্বামী বিবেকানন্দ হাসি চাপতে চাপতে বললেন -“তাহলে রঘুরামন! তুমি আমার যাত্রার খরচ মেটাবে কবিতা, আশীর্বাদ আর কয়েকজন বিভ্রান্ত ব্যবসায়ীর বদান্যতায়?”
“একদম ঠিক!” রঘুরামন রাজেন্দ্রন প্রশস্ত হাসি দিয়ে বললেন। “আর হ্যাঁ, আম! একজন ব্যবসায়ী আপনার সঙ্গে সেরা আম পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দেখুন স্বামীজী, আমরা ভারতীয়রা কেমন কৌশলী!”
“নিশ্চয়ই,” বিবিধানন্দ বললেন। “আম। দর্শনশাস্ত্রের সব অগ্রগতির চাবিকাঠি।”
রঘুরামন রাজেন্দ্রন উজ্জ্বল মুখে বললেন, “শিখছেন, স্বামীজী! আপনি শিখছেন।”
স্বামীজী চেয়ারে হেলান দিয়ে মুচকি হাসলেন। “জানো রঘুরামন, আমি কোনোদিন ভাবিনি যে আম আর দৈব আশীর্বাদে আমার যাত্রার খরচ জোগাড় হবে। কিন্তু মনে হয় শেষমেশ সবকিছুই ঠিক হয়ে যায়। আম আর প্রার্থনা, দুটোই নাহয় থাকুক। পশ্চিম তো এই ধরনের ভারতীয় দানশীলতার জন্য একেবারেই প্রস্তুত নয়।”
রঘুরামনের চোখ চকচক করে উঠল। “চিন্তা করবেন না, স্বামীজী। আপনার উপস্থিতিতে পশ্চিম আমাদের পথ ঠিকই বুঝতে বাধ্য হবে।”
৪.
বিবিধানন্দ এস.এস. পেনিনসুলার জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে, নিরন্তর নীল জলের বিস্তৃতির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। নোনা হাওয়া তাঁর গেরুয়া বসনকে খেলাচ্ছলে দোলাচ্ছিল, আর তাঁর মন ফিরে যাচ্ছিল মাদ্রাজে। কীভাবে তাঁর শিষ্যরা—বিশেষত রঘুরামন রাজেন্দ্রন—এই যাত্রার জন্য পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করেছিলেন! এক বিরাট অঙ্ক, যা সংগ্রহ করা গিয়েছিল অবিরাম প্রার্থনা, নিরলস তদ্বির আর ধনী ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা থেকে। রঘুরামন তাঁর স্ত্রীর সোনার চুড়িও বিক্রি করেছিলেন, যদিও সে ব্যাপারে তাঁর স্ত্রীর মতামত নেওয়া হয়নি।
“এই সন্ন্যাসী যদি আমেরিকায় ইতিহাস না গড়েন, তাহলে ইতিহাস হয়ে যাব আমি নিজেই,” রঘুরামন নগদ পাঁচহাজার টাকা স্বামীজীর হাতে তুলে দিয়ে বিড়বিড় করেছিলেন।
এখন বিবিধানন্দ, মাদ্রাজ থেকে বহুদূরে, অজানার পথে যাত্রা করছেন। কিন্তু এই যাত্রা যেন তাঁর উদ্দেশ্য আর উপলক্ষের থেকেও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছে।
জাহাজটা হালকা দোল খাচ্ছিল, আর তার সঙ্গেই এক গোলগাল চেহারার ব্যক্তি, যিনি ফিটিং-এর তুলনায় অনেক বেশি ছোট সাদা মিশনারি পোশাক পরে ছিলেন, টলতে টলতে স্বামী বিবেকানন্দের দিকে এগিয়ে এলেন। রেভারেন্ড এডওয়ার্ড বিলিংসওয়ার্থ, এক ব্রিটিশ মিশনারি, যার ভাবভঙ্গি ঈশ্বরের একমাত্র লাইসেন্সধারী প্রতিনিধির মত, এক নাটকীয় কাশির দমকের মাধ্যমে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। কথাবার্তা চলতে লাগল ইংরেজিতেই।
"আহ, মিস্টার ভিভিডানান্ডা! শুনেছি আপনি স্বাধীনতার দেশে যাচ্ছেন। একজন হিন্দু মঙ্ক, তাই তো?"
স্বামীজী ধীরে ফিরে তাকালেন, তাঁর চোখে একরাশ দুষ্টু হাসি। "হ্যাঁ, রেভারেন্ড। আমার প্রাচীন ‘অসভ্য’ দেশের জ্ঞান আপনার আধুনিক ‘সভ্য’ দুনিয়ায় ভাগ করে নিতে যাচ্ছি।"
বিলিংসওয়ার্থ পুরো খোঁচাটা মিস করলেন। "চমৎকার! আপনি কি বাইবেল পড়েছেন?"
"হ্যাঁ," স্বামীজী শান্তভাবে উত্তর দিলেন, "ইংরেজি, বাংলা এবং সংস্কৃতে। পড়া ভালোই। আপনি কি উপনিষদ পড়েছেন?"
রেভারেন্ড চমকে উঠলেন। "আমি, আ...না। কিন্তু, নিশ্চয়ই আপনি স্বীকার করবেন যে একমাত্র বাইবেলেই চূড়ান্ত সত্য রয়েছে?"
স্বামীজী রেলিং-এর উপর হেলান দিলেন, তাঁর সুর হালকা কিন্তু তীক্ষ্ণ। "বাইবেল ভালো বই, রেভারেন্ড, কিন্তু চূড়ান্ত সত্য? এটা একটু এই জাহাজটাই সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার একমাত্র যানবাহন, এমন দাবি করছে, তাই না?"
সেই সন্ধ্যায় ডিনারে তাঁদের আলাপচারিতা উত্তপ্ত রূপ নিল। বিলিংসওয়ার্থ, দুই মিশনারিকে পাশে নিয়ে, ভারতীয় সন্ন্যাসীর "অধার্মিক" আত্মাকে উদ্ধার করার কঠোর সংকল্পে ব্রতী হলেন।
"তাহলে, স্বামী," বিলিংসওয়ার্থ শুরু করলেন, তাঁর অতিরিক্ত সেদ্ধ বিফ রোস্ট কাটতে কাটতে, "তোমরা হিন্দুরা কীভাবে উপাসনা কর? মূর্তির সামনে, শুনেছি?"
স্বামীজী হাসলেন। "হ্যাঁ, রেভারেন্ড, আমরা অনেক রূপের উপাসনা করি। প্রতিটি ঈশ্বর এক-একটি দিককে প্রতিনিধিত্ব করে। আপনি একে মূর্তিপূজা বলতে পারেন। আমরা বলি উন্নত মাল্টিটাস্কিং। আপনার ঈশ্বর সব কাজ নিজে করেন; আমাদেরগুলো দায়িত্ব ভাগ করে নেন। কর্মদক্ষতা, বুঝলেন?"
মিশনারিরা অস্বস্তিকর দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকাল। একজন, রোগা-পাতলা ও সবসময় ঠোঁট বাঁকানো মুখের অধিকারী, হঠাৎ বলে উঠলেন, "কিন্তু নিশ্চয়ই আপনি স্বীকার করবেন বাইবেল একমাত্র সত্য পথের শিক্ষা দেয়। ঈশ্বর তাঁর একমাত্র পুত্রকে পাঠিয়েছিলেন মানবজাতিকে উদ্ধার করতে।"
"আহা," স্বামী মৃদু কৌতুকে বললেন, "আপনার ঈশ্বর তাঁর পুত্রকে ক্রুশবিদ্ধ করতে পাঠিয়েছিলেন। এটা...একটা মজার পারিবারিক ব্যাপার! আমাদের দেশে, আমাদের দেবতারা রাক্ষসদের নিধন করতে নেমে আসেন, শহীদ সৃষ্টি করতে নয়। বেশি ব্যবহারিক মনে হয় না?"
টেবিলে মুহূর্তে নীরবতা নেমে এলো, শুধুমাত্র একজন যাত্রী তাঁর স্যুপের উষ্ণতায় শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম করলেন!
কয়েক দিন পর, এক ভয়ঙ্কর ঝড়ের দাপটে জাহাজের প্রায় যায় যায় অবস্থা। যাত্রীরা রেলিং আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে প্রার্থনা করছিল, আর ক্রু'রা জাহাজকে স্থিতধী রাখতে প্রাণপণে লড়ছিল। এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই, স্বামী বিবিধানন্দ তাঁর কেবিনে পদ্মাসনে বসে শান্তমনে জপ করছিলেন।
বিলিংসওয়ার্থ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন, কাপড় ভেজা ও মুখ আতঙ্কিত। "স্বামী! আপনি কি ভয় পাচ্ছেন না? এই ঝড় আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে পারে!"
স্বামী এক চোখ খুললেন, ঝড়ের চোখের মতো শান্ত। "যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ে ভয় কেন, রেভারেন্ড? যদি শেষ সময় এসে থাকে, তবে আসুক। আর তাছাড়া, এটাই কি আপনার সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখার সেরা সুযোগ নয়? নাকি তিনি শুধু পরিষ্কার আবহাওয়াই পছন্দ করেন?"
বিলিংসওয়ার্থ কথা খুঁজে না পেয়ে হোঁচট খেতে খেতে আবার ঝড়ের মাঝখানে ফিরে গেলেন।
জাহাজ জাপানে নোঙ্গর করেছে। রেভারেন্ড বিলিংসওয়ার্থ এবং তাঁর সঙ্গীরা স্বামীজীকে তাঁদের সঙ্গে হাঁটতে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁরা যখন একটা বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, বিলিংসওয়ার্থ মূর্তির সামনে প্রার্থনারত সন্ন্যাসীদের দিকে তাচ্ছিল্য ভরে তাকিয়ে বললেন, "দুর্দশাগ্রস্ত আত্মা যত! এরা মূর্তির পূজা করছে, মনে করে যে এগুলোর মধ্যে শক্তি আছে।"
স্বামীজী থেমে গেলেন, তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। "আর আপনি, রেভারেন্ড, কী পূজা করেন? একটি কাঠের ক্রুশ? নাকি আপনার বাইবেলের ছাপানো পাতা? যদি ঈশ্বর সর্বব্যাপী হন, তবে তাঁকে কি আপনি প্রতীকগুলোতে সীমাবদ্ধ রাখবেন?"
বিলিংসওয়ার্থ রাগে লাল হয়ে, "অসভ্য! অশিষ্ট দর্শন!" বলে মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু বিড়বিড় করতে করতে সেখান থেকে প্রস্থান করলেনহাজ ভিড়ে গেল ভ্যাঙ্কুভারের বন্দরে। স্বামী বিবিধানন্দ পা রাখলেন নতুন পৃথিবীর মাটিতে, গেরুয়া বসন বাতাসে উড়ছে, চোখে দীপ্ত প্রত্যয়ের আভা। পিছনে দাঁড়িয়ে রইলেন রেভারেন্ড বিলিংসওর্থ, হাতে বাইবেল, যেন সেই মহাগ্রন্থই তাঁকে রক্ষা করবে রহস্যময় ভারতীয় সন্ন্যাসীর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির আঘাত থেকে।
"বিদায়, রেভারেন্ড," স্বামীজী বললেন , মুখে মৃদু হাসি। "আপনার ঈশ্বর যেন আপনাকে একটি মুক্ত মন প্রদান করেন।"
এই কথা বলে তিনি এগিয়ে চললেন নতুন দিগন্তের পথে, ইতিহাস রচনার প্রস্তুতিতে। পিছনে রয়ে গেল সমুদ্রের নোনা বাতাস, বিতর্কের ঝড়, আর এক মিশনারি ও তাঁর অনুগামীবৃন্দ যাঁদের মনে রয়ে গেল অসংখ্য অনুত্তরিত প্রশ্ন।
৫.
ভ্যাঙ্কুভার থেকে ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। কাঠের কামরাগুলো ভর্তি—নতুন জীবনের আশায় যাত্রীরা, সন্দেহজনক সেলসম্যান, আর চরম পরিশ্রান্ত স্থানীয়দের দিয়ে। স্বামী বিবিধানন্দ তাঁর মলিন জিনিসপত্রের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে কোণের সিটে বসে পড়লেন। বেঞ্চটা এমনই শক্ত যেন মনের অনুশোচনা দিয়ে গড়া। তিনি হালকা শ্বাস ছেড়ে বললেন, "এই পাঁচ হাজার টাকার দাম যেন ওঠে।"
ট্রেনের ভেতরের বাতাস ভারী—এতটাই ভারী যে ভারতীয় কোনো ধর্মমঠের পায়েসকেও হালকা বোধ হয়। বাসি পাউরুটি, পাইপের কড়া তামাক, আর কোনো অজানা সিদ্ধ মাছের গন্ধে পুরো রেল কামরা ভরপুর। তাঁর সামনে বসা আরেক বিজাতীয় লোক চিবোচ্ছে এমন কিছু, যা চুইংগাম হতে পারে, আবার রাবারও।
“ভাই, অনেক দূরের পথ?” লোকটা জিজ্ঞেস করল।
"সম্ভবত," বিবিধানন্দ উত্তর দিলেন ক্লান্ত স্বরে। ইতিমধ্যেই এমন এক দেশে এসে পড়েছেন যেখানে গতি নিয়ে গর্ব হলেও ট্রেনগুলো কচ্ছপের মতো চলে।
প্রথম দিনের মধ্যভাগে, এক শুকনো চেহারার লোক, যার মুখে অতিরিক্ত উৎসাহের হাসি, বিবিধানন্দের পাশের সিটে বসলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি জীর্ণ ব্রিফকেস, যা তিনি খুলে বেশ গুছিয়ে খানিক গলা ঝেড়ে নিয়ে বাক্যালাপ শুরু করলেন।
“আপনি প্রভুর বাণী শুনেছেন কি, বন্ধু?” লোকটি একটি বাইবেল এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ।
“অনেক বাণী শুনেছি, প্রভুর বাণী তার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে,” বিবিধানন্দ সামান্য পিছিয়ে গিয়ে বললেন।
লোকটি পাপ, পরিত্রাণ, আর প্রাচ্যদেশের তথাকথিত অন্ধকার নিয়ে এক লম্বা বক্তৃতা শুরু করলেন । বিবিধানন্দ, কোনো ভাবান্তর না এনে, অবশেষে বললেন, “আপনি আলো নিয়ে অনেক কথা বললেন, কিন্তু তা কি এই ট্রেনেই ভাগ করবেন না? কারণ এই মুহূর্তে ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না।”
সেলসম্যান থেমে না থেকে আবার বললেন “আপনারা এত দেবতা পূজা করেন, এটা কি অদ্ভুত নয়? একটাই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা!”
বিবিধানন্দ হালকা হাসলেন। “অদ্ভুত? হয়তো! তবে ততটাই অদ্ভুত, যতটা মহাকালকে ট্রিনিটিতে ভাগ করা কিংবা ধরে নেওয়া যে প্রভুর তাঁর ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি প্রকাশনা সংস্থার দরকার।”
সময় যত এগোচ্ছে , ততই অস্বস্তি বেড়ে চলেছিল। ট্রেনের দুলুনি এবং যান্ত্রিক আওয়াজে ঘুমানো একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কোণের একদিকে একটা শিশু অবিরাম কেঁদে চলেছে, আর অন্যদিকে একজন লোক করাতকলের মতো নাক ডাকছে।
একসময় ট্রেন হঠাৎ করে এক শূন্য প্রান্তরের মাঝখানে থেমে গেল। যাত্রীরা নানা তত্ত্ব দিতে শুরু করল—ইঞ্জিনের সমস্যা, পলাতক গবাদী পশু, বা হয়তো ঐশ্বরিক ইঙ্গিত। বিবিধানন্দ জানালা দিয়ে ঝুঁকে বাইরে তাকালেন এবং দেখলেন কন্ডাক্টর ধীরেসুস্থে ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন।
“আমার অনুমান, প্রভু আপনাকে একটু বিশ্রাম নিতে বলেছেন?” বিবিধানন্দ ডাক দিয়ে বললেন।
কন্ডাক্টর হাত নেড়ে বললেন, “ইঞ্জিনটাকে একটু ঠান্ডা হতে দিচ্ছি।”
একটি ছোট স্টেশনে কিছু মিশনারি ট্রেনে উঠলেন, এবং বিবিধানন্দকে দেখে তাঁদের চোখ ঝলমল করে উঠল। তাঁদের মধ্যে একজন, গায়ের রঙ লালচে, পৃথুলা মহিলা, হাতে রোজারি ধরে তাঁর পাশে বসে পড়লেন।
"আপনি কি সত্যিকারের ধর্মের অনুসারী?" তিনি সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন।
"সত্য যেখানে নিয়ে যায়, আমি সেখানেই যাই," বিবিধানন্দ শান্তভাবে জবাব দিলেন।
মিশনারিরা একে অপরের দিকে তাকালেন, যেন সুযোগ বুঝেছেন। তাঁরা মূর্তিপূজার “ভুল”, প্রাচ্যের “আদিম” বিশ্বাস, এবং তাঁদের ধর্মের “সর্বজনীন সত্য”-এর উপর বক্তৃতা শুরু করলেন।
বিবিধানন্দ ধৈর্য সহকারে সব শুনলেন, তারপর বললেন, “ম্যাডাম, আপনার শাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘শব্দ রূপ নিল মাংসের’। আমার দেশে আমরা সবকিছুর মধ্যে দেবত্ব দেখি—সূর্য থেকে পাথর পর্যন্ত। বলুন তো, একজন মানুষের মধ্যে ঈশ্বর দেখতে পাওয়া আর একটি মূর্তির মধ্যে ঈশ্বর দেখতে পাওয়া কি খুব আলাদা?”
মিশনারিরা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। যদিও একজন ফিসফিস করে বললেন, “অধর্ম!”
“না,” বিবিধানন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি!”
তৃতীয় দিনে ট্রেনের খাবারের যোগান প্রায় শেষ। হালকা ব্যাগ নিয়ে যাত্রা করা বিবিধানন্দ অন্য যাত্রীদের দয়ার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হলেন। এক বৃদ্ধা তাঁকে একটি এতটাই শক্ত পাউরুটি দিলেন, যা অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারত।
"ধন্যবাদ," পাউরুটিতে সাবধানে কামড় দিয়ে তিনি বললেন, "এটা... বেশ টেকসই "।
কাছেই একদল লোক নুন-মাখা মাংসের শেষাংশ নিয়ে ঝগড়া করছিল। তাদের দিকে তাকিয়ে বিবিধানন্দ ধীরে বললেন, "আর এরা আমাদের বলে বর্বর।"
ট্রেনের জানালা দিয়ে বিস্তৃত প্রান্তর ও পর্বতমালা দেখছিলেন বিবিধানন্দ। এই বিশাল দেশ তাঁকে ভাবিয়েছে—মানুষেরা একদিকে উদার, অন্যদিকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ; তাদের সংস্কৃতি আকর্ষণীয় হলেও ত্রুটিপূর্ণ।
"এই দেশ," তিনি ভাবলেন, "এই ট্রেনের মতোই। এগিয়ে চলেছে, কিন্তু এর ভিতরে গাদাগাদি করা মানুষদের তার মূল্য দিতে হচ্ছে। "
চতুর্থ দিনে ট্রেন, সেতু পার হওয়ার সময় প্রায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়ছিল। কাঠের সেতু ওজনের চাপে কেঁপে উঠছিল, আর যাত্রীরা আতঙ্কে প্রার্থনা করতে করতে রোজারি, বাইবেল এবং একে অপরকে আঁকড়ে ধরেছিল। বিবিধানন্দ শান্তভাবেই বসে ছিলেন, তবে তাঁর ঠোঁটে ফুটে উঠল এক ব্যঙ্গাত্মক স্বগোতক্তি ।
"যদি এই ট্রেন আমাকে ঈশ্বরের কাছে পাঠাতে চায়, তবে অন্তত এই মহাদেশের উপযুক্ত ঈশ্বরের কাছেই পাঠাক।"
ট্রেন লাইনচ্যুত হয়নি, তবে সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা যাত্রীদের সবাইকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল।
কয়েক দিনের অস্বস্তির পর ট্রেন শিকাগোতে পৌঁছাল। বিবিধানন্দ প্ল্যাটফর্মে পা রাখলেন, তাঁর পা কিছুটা টলমল হলেও, আত্মবিশ্বাস অটুট। শহরটা জীবন্ত, গাড়ি চলছিল, মানুষ কথা বলছিল, আর বাতাসে কয়লা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার তীব্রগন্ধ ভেসে আসছিল।
একটি কৃষ্ণাঙ্গ পথশিশু তাঁর সামনে এসে, তাঁর পোশাক টানতে লাগল। “আপনি কি হারিয়ে গেছেন?”
“ঠিক হারানো না,” বিবিধানন্দ একচিলতে হাসি মুখে বললেন। “শুধু… ভুল জায়গায়।”
ছেলেটা হাসল। “শিকাগোতে স্বাগতম। একটুকু খাবারের জন্য অর্থ আছে?”
বিবিধানন্দ তাঁর পকেট টেনে দেখালেন। “না, তবে আমার কাছে কিছু বিনিময় করবার মত ধারণা আছে। দেখি, সেগুলো যথেষ্ট কিনা।”
শহরের কোলাহলের দিকে এগিয়ে চললেন বিবিধানন্দ।
৬.
অলিভার বার্নাবি একজন আত্মম্ভরী ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, যাঁর বক্তৃতা এতই দীর্ঘ হয় যে তাঁর গির্জার ইঁদুরগুলোও শান্তির খোঁজে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। বার্নাবির একটি মাত্র লক্ষ্য—শিকাগোতে একটা বিশ্বধর্ম সম্মেলন আয়োজন করা, যেখানে খ্রিস্টধর্মকে মানবজীবনের আধ্যাত্মিক চূড়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
এমতাবস্থায় এলেন এডগার মেফিল্ড, এক অদ্ভুত আদর্শবাদী, প্লেটোর মতো পোশাক পরেন কিন্তু কথা বলেন বিংশ শতাব্দীর কোনো ব্যর্থ পিরামিড স্কিম কনভেনশনের মোটিভেশনাল স্পিকারের মত। মেফিল্ড মনে করতেন এই সম্মেলন সমস্ত ধর্মকে সার্বজনীন ঐক্যের পতাকার নিচে একত্র করবে। বার্নাবি তাঁর উৎসাহ বিরক্তিকর মনে করলেও তাঁকে সহ্য করলেন, কারণ মেফিল্ডের কাছে যা ছিল, তা বার্নাবির কাছে ছিল না—একটা বাস্তব পরিকল্পনা।
তাঁদের অর্থদাতা আর্থার উইলমিংটন, এক ধনী আইনজীবী, যিনি সিগার ও তিক্ততা পছন্দ করেন। তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই উদ্যোগে টাকা দিলেন। “আমি তোমাদের এই ধর্মীয় মেলায় টাকা দেব,” তিনি বললেন, “কিন্তু যদি এটি একটি সার্কাসে পরিণত হয়, তখন আমার কাছে এসে মরাকান্না কেঁদো না।”
আয়োজকরা সারা বিশ্বে আমন্ত্রণপত্র পাঠালেন। বার্নাবির চিঠি ছিল আত্মম্ভরিতায় পূর্ণ: “আসুন খ্রিস্টের আলোয় আলোকিত হতে ”। মেফিল্ডের চিঠি ছিল কাব্যিক কিন্তু অস্পষ্ট: “ধর্মের সুতোয় গাঁথা একটি বৈশ্বিক ট্যাপেস্ট্রিতে যোগ দিন।” উইলমিংটন শুধু চেক সাইন করলেন এবং বললেন, “এই ট্যাপেস্ট্রির খরচ যদি একখানা পার্সিয়ান গালিচার চেয়েও বেশি হয়, তবে আমি সোজা হাত গুটিয়ে নেব।”
প্রত্যুত্তর আসতে শুরু করল। একজন শিন্টো পুরোহিত সানন্দে ‘হ্যাঁ’ বললেন। এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “তিব্বতি খাবার থাকবে তো?” কানসাসের এক স্বঘোষিত ভবিষ্যৎদ্রষ্টা দাবি করলেন যে তাঁকে মূল বক্তা করতে হবে। এর মধ্যেই, ভারত থেকে এক মহারাজের চিঠি এসেছে আমেরিকার বুদ্ধিজীবী মহলে স্বনামধন্য কিছু মানুষের হাত ঘুরে একাধিক সার্টিফিকেট সহ, যেখানে সুপারিশ করা হয়েছে স্বামী বিবিধানন্দের নাম, যাঁকে এক উজ্জ্বল বক্তা এবং আধুনিক হিন্দুত্বের বর্ণনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ।
মেফিল্ড উচ্ছ্বসিত হলেন। “এটাই সেই বৈচিত্র্য যা আমাদের প্রয়োজন!” তিনি ঘোষণা করলেন। বার্নাবি ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এরপর কি হবে? সাপুড়ে আর আগুন নাচানোর সার্কাস ?” উইলমিংটন নির্বিকারভাবে বললেন, “যদি তিনি বক্তৃতার জন্য ফি না চান, তবে কোনো আপত্তি নেই।”
বিবিধানন্দের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বার্নাবি লড়াই শুরু করলেন। “একজন মূর্তিপূজক সন্ন্যাসী! উনি আর কী দেবেন? মন্ত্রোচ্চারণ আর গরু পূজার গল্প?” তিনি বিদ্রুপ করলেন।
মেফিল্ড পাল্টা জবাব দিলেন, “তিনি বিশ্বের প্রাচীনতম আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যগুলোর একটি এই মঞ্চে উপস্থাপন করবেন। তাছাড়া, এটা সংবাদপত্রে ভালো দেখাবে।”
উইলমিংটন সুযোগ দেখে বললেন, “ভাবুন তো হেডলাইন কেমন হবে: ‘খ্রিস্টধর্ম পূর্বকে স্বাগত জানায়।’ আমাদের প্রগতিশীল দেখাবে, চাইলেও বা তা না হোক।” বার্নাবি অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলেন, মনে মনে “পৌত্তলিক নাটকীয়তা” নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে।
সম্মেলনের উদ্বোধনের দিন যত এগিয়ে এল, ততই বিশৃঙ্খলা বেড়ে গেল। উইলমিংটনের কর্মচারীরা বিভিন্ন ধরণের খাদ্যাভ্যাস সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল। একজন বলল “কোশার, হালাল, ভেজিটেরিয়ান —এবং এই সন্ন্যাসী চান কী? ভাত আর ডাল? উনি কি সিয়ামের রাজা?”
মেফিল্ড আসন বিন্যাস নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। “ইমামকে রাব্বির পাশে বসাবেন না; বিপত্তি ঘটবে। এবং যাজককে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর থেকে দূরে রাখুন—পুনর্জন্ম নিয়ে গত রাতের ডিনারে গরমাগরম তর্ক হয়েছিল।”
এরই মাঝে হাজার বাইবেল মুদ্রণের আদেশ দিলেন বার্নাবি। উইলমিংটন গর্জে উঠলেন, “এটা ক্রুসেড ক্রুসেড খেলা নয়, অলিভার! নিজে টাকায় এসব ফুটানি করো।”
৭.
শিকাগোর প্রথম দিনটা ছিল এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতো। শহরের রাস্তাগুলো জীবন্ত, কিন্তু কেউই খেয়াল করল না বিদেশী সন্ন্যাসীকে, যিনি প্রশস্ত রাস্তা আর উঁচু-উঁচু ভবনের মাঝে পথ চলছিলেন।
বিবিধানন্দ একটি ক্যাফেতে পৌঁছালেন যেখানে “সকলেই স্বাগতম” লেখা।
“ভাই,” বিবিধানন্দ ক্যাফে মালিককে বললেন, “আমার কাছে টাকা নেই, কিন্তু আমি সামান্য কিছু খাবার চাই, যাতে টিকে থাকতে পারি। আমাদের দেশে আমরা উপবাসীকে খাওয়ানোকে পুজো হিসেবে দেখি।”
মালিক চোখ পাকিয়ে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করলেন, তারপর কঠিন গলায় বললেন, “এখানে আমরা শিখেছি, খাবারের বিলটা আগে পরিশোধ করতে হয়, তারপর উপদেশ।”
বিবিধানন্দ নিজেকে হাসতে দিয়েই বললেন, “ঠিক আছে”। তারপর কঠিন শীতে আবার বাইরে চলে গেলেন।
গত কয়েকদিনে অবস্থা ভয়ানক হয়ে উঠেছিল। ক্লান্ত শরীরে ভারত ফিরে যাওয়ার চিন্তা বিবিধানন্দকে দীন-হীন করে তুলেছে।
বিবিধানন্দ স্বাভাবিক পরিব্রাজকীয় প্রবণতায় খট খট করলেন তাঁর সম্মুখের পেতলের প্লেক লাগানো দরজায়। প্লেকে লেখা বাড়ির মালকিনের নাম - মার্গারেট স্ট্যানহোপ: লেখক, শিক্ষক, সংস্কারক।
দরজা খুলল। এক মধ্যবয়সী মহিলা, ঘরের ভেতর থেকে চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দৃঢ় মনোভাব দিয়ে বিবিধানন্দের উপর-নিচ মেপে নিলেন।
“ইয়েস ?” তিনি বললেন, বেশ অবহেলাপূর্ণ কণ্ঠে।
“আমি ভারতীয় এক সন্ন্যাসী,” স্বামীজী শুরু করলেন, তার কন্ঠস্বর শান্ত ছিল। “আমি ধর্মীয় মহাসভার জন্য এসেছি, কিন্তু যদি আগে কিছু খেতেই না পাই, তো সেখানে পৌঁছানো অসম্ভব হবে।”
মার্গারেট বললেন “ধর্মীয় সভায় আপনি কথা বলবেন? আর আপনি যদি এখানে পৌঁছানোর আগে মরে যান, তখন কী বলবেন?”
বিবিধানন্দ মৃদু হাসলেন। “হ্যাঁ, খিদে তো একটি সার্বজনীন ভাষা, আর আমি এতে পটু হয়ে গেছি।”
মহিলার ঠোঁট হালকা হাসির চেহারা পেল। “তাহলে, আসুন। দেখুন, আমি কী করতে পারি।”
ভেতরে, মার্গারেট তাঁকে একটি চেয়ারে বসিয়ে এক পাত্র পাউরুটি আর স্যুপ দিলেন। খাওয়ার সময়, তিনি তাঁর যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। মার্গারেটের প্রশ্নপুঞ্জে কৌতূহলের পরিমান সহানুভূতির চেয়ে কম শোনালেও বিবিধানন্দ সেসব গ্রাহ্য করলেন না।
"মনে হয় দেবতারা আমার সহ্যশক্তির পরীক্ষা নিয়েছেন " - বললেন বিবিধানন্দ।
মার্গারেট হেসে বললেন, “তাহলে তাঁরা একদম সঠিক শহর বেছে নিয়েছেন। শিকাগো কখনোই অতিথিপরায়ণতার জন্য পরিচিত নয়।”
“আপনি বলছেন আপনি ধর্মীয় মহাসভার জন্য এসেছেন। জানেন কি তা কোথায় অনুষ্ঠিত হবে?” মার্গারেট প্রশ্ন করলেন।
বিবিধানন্দ কিছুক্ষণ থেমে উত্তর দিলেন “বিশুদ্ধভাবে জানি না। আমার তহবিল শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই সঠিক দিকনির্দেশনা নিতে পারিনি।”
মার্গারেট মাথা নাড়লেন। “এভাবে তো আপনি কখনই সেখানে পৌঁছাতে পারবেন না। সভার সংগঠকরা একজন পথভ্রষ্ট সন্ন্যাসীকে মানচিত্র দেবেন না।”
তিনি একটু থেমে বললেন, “আমি সাহায্য করতে পারি—সাময়িক, মনে রাখবেন। তবে শুধু যদি আপনি ভারতের বিষয়ে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দেন। আমি বহু বছর ধরে আপনার দেশ সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছি, আর এখন আমি একটি প্রাথমিক উৎস পেয়েছি।”
সহাস্য মুখে বিবিধানন্দ বললেন, “আমি আপনার সেবায় আছি, যতক্ষণ না আপনি প্রশ্ন করবার জন্যও টাকা দাবি করবেন।”
মার্গারেটের মাধ্যমে, বিবিধানন্দ মিসেস এলিজা গ্রাহামের সাথে পরিচিত হন। প্রভাবশালী, ধনী এবং অসাধারণ মানুষ চিনে নেওয়ার দক্ষতা সম্পন্ন এলিজার বাড়ি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপের কেন্দ্র, যেখানে রাজনীতিবিদ, লেখক এবং সংস্কারকরা এসে মিলিত হন বিভিন্ন ছুতোনাতায়।
একদিন মার্গারেট স্বামীজীকে এলিজার বাড়ির একটি আড্ডায় নিয়ে গেলেন, সেখানে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলেন বিবিধানন্দকে দেখে। বিবিধানন্দের গেরুয়া পোশাক চারপাশের গম্ভীর স্যুট এবং গাউনগুলোর সঙ্গে বৈপরীত্য তৈরি করেছিল।
তবে এলিজা, তাঁর কাছে গিয়ে উষ্ণভাবে বললেন, “স্বাগতম, মিস্টার…?”
“বিবিধানন্দ,” একটু ঝুঁকে আত্মপরিচয় দিলেন স্বামীজী।
“ওহ, সেই ভারতীয় সন্ন্যাসী যাঁর কথা মার্গারেট বলেছিল,” এলিজা উজ্জ্বল চোখে বললেন। “আসুন, বসুন। আমাদের অনেক কথা বলার আছে।”
“আপনারা কি সত্যিই বানর পূজা করেন?” আলোচনার মাঝে একজন অতিথি প্রশ্ন করলেন, তাঁর কণ্ঠে ছিল উপহাস।
“হ্যাঁ, আর আমরা হাতি-ও পূজা করি। এখানে আমেরিকায়, শুনেছি আপনারা ঈগল পূজা করেন—আর মাঝে মাঝে ডলারও " - নির্ভীক উত্তর বিবিধানন্দের।
ঘরে উপস্থিত সকলেই হাসির রোলের মধ্যে ডুবে গেলেও, প্রশ্নকর্তা তেমন আনন্দিত হলেন না।
আরেকজন অতিথি বললেন, “আপনি কি স্বর্গে বিশ্বাস করেন?”
বিবিধানন্দ সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, “আমি বিশ্বাস করি, এটি এমন একটি স্থান, যেখানে একজনকে তাঁর বিশ্বাসের ব্যাখ্যা করতে হয় না ডিনারে।”
এলিজা, ঘরের কোণে বসে থেকে, হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। তিনি ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন, এই সন্ন্যাসী একেবারেই সাধারণ অতিথি নন।
পরবর্তী কিছু সপ্তাহে, এলিজা এবং মার্গারেট বিবিধানন্দের প্রধানতম সাহায্যকারী হয়ে উঠলেন। তাঁরা তাঁকে খাদ্য এবং আশ্রয় দিয়ে শিকাগোর সমাজের জটিলতার সাথে পরিচয় করানোর গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
এক সন্ধ্যায়, একটি বিলাসবহুল ডিনারের সময়ে, একজন অতিথি প্রশ্ন করলেন, “আপনি পশ্চিমী পোশাক পরবেন না কেন? এতে আপনি আরও... সম্মান পাবেন। "
বিবিধানন্দ হেসে বললেন -“আমাদের দেশে, সম্মানের বিচার হয় আমাদের কাজের দ্বারা, পোশাক দ্বারা নয়। কিন্তু বলুন, একটা স্যুট কি একজনকে আরও স্পষ্টভাবে চেতনায় উন্নততর করতে সাহায্য করে?”
ধর্ম সম্মেলনের আর মাত্র কুড়ি দিন বাকি। ইতিমধ্যেই ধর্ম সম্মেলনে সনাতন বা হিন্দুধর্মের বক্তা হিসেবে বিবিধানন্দের নাম অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছেন আয়োজকরা, কারণ ভারতের বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী মহল থেকে তাঁর যাত্রার উদ্দেশ্য শংসায়িত করে চিঠি এসেছে।
৮.
শিকাগো শহরের বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন শুরু হয়েছে। বিশাল প্রেক্ষাগৃহে, এক এক করে নির্বাচিত ধর্মীয় নেতারা তাঁদের বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। সবার মধ্যে যেন এক ধরনের তৃতীয় বিশ্ব দেশের ‘পরিচয়’ পাওয়া যাবে এমন একটা ভাব। বিবিধানন্দ ব্যাকস্টেজে নির্ধারিত জায়গায় বসে শুনছেন সবার কথা খুব মন দিয়ে, আর মাঝে মাঝে মাদ্রাজি চুরুটে টান দিতে একটু দূরেই ফাঁকা একটা জায়গায় চলে যাচ্ছেন। পুরোনো বন্ধু বোধি বজ্রধরের বক্তৃতার পরেই এল বিবিধানন্দের পালা, সভার প্রথম দিনের শেষতম ব্যক্তি।
"আমেরিকাতে আমার সমস্ত বোন এবং ভাইয়েরা, যাঁরা এখনও "সহনশীলতা" শব্দটাকে কোনো ওষুধের নাম বলে ভাবছেন অথবা ভাবছেন না " - এইটুকু উচ্চারণ করতেই করতালি আর উন্মাদনায় প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়লো।
"আমার হৃদয় এতটাই আনন্দে পরিপূর্ণ যে মনে হচ্ছে, এখনই এই মঞ্চ থেকে ভাসতে ভাসতে উড়ে যাব। তবে নিশ্চিতভাবেই আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ চাইবেন, আমার এই উড়ন্ত বক্তৃতা যেন দ্রুততম সময়ে দরজার বাইরে চলে যায়। কিন্তু বিধি বাম, আমি আছি, আপনাদের সঙ্গেই আছি আরো কিছুটা সময়। আর আপনাদের এই উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য ধন্যবাদ। এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা, যা দেখে ব্রিটিশ অভিজাতরাও হাসি থামাতে পারবেন না (অথবা অন্তত চেষ্টা করবেন)।
সত্যটা সোজাসুজি বলি: আমি এমন এক সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করছি, যা আপনার পূর্বপুরুষদের জল না পুড়িয়ে ফুটানোর দক্ষতার চেয়েও প্রাচীন। আমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি, যেখানে সন্ন্যাসীরা ধ্যান করেন এমন দক্ষতায়, যা আপনার অ্যালার্ম ঘড়ির থেকেও নির্ভরযোগ্য।
আপনাদের মধ্যে অনেকে বলছেন, আমরা প্রাচ্যবাসীরা নাকি সহনশীলতার আবিষ্কর্তা। সত্যি কথা! আর জানেন কেন আমরা এর পেটেন্ট নিইনি? কারণ, মানবতা, ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম । আমরা কেবল সহনশীলতা আবিষ্কার করিনি, আমরা তার এক ধাপ ওপরে গিয়ে এর বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছি। যখন আপনারা যুদ্ধ করছিলেন, কার দেবতার পোশাক বেশি দামী তাই নিয়ে, আমরা তখনই আমাদের ভূমিতে প্রতিটি নিপীড়িত গোষ্ঠীকে স্বাগত জানিয়েছিলাম, যেন এক মহাজাগতিক বাজেট হোটেল।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে? আসুন, ইহুদিদের কথা বলি। তারা রোমানদের অত্যাচারে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছিল বহু শতাব্দী আগে। আর আমরা শুধু তাদের থাকতে দিইনি; নিশ্চিত করেছি তাদের খাবারের সাথে আমের চাটনিও যাতে থাকে । এরপর এলেন জোরাথুস্ত্রীয়রা। আমরা কি তাদের অগ্নি-উপাসনার অভ্যাস বদলাতে বলেছিলাম? না, আমরা বলেছিলাম, 'স্বাগত! এখানে কিছু জায়গা আছে। আগুন জ্বালাও, শুধু পাশের বাড়ির ছাদের খড় পুড়িও না ।'
জীবন হলো কয়েকটা নদী, যা শেষমেশ একটাই মহাসাগরে মিশে যায়। কিছু নদী অলস, কিছু বক্রপথে চলে, আর কিছু নাটুকে ঝরনার মত । কিন্তু তারা সবাই শেষমেশ একই লবণাক্ত জলের কাছেই যায় । সহজ কথায়, আপনি যা বিশ্বাস করতে চান করুন, যেভাবে প্রার্থনা করতে চান করুন, তবে অন্য কাউকে জোর করে সেই নদীতে ডুবিয়ে দেবেন না, প্লিজ।
এবার আসা যাক সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি আর উগ্রতার দিকে— সভ্যতার এই তিন কুৎসিত সৎ-বোন। এরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একই ধ্বংসাত্মক খেলা খেলছে আমাদের নিয়ে। আর উপহার? রক্তে ভেজা মাটি, পুড়ে যাওয়া লাইব্রেরি এবং একই ধরণের কিছু ট্র্যাজিক হেডলাইন । যদি এরা একটা গানের দল হতো, তবে এদের হিট গান হতো "ধ্বংসের সভ্যতা" এবং "ডি মাইনরে হতাশা"। এই গানের দলকে এখনই অবসর নিতে হবে।
আমি আশা করি, উগ্রবাদের গৌরবময় শবযাত্রার সূচনা হবে এই ধর্মসভার প্রেক্ষামঞ্চ থেকেই। আসুন এমন একটি পৃথিবীর জন্য স্তব-স্তুতি করি যেখানে কেউ কারও দেবতার ব্যাকস্টোরি নিয়ে ঝগড়া করে বন্দুক বের করবে না। ধর্ম নিয়ে ফুটবল খেলা বন্ধ হোক।
ধন্যবাদ, এবং করতালি দিন— অন্তত নিজের মনের অস্বস্তিকর নীরবতাকে ঢাকতে।"
বিবিধানন্দের এই উদ্ভট দাপুটে বক্তৃতার পর বোধি বজ্রধর এক তুরীয় আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন নিজের আসন ছেড়ে। ইহুদি ধর্মের প্রচারক ইলিয়াহু গোল্ডস্ট্রোম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে চেয়ার উল্টে ভূপতিত হলেন। প্রাচীন তাওবাদী দার্শনিকতার প্রতিনিধি, গম্ভীর এবং সংযত ঝাও ইয়েনহুয়া তাঁর পাশেই বসে থাকা আগুনের পূজার ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলার সুদক্ষ বক্তা আরেশ ফ্রাভাষিকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করলেন সজোরে। শান্তি ও প্রগতির কথা বলার জন্য আগত মৌলবী আতিফ রশিদি উত্তেজনায় নিজের দাড়িতে একাধিক শক্ত গিট পাকিয়ে কটমট করে খানিক তাকিয়ে রইলেন উন্মত্ত জনতার দিকে এবং তারপর হঠাৎই ‘এক্সিলেন্ট এক্সিলেন্ট’ বলে নিজেই চিৎকার করতে লাগলেন। গৃহস্থ খ্রিস্টান মিশনারি নেতা এডওয়ার্ড ক্রসফিল্ড বক্তৃতায় অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহারকারী হিসেবে অনেকের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠলেও আন্তরিক ভাবে জড়িয়ে ধরলেন বিবিধানন্দকে।
পরের দিন বহুমত অথবা ভিন্নমতবাদ এবং তার কারণে উদ্ভুত মতপার্থক্য নিয়ে বিবিধানন্দ বললেন - "আমাদের অজ্ঞানতাই সমস্যা। আপনি অন্যের ধর্ম বুঝবেন কীভাবে, যদি আপনার নিজের ধর্মের বইতেই ধুলো জমে থাকে? এই অজ্ঞানের রাজত্ব শেষ করতেই আমি এখানে দাঁড়িয়েছি। শাস্ত্রে বলে, জানার চেষ্টা কর, না জানলে জিজ্ঞাসা কর। আর যদি জিজ্ঞাসাও না কর, তাহলে চুপ করে থাক। চিৎকার করে লোকের মাথা খেয়ো না। এটা আমার ছোটবেলায় মা শিখিয়েছিলেন। তবে সেটা ধর্ম নিয়ে ছিল না, পায়েস নিয়ে ছিল।"
পরের দিন আরো একধাপ এগিয়ে তিনি বললেন “আমাদের শাস্ত্রে বলে, ‘কর্ম করে যাও, ফলের আশা করতে যেও না।’ পশ্চিমে দেখে মনে হলো, এখানে সবাই বলে, ‘ফল নিয়ে টানাটানি কর, অন্যের গাছ থেকে ছিঁড়ে আনো।’ বুঝলেন? এটিই পার্থক্য।”
তৃতীয় ভাষণে ধর্মে বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিবিধানন্দ বললেন - "গাধার কাঁধে বিজ্ঞান চাপালে সে ব্যাটা সেটাও ধর্ম বানিয়ে ফেলবে, আর মানুষের হাতে ধর্ম দিলে সেটা বিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে।”
চতুর্থ দিন অবশ্য কৌতুকের চেয়ে আবেগের রোমান্টিকতা একটু বেশি ছিল। বিবিধানন্দ বললেন - "আমি একদিন স্বপ্নে দেখলাম, সব ধর্মের লোক একসাথে বসে মাংসের ঝোল-ভাত খাচ্ছে। সবাই খুশি। কেউ কাউকে বাটি নিয়ে মারছে না। কেউ বলছে না, ‘তোমার ভাত আমার চেয়ে সাদা কেন "। আবেগের অতিশয্যে সেদিন উপস্থিত সকলেই প্রায় হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন বলে ফলাও করে খবর ছাপা হল আমেরিকার সব কাগজে।
শেষদিনের বক্তৃতায় বিবিধানন্দ একটু অন্যরকম মেজাজে বললেন, “আজকের এই সভার সাফল্যে আমি খুশি। তবে কথা আছে। আপনারা যে এত উদার হতে শিখলেন, সেটা ঠিক কতদিন চলবে? তিনদিন? একমাস? পরের বছর অবধি টিকবে তো, নাকি আমরা আবার ‘আমার ধর্ম সেরা’ বলে মারামারি করব?”
তিনি আরও বললেন, “এই মঞ্চে যত লোক বসে আছেন, প্রত্যেকে যদি একটা করে ইট নিয়ে ফিরে যান, তাহলে সেটা দিয়ে আগে একটা মন্দির বা মসজিদ বা গির্জা নয়, একটা করে স্কুল তৈরি করুন। কারণ, ধর্ম তখনই ভালো থাকে, যখন মানুষ শিক্ষিত হয়।”
শেষে একটা বিজ্ঞ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এবার করতালি দিন । সেটা আমাকে উৎসাহিত করার জন্য নয়, বরং আপনাদের নিজের বিবেককে জাগানোর জন্য। হয়তো এই সময়ে পৃথিবীর চেয়ে দুরবর্তী কোন গ্রহে, অন্য সৌরমন্ডলে আমারই মত কেউ তার জগৎশুদ্ধ মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার কাজটাই করছেন আমার থেকেও সিরিয়াস ভাবে।"
সতেরোদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানে, বলাই বাহুল্য, বিবিধানন্দ রীতিমতো আলোড়ন তুললেন শিকাগো এবং আমেরিকায়। খবরের কাগজ থেকে বুদ্ধিজীবি মহলের সুরার আড্ডা, সর্বত্র, একটাই নাম - বিবিধানন্দ।
এদিকে জ্ঞানগরিমাকে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও যে ব্যবসা ফেঁদে বসা যেতে পারে, তার আন্দাজ অনেকদিন আগেই পেয়ে গিয়েছে এই স্বাধীনতার দেশ। তাই, মোটিভেশনাল কোর্স বা পডকাস্ট যখন সুদূর ভবিষ্যৎ, তখন থেকেই এরকম ধরণের বক্তৃতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো একাধিক মার্কিনি সংস্থা, সম্পূর্ণভাবে বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে।
একদিন স্বামীজীকে পাকড়াও করলেন এমনই এক সংস্থার পদস্থ আধিকারিক জনৈক ডেভিড হ্যারিস, মিসেস এলিজা গ্রাহামের বাড়িতে এক আলোচনা সভায়।
৯.
সাগরপারে স্বাধীনতার দেশ আমেরিকায় ইদানিং অর্থবিতৃষ্ণ বিবিধানন্দ ওরফে নীরেন্দ্রনাথ দত্ত আছেন বেশ ভালই। শিকাগো বক্তৃতার পর কয়েক মাস অতিবাহিত। ১৮৯৩ সালের মাঝামাঝি আমেরিকায় পা রাখলেন, তার আগে পর্যন্ত তাঁর ভারতীয় অনুগামীদের কাছে তিনি ছিলেন চালচুলো এবং অর্থচিন্তাহীন এক সন্ন্যাসী। আর এখন, এখন তিনি চিঠি লিখছেন, তাঁর প্ৰিয় শিষ্য মাদ্রাজের ভেঙ্কাটেশ্বর আইয়ারকে, যার যার ছত্রে শ্লেষ আর তিক্ততা।
"এখানে আছি বড় সুখে। মিসেস মার্গারেট স্ট্যানহোপ এবং তাঁর আমন্ত্রিত বন্ধুবর্গের কাছে আমি -উত্তর কলকাতার কলকাতার হাতিবাগানের নীরেন্দ্রনাথ দত্ত, তোমাদের বিবিধানন্দ, বড় আমোদের সামগ্রী - ' ভারতাগত এক আজব জীব বিশেষ ' - আর সেইজন্যই আমার দারুণ খাতির এখানে। লোকজন পালা করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আমাকে দেখতে আসেন। আমি যেন আমার দীন দুঃখিনী বাংলার এক কন্যাদায়গ্রস্ত বাপের কন্যাটি, যাকে বরপক্ষ দেখতে আসছেন।"
স্বামীজীর চিঠি পড়ে জানা যাচ্ছে, ডলারপুজোর জন্য আমেরিকানদের গালমন্দ করেও সেই ডলার চাইতেই তাঁকে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়েছে একটি বক্তৃতা আয়োজক কোম্পানির সাথে। বক্তৃতাপিছু আড়াই হাজার ডলার কামিয়ে তাঁকে দু'শো ডলার সম্মান দক্ষিণা ধরিয়ে দেয় কোম্পানি, কিছু সুগন্ধি ফুলের বুকে আর কেক পেস্ট্রি সহ। বিবিধানন্দ নামটাকে বাঁদিক বরাবর কেটে ভিভি-ঢানান্ডা রূপে প্রতিষ্ঠা করা হয় অগ্রিম বিজ্ঞাপনে। আবার খরচ বাঁচাতে কেউ কেউ তাঁকে এক ইঞ্চি টাইপে ঢানান্ডা নামেও বিঘোষিত করে থাকেন।
যদিও, একটা মারাত্মক কাজ করে ফেলেছিলেন বিবিধানন্দ। ধর্ম মহাসভার ঠিক আগেই এক ঘরোয়া বক্তৃতায় তিনি বলে ফেলেছেন - "আমার পরাধীন দেশের প্রেয়সীর নাম দারিদ্র। আর সে দারিদ্রের রূপ ভয়াবহ। কিছু অর্থসঞ্চয় ক'রে দেশে ফিরে কারিগরিশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই আমি "। তারই সঙ্গে, ব্রিটিশ প্রশাসকদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন - "বন্য, বর্বর আর রাক্ষসের জাত ওরা। মুখে ভালবাসার কথা বলে, হাতে কসাইয়ের শান দেওয়া ছুড়ি নিয়ে। গলা কাটে আমাদের। যেদিন ভারত ছেড়ে যাবে ওরা, একটা সামান্য বিছানার চাদর পর্যন্ত আমাদের জন্য রেখে যাবেনা। পিছনে পড়ে থাকবে লাখ লাখ ভাঙা মদের বোতল। কিন্তু, ইতিহাসের প্রতিহিংসার আগুনে ওরা পুড়বেই। কোটি কোটি হুণ আর চীনেরা ওদের ছিঁড়ে খাবে, লাথি মেরে সমুদ্রে ফেলে দেবে "।
মিশনারীদের ভাতে মারছিলেন বিবিধানন্দ, অবশ্যই সচেতন ভাবে নয়। যীশুর সুসমাচার প্রচারের জন্য 'সভ্য' মিশনারীদের পৃথিবীর নানা 'অসভ্য ' প্রান্তে যেতে হত, আর সেই যাওয়ার খরচপাতির টাকা উঠে আসতো চাঁদা থেকে। কারা দিত চাঁদা? যাদের হৃদয় বিগলিত হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের করুণ অবস্থায়। অবস্থা যত করুণ, চাঁদার স্রোত তত প্রবল। তাই, ভারতের খেতে না পাওয়া, প্রায় ন্যাংটা কালামানুষের অসহনীয় কুসংস্কারের চেহারা ছবির বই হয়ে লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের ড্রয়িং রুমে এসে পৌঁছায় আর বাড়তে থাকে চাঁদার স্রোত। এমন সময়ে এসে জুটেছে একটা নতুন গেরুয়া উপদ্রব - বিবিধানন্দ!
তাবড় সব আঁতেল সামাজিক আবিষ্কারকরা খবরের কাগজে লিখছেন - "When Vividananda spoke, the missionaries saw they had a Napoleon to deal with" ইত্যাদি । স্পর্ধাভরা কণ্ঠে বিবিধানন্দ বলছেন - "ভারতের ধর্মশিক্ষার প্রয়োজন নেই পশ্চিমের কাছ থেকে। ভারত এই একটা ব্যাপারে অনেক অনেক এগিয়ে। "
সেইদিন এক বক্তৃতানুষ্ঠানে ভারতোৎসাহী এক আমেরিকান যখন জানলেন, তিনি ভারতে গিয়ে সতীদাহ দেখতে পাবেন না, বা পুরীতে জগন্নাথের রথের চাকার তলায় আত্মহনন দেখবার সুযোগও তাঁর কপালে নেই, তখন প্রচন্ড ক্রোধ আর কষ্টে তাঁর সোচ্চার আত্মজিজ্ঞাসা - "কী কারণে ওই পোড়া দেশে যাবো আর এতগুলো টাকা খরচ করে? "
মহাভারতের অভিমন্যু আর বিবিধানন্দ কী একটাই লোক? আজকাল এই প্রশ্নটাই বার বার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে স্বয়ং বিবিধানন্দের। এর কারণ অবশ্য কিছু ঘরের শত্রু বিভীষণ মিশনারীদের ভারতীয় বন্ধুবর্গ - তাঁদের মধ্যে আবার বেশ কয়েকজন সাধু সংস্কারক। শুরু হয়েছে বিবিধানন্দের বিরুদ্ধে মিশনারীদের প্রোপাগ্যান্ডা! সংবাদপত্রগুলো গর্জে উঠছে বিবিধানন্দের বিরুদ্ধে। জনৈক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার মারফৎ এক প্রভাবশালী মিশনারী নাকি খবর পেয়েছেন, বিবিধানন্দ আদতে কোন সন্ন্যাসী নন, একজন ভ্যাগাবন্ড আত্মপ্রতিনিধি মাত্র। এখন এখানে এসে তিনি গেরুয়া চড়িয়ে সাধুবাবার ভেক ধরেছেন। আসলে, ভারত নয়, বিবিধানন্দ একজন আত্মপ্রচারক।
কৌলিন্যবিরোধী, আত্মনির্মিত আমেরিকান শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে বিবিধানন্দ, তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত এবং মাদ্রাজী পৃষ্ঠপোষকদের প্রতিনিধি রুঘুরামকে এবং কলকাতার বন্ধুদের কাছে পত্রপ্রেরণ করলেন - ক্যারেক্টর সার্টিফিকেটের আশায়। প্রায় ছ'বছর পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন তিনি ভারতবর্ষ, কিন্তু দেশের মানুষকে তিনি চিনতে ভুল করেছেন। মাসের পর মাস কেটে যায় - এক টুকরো সমর্থনের চিঠি আসেনা ওপার থেকে। উপরন্তু, আমেরিকা নিবাসী মিশনারীদের কাছের মানুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার প্রচার করে বেড়াচ্ছেন, "চরিত্রহীন নীরেন্দ্রনাথ দত্তের সাধুবাবার ভেক ধারণ এবং আমেরিকান সম্ভ্রান্ত মহিলাগণের সাথে ঢলাঢলি " এর চিত্তাকর্ষক বাজারি গল্প।
যাইহোক, স্বামীজী এখন শিকাগোতে মিঃ কেম্পটনের বাড়িতে রয়েছেন কিছুদিনের জন্য। এক কোণে বইপত্রের স্তূপ, অন্যদিকে এক কাপ চা এবং সামনে লেখার টেবল। বাইরে গাড়ির শব্দ থেমেছে। বিশালদেহী এক ভদ্রলোক, ঘিয়ে সাদা রঙা চুল, চকমকে জুতো ও দামি কোট প্যান্ট পরে ঘরে প্রবেশ করছেন। তিনি জ্যাকস্টন ডি. রকওয়েল, শিকাগো নিবাসী এক ধনকুবের। বিনা অনুমতিতেই ঘরে ঢুকে এসে দেখলেন টেবলের সামনে বসে কী যেন লিখছেন বিবিধানন্দ।
"হ্যালো মিস্টার ভিভি..ডা.. " - বিবিধানন্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে রকওয়েলের প্রায় দাঁত ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হল।
"আমাকে বিবিধানন্দ নামের বোঝাটা ভালবেসে বইতে দিয়েছেন আমার বন্ধুবর্গ! অবশ্য, আমার আসল নামটিও নির্ভুল ভাবে আপনি উচ্চারণ করতে পারবেন না মিঃ রকওয়েল। কিন্তু, কোন ব্যাপার না, বলুন কী বলতে চান?" - লেখার কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন বিবিধানন্দ।
"এখানকার খবরের কাগজ গুলো তোমাকে নিয়ে খুব লাফালাফি করছে, অথচ তোমার নামটাও ঠিক মত লিখতে পারেনা, কী আশ্চর্য বিড়ম্বনা" - সকৌতুকে বললেন রকওয়েল।
"আমার নামের মহিমা নিয়ে তোমার মেকি আগ্রহ না দেখালেও তোমার আমাকে যা বলবার, তা আমি শুনতে প্রস্তুত মিঃ রকওয়েল" - বিবিধানন্দের গলার স্বর দৃঢ়তর হল।
"তুমি বলেছ টাকা কোনো সুখ এনে দেয় না। এটা তুমি বিশ্বাস কর ?" - রকওয়েল প্রশ্ন করলেন।
"তুমি কি সুখী?"- প্রশ্ন করলেন বিবিধানন্দ।
"এটাই তো আসল প্রশ্ন! আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। আর কী চাই?'- রকওয়েলের কণ্ঠে সংশয়।
"তোমার কী চাই, সেটা জানোনা বলেই এখানে এসেছো "- গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন বিবিধানন্দ।
" আচ্ছা! ধর, আমি সুখী নই। কিন্তু টাকা ছাড়া কীভাবে সুখ পাওয়া যায়?" - বললেন রকওয়েল।
"টাকা দিয়ে তুমি যা কিনতে পারো, সেটা ভোগ। সুখ পাবে কিছু দিয়ে, অর্থাৎ একমাত্র ত্যাগের দ্বারা " - বললেন বিবিধানন্দ।
"কিন্তু ত্যাগ করলেই তো আমার সম্পদ কমে যাবে? আমি যথেষ্ট পরিশ্রম করে বিত্ত প্রতিপত্তি অর্জন করেছি।" - বললেন রকওয়েল।
"একটা মোমবাতি থেকে আরেকটা মোমবাতি জ্বালালে কী আলো কমে যায়?" - প্রশ্ন করলেন বিবিধানন্দ।
"ভিভিঢ্যা.. নানডা, মিস্টার ভিভিঢানান্ডা... আপনার ফিলোজ্যফি অনেক উঁচুদরের, বাস্তবে তো সবাই নিজের স্বার্থ দেখে।" - এবার গলার স্বর নামলো রকওয়েলের।
"স্বার্থের পেছনে ছুটেই তো আপনি এখানে এসেছেন সুখের সন্ধানে । সুখ আপনার স্বার্থ নয়?" - বিবিধানন্দের কণ্ঠস্বর কঠিন।
বিবিধানন্দের আচরণের জন্য প্রস্তুত ছিলেননা রকওয়েল। এবার খানিকটা মেকি রাগ মুখে আনবার চেষ্টা করে একটা দামী চুরুট ধরাতেই, বিবিধানন্দও নিজের মাদ্রাজী চুরুট ধরালেন।
হঠাৎই, আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে রকওয়েল বেরিয়ে গেলেন। বিবিধানন্দও চুরুট নিভিয়ে আরাম করে দু'হাত ছড়িয়ে একটা হাই তুলে তুড়ি মেরে, আবার লিখতে বসলেন।
এর ঠিক এক মাসের মাথায় খবরের কাগজের প্রথমপাতার একটি খবরে গোটা আমেরিকাবাসীর চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। খবরে ছাপা হয় - বিবিধানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই নিজের ভূসম্পত্তির ষাট শতাংশ বিক্রয় করে দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলবার উদ্যোগ নিয়েছেন রকওয়েল।
সেইদিন সন্ধ্যায় মিঃ কেম্পটনের বাড়িতে বিবিধানন্দের ঘরে এসেই টেবলের ওপর খবরের কাগজটা সজোরে রাখলেন রকওয়েল। বললেন - "আপনার আমাকে একটা ধন্যবাদ জানানো উচিৎ! "
বিবিধানন্দ চুরুট থেকে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে শুধু বললেন - "বরং উল্টোটাই বেশি ভাল দেখতে লাগবে। নিজেই ভেবে দেখুন"।
অভিমন্যুর কী হয়েছিল আমরা জানি। কিন্তু, অপপ্রচার আর কুৎসা রটনার চক্রব্যুহ ভেদ করে বিবিধানন্দের এই বেরিয়ে আসার পেছনে অবশ্য রকওয়েলের অবদানকে চাইলেও অস্বীকার করতে পারেননা বিবিধানন্দ।
১০.
নিউ ইয়র্ক শহর, ১৮৯৫। বিবিধানন্দের গর্জনমুখর বক্তৃতা সবে শেষ হয়েছে। তার হৃদয়-উদ্দীপক কথা শুনে শ্রোতারা যেন মন্ত্রমুগ্ধ। বেদান্তের গভীরতা আর যুক্তির আলোকে মানুষ ততক্ষণে নতুন জীবনের পথ খুঁজছে। কিন্তু এই গভীর ভাবনার আড়ালেই, গল্পের এক নতুন চরিত্র চুপিসারে পদার্পণ করছে।
ম্যাডেলিন ব্ল্যাঙ্ক, ছিলেন একসময়কার অপেরা গায়িকা। জীবন তাঁকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছে! এখন তাঁর গলায় আর যেন সুর নেই, কেবল দীর্ঘশ্বাস। অল্প বয়সেই বাবার মৃত্যু পর তাঁর মা তাঁকে এক কাকার হাতে তুলে দিয়ে নিজেই শহরের অন্য প্রান্তে পালিয়ে যান। অপেরা জগতে কিছুদিন রোজগার করলেও অদূরদর্শিতার কারণে সঞ্চয় হয়নি। সেই জীবনের ভাঙা সেতুতে এখন শুধুই স্মৃতি।
ম্যাডেলিনের চোখে পড়েছিল বিবিধানন্দের এক বক্তৃতার পোস্টার— “বেদান্ত: জীবন বদলানোর মন্ত্র”। ভদ্রলোক নাকি মানুষকে নতুন করে বাঁচার রাস্তা দেখাচ্ছেন! এমনকি নিজের সোসাইটি খুলছেন, যার নাকি সারা দুনিয়ায় শাখা হবে। নিউ ইয়র্কে, প্রতিবাদী নারীসুরক্ষা কর্মী হিসেবে নাম অথবা বদনাম কুড়োনো ম্যাডেলিন ভাবলেন, “এই তো সুযোগ! এই সন্ন্যাসীকে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। কিছু তো ফায়দা লুটতেই হবে।”
বিবিধানন্দের বক্তৃতা শেষে, সভায় ম্যাডেলিন ঢুকলেন বেশ নাটকীয়ভাবে। মাথায় একটা মোটা কাপড়ের শাল জড়ানো, মুখে “আধ্যাত্মিক” একটা ভাব। ম্যাডেলিনের চালচলন খানিক পুরুষমানুষ সুলভ, এবং তাঁর মুখ দেখলে চট করে তাঁকে নারী বলে বোধ হয়না। সবার সামনে গিয়ে বললেন,“হে মহামান্য গুরুদেব! আপনার বাণী শুনে আমার জীবন পাল্টে গেছে। আমার এই দীন জীবনকে বেদান্তের আলোতে সাজাতে চাই। "
বিবিধানন্দ কিছুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার নাম রাখলাম মাতঙ্গানন্দ। মাতঙ্গ অর্থ মস্ত হাতি। যেন তোমার ধৈর্য আর শক্তি হাতির মতো হয়। নন্দ মানে আনন্দ। জীবন আনন্দময় হোক। এবার বলো, তুমি কী চাও?”
মাতঙ্গানন্দ নাটুকে কান্না জুড়ে দিলেন,“গুরুদেব, আমার জীবনে কেউ নেই। আমি সব হারিয়েছি। কিন্তু আপনার ছায়ায় এসে শান্তি পেয়েছি। আমাকে আপনার শিষ্যা হিসেবে গ্রহণ করুন।”
বিবিধানন্দ হেসে বললেন,“তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। তবে মনে রেখো, বেদান্তে ‘আত্মার মুক্তি’ সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।”
মাতঙ্গানন্দ ভেতরে ভেতরে ভাবছিলেন, “হ্যাঁ, আত্মার মুক্তি নয়; আমার তো দারিদ্র থেকে মুক্তি চাই!”
বিবিধানন্দ তখন নিউ ইয়র্কে নতুন করে এক সোসাইটি গড়ার পরিকল্পনা করছেন। নাম ঠিক করলেন— “বেদান্ত কংগ্রেশন”। এই সোসাইটি হবে এমন এক মঞ্চ, যেখানে পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষ এসে আত্মার মুক্তির কথা শুনবে।
সোসাইটির কাজ শুরু করার জন্য বিবিধানন্দ দিনরাত কাজ করছেন। তাঁর শিষ্যরা এই উদ্যোগে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। সবার একটাই উদ্দেশ্য, “ধর্মকে জীবনের অংশ করে তোলা, কোনো বিশেষ আচার নয়।”
কিন্তু মাতঙ্গানন্দ? তিনি মনে মনে হিসেব করছেন,
“এই বেদান্ত সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ হওয়া গেলে মন্দ হয় না। গুরুদেবের প্রচুর ভক্ত, আর তাদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই বড়সড় চাঁদা আসবে। সেই চাঁদার টাকায়...”
সোসাইটির জন্য চাঁদা তোলার পরিকল্পনা যখন করা হচ্ছে, মাতঙ্গানন্দ গুরুর কাছে গিয়ে বললেন,
“গুরুদেব, আমাকেও দায়িত্ব দিন। আমি নিজে গিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করব।”
বিবিধানন্দ অবাক হয়ে বললেন,“তোমার আগ্রহ দেখে ভালো লাগল। তবে মনে রেখো, চাঁদা নেওয়ার সময় যেন কারও মনে বিরক্তি না জন্মায়। তাতে বেদান্তের নামই খারাপ হবে, তীব্র অপপ্রচার।”
মাতঙ্গানন্দ একদম সন্ন্যাসীর বেশে, প্রথমেই গেলেন পূর্ব পরিচিত এক বড় ব্যবসায়ীর কাছে।
ব্যবসায়ী তাঁকে দেখে বললেন, “আপনারা কীসের জন্য চাঁদা নিচ্ছেন?”
মাতঙ্গানন্দ একগাল হাসি দিয়ে বললেন, “বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ”।
ব্যবসায়ী সন্দেহের দৃষ্টিতে বললেন,“ আপনি তো মিস ম্যাডেলিন ব্ল্যাঙ্ক, এর আগে মহিলাদের ভোটাধিকার নিয়ে কীসব বক্তৃতা করতেন। হঠাৎ পলিটিক্স ছেড়ে ধর্মে এত আগ্রহ? "
মাতঙ্গানন্দা গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন,“স্বামী বিবিধানন্দ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। রাজনীতি অতীত, এখন বেদান্তই আমার সব। বেদন্তের চর্চার জন্য যাঁরাই দান করবেন তাঁরা পুণ্যবান। আর তাই, যত বেশি শান্তি, তত বেশি দান। "
ব্যবসায়ী তাড়াতাড়ি পঞ্চাশ ডলার হাতে দিয়ে তাঁকে কোন মতে বিদায় করলেন।
চাঁদা সংগ্রহ করে সোসাইটির অফিস খুলেছে । কিন্তু একদিন বিবিধানন্দ শুনলেন, কিছু ভক্ত মাতঙ্গানন্দেরর আচরণ নিয়ে অভিযোগ করেছেন -“আপনার শিষ্যা তো চাঁদা তুলতে গিয়ে বলছে, ‘বেদান্তে দান করলে স্বর্গ নিশ্চিত।’ এটা তো আমাদের মূল শিক্ষার বিরোধী।”
বিবিধানন্দ মাতঙ্গানন্দকে ডেকে পাঠালেন। “মাতঙ্গানন্দ, তুমি এসব কী করছ? আমাদের শিক্ষা তো দানের বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশা নয়।”
মাতঙ্গানন্দ একটু হেসে বললেন,“গুরুদেব, আমি তো শুধু আপনার নাম প্রচার করছি। আর মানুষ তো এমনিতেই দিতে চায় না। একটু মিষ্টি কথা বললেই দিল। এতে ক্ষতি কী?”
বিবিধানন্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“তুমি বোঝো না, এটা বেদান্তের মূলতত্ত্বের সঙ্গে যায় না? দান নিঃস্বার্থ হতে হবে।”
একদিন সোসাইটির হিসেবের খাতা পরীক্ষার সময় দেখা গেল, কয়েকটি বড় দানের টাকা কোথায় গেছে তার কোনো হিসেব নেই। মাতঙ্গানন্দের দিকে সবার সন্দেহ পড়ল।
সোসাইটির অন্য এক শিষ্য বলল, “মাতঙ্গানন্দ, আপনি কি কিছু বলতে চান?”
মাতঙ্গানন্দ একগাল হেসে বললেন,“আমি কী করে জানব? এত টাকার হিসেব রাখা তো আমার কাজ নয়।”
বিবিধানন্দ বললেন,“তোমার দায়িত্ব ছিল সৎ থাকা। যদি কিছু বলার থাকে, এখনই বলো।”
মাতঙ্গানন্দ মনে মনে ভাবলেন, “ধরা পড়ে গেছি। এবার কৌশলে পালাতে হবে।”
তিনি কেঁদে বললেন,“গুরুদেব, আমার ভুল হয়েছে। আমি নিজের প্রয়োজনের জন্য কিছু টাকা নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আর কখনো এমন করব না।”
বিবিধানন্দ মাতঙ্গানন্দকে ক্ষমা করে দিলেন, কিন্তু শর্ত দিলেন,“এবার থেকে তুমি শুধু সোসাইটির সাধারণ কাজ করো। কোনো টাকা-পয়সার দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হবে না।”
কিন্তু মাতঙ্গানন্দ মনে মনে ভাবলেন, “এই সন্ন্যাসীকে এভাবে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। আমাকে আবার সুযোগ খুঁজতে হবে।”
মাতঙ্গানন্দ এরপর গুরুর আজ্ঞা শিরোধার্য মেনে সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন, এবং তাঁর পরিশ্রমে প্রসন্ন হয়ে বিবিধানন্দ মুক্তকণ্ঠে তাঁর প্রশংসাও করতে লাগলেন। সুযোগসন্ধানী মাতঙ্গানন্দের কাছে অবশ্য আবার বড় সুযোগ এসেছিল এর বেশ কিছু বছর পর।
মাদাম জুলিয়েট লুইজ ফরাসিনী, পৃথিবীর সেরা অপেরা গায়িকা - ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের চোখের তারা। আপাতত নিউ ইয়র্কে তাঁর অনুষ্ঠান চলছে। কিন্তু, লুইজের কপালে সুখ নেই। প্রবল আবেগপ্রবণ, উষ্ণমস্তিষ্ক, বাসনাময় জুলিয়েট লুইজ প্রায়ই হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে যান। বেদনাময় সমাপ্তি হয় তাঁর সব সম্পর্কের এবং শেষ সম্পর্কটিও ব্যতিক্রম নয়। নিঃসঙ্গতায় মন ভরে আছে তাঁর। তার মাঝে একমাত্র সান্ত্বনা, নিউ ইয়র্কে তাঁর সাথে এসেছেন তাঁর কন্যা, যাকে তিনি বুক ভরে আগলে রাখতে চান।
অপেরায় ফরাসি সুরকার জর্জেস বিজেটের কারমেনের গান গাইতে গাইতে তাঁর সুর সেদিন এত মধুর হয়ে উঠেছিল যা পূর্বে ঘটেনি। প্রথম অঙ্কের পর তাঁর ভূমিকা অভূতপূর্ব সারা ফেলেছিল দর্শকদের মধ্যে। দ্বিতীয় এবং অন্তিম তৃতীয় অঙ্ক শেষ করে প্রশংসা কুড়িয়ে তিনি যখন ড্রেসিং রুমে ফিরলেন - দেখলেন ম্যানেজার ও কয়েকটি লোক মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে। তাঁদের মুখে যে অভিব্যক্তি ছিল, তা স্বাভাবিক নয়। কিছু একটা গোপন, এক চরম দুঃসংবাদ যেন তাঁদের মুখে এক কঠিন বিষাদ সৃষ্টি করেছে।
"কী হল? কেন এত গোমড়া মুখ?" জুলিয়েট অসহ্য কৌতূহলে প্রশ্ন করেন। তার মন তখনো মঞ্চের ঝলকানিতে বিহ্বল ছিল, কোনো শোকের আঁচ সে বোঝেনি।
ম্যানেজার একবারে কিছু না বলে, নিঃশব্দে একটা চিঠি হাতে এগিয়ে দেন। চিঠিটি দেখে জুলিয়েটের হাত কাঁপতে থাকে। চিঠি খুলে পড়তে শুরু করেন তিনি।
"আপনার কন্যা, মিস এলিস লুইজ, একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। নিউ ইয়র্কের পোর্ট নেভি স্ট্রিটে, ফ্রাঙ্কি ড্যাভিসের বাড়িতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আপনার বন্ধু অ্যালিস এবং তাঁর বন্ধুদের প্রচেষ্টায় তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে, দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর মৃত্যু ঘটে।"
এই সংবাদ যেন হঠাৎই তাঁর বুকের ভেতর এক শক্তিশালী আঘাত হানে। জুলিয়েটের সমস্ত সুর, সমস্ত কষ্ট—সব কিছু মুহূর্তের মধ্যে যেন এক সঙ্গে সজোরে ভেঙে পড়ে। তাকে ঠেলে দেওয়া হল এক গভীর শূন্যতার দিকে, যেখানে আর কিছুই থেমে থাকে না। তাঁর কণ্ঠ, তাঁর সুর—সব কিছু যেন মুহূর্তে নিঃশব্দ হয়ে যায়।
"এটা কী... এটা কী বলা হচ্ছে?" চিৎকার করে ওঠেন জুলিয়েট, তাঁর কন্ঠে তীব্রতম শোক আর অবিশ্বাস। তাঁর চোখ জলপ্লাবিত, এবং নিজেকে সামলাতে না পেরে তিনি চেয়ারে বসে পড়েন। তাঁর চারপাশে নীরবতা। ম্যানেজার এবং কর্মচারীরা সবাই তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন, কিন্তু কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না। তাঁদের সামনে বসে থাকা গর্বিত অপেরা গায়িকার চোখে কেবলই শূন্যতার ছাপ।
এখন আর কোনও সুর নেই। পৃথিবী যেন এক দুঃখের অন্ধকারে ডুবে গেছে। যে কন্যাকে তিনি জীবনের বাকি সময় ধরে বুকের মধ্যে আগলে রাখার স্বপ্ন দেখতেন, সে আজ চলে গেছে।
অর্কেস্ট্রাতে আপাতত শো বন্ধ। জুলিয়েটের মনের মধ্যে এক ভাবনা উদিত হয়—এখন তার জীবন কী হবে? এই পরিণতি, এই একাকীত্ব, এই শোক, সব কিছুই তার সঙ্গী হতে থাকবে। সে কি এই সমস্ত কিছু সহ্য করতে পারবে? এমন একটা সময়ে নিজের জীবন নিয়ে তাঁকে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যে সিদ্ধান্তটি তাঁর অতীতের সমস্ত কষ্টের প্রমাণ হতে পারে। অর্থাৎ, আত্মহনন।
"অর্থহীন! সমস্ত কিছুই তো অর্থহীন হয়ে গেল!" চিৎকার করে ওঠে জুলিয়েট, মাথায় হাত দিয়ে। তার মনে তখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা। মৃত্যুর পর, শোকের পর, জীবনের পরবর্তী অধ্যায় কী হবে?
কিছুক্ষণ পর, তাঁর বান্ধবী লুসি প্রবেশ করেন। লুসি স্নিগ্ধভাবে এসে তাঁর পাশে বসেন, কিন্তু তিনিও বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে এই সঙ্গীতজ্ঞ মহিলাকে শোকের গহ্বর থেকে বের করা সম্ভব। লুসি জানতেন, এই মুহূর্তে কিছু বলার চেষ্টা করলেই তা শুধুই বেশি পীড়া দেবে। কিন্তু তারপরও, একটিবার ভাবনা চিন্তা করে তিনি বললেন, "জ্যুলিয়েট, তুমি জানো, তুমি সবসময় শক্তিশালী ছিলে। একদিন, এই শোকের ছায়া তুমি কাটিয়ে উঠতে পারবে।"
জুলিয়েট ধীরে ধীরে মাথা তুললেন। "কিন্তু আমি কি আর পারব?" তিনি তাঁর চোখে কান্না চাপতে না পেরে বললেন, "আমি কি পারব? আমার একমাত্র সঙ্গী, একমাত্র ভালোবাসা, সে তো চলে গেছে!"
লুসি আরও কিছু বলার চেষ্টা করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তখনই ম্যানেজার আবার এসে বললেন, "জ্যুলিয়েট, আপনার একান্তে প্রার্থনা, বিশেষভাবে একটি আধ্যাত্মিক পথের সন্ধান করা দরকার। আমি জানি এমন একজন মানুষ আছেন, যিনি আপনার এই কষ্ট বুঝতে পারবেন। তাঁর নাম বিবিধানন্দ।"
"বিবিধানন্দ?" জুলিয়েট অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, "এটা তো ভারতীয় নাম, আর এসব তো আমি কখনো শুনিনি!"
"তবে, বিশ্বাস করুন, উনি আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন," ম্যানেজার বললেন, "তিনি এক ধরণের আধ্যাত্মিক গুরু, যিনি আপনার অন্তরের বেদনা অনুভব করতে পারবেন।"
জুলিয়েট ভাবলেন কিছু সময়। এরপর, তাঁর মুখে আসা এক অদ্ভুত জোরের সঙ্গে শুধু বললেন, "ঠিক আছে, আমি তাঁর কাছে যাব।"
বিবিধানন্দ জুলিয়েটের আস্তানার অদূরেই এক অনুরাগীর বাড়ি প্রাইভেট যোগশিক্ষার ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন। সেখানে যাবেন বলেই আজ বেরিয়েছেন জুলিয়েট।
জুলিয়েটকে দরজা খুলে দিল তাঁরই বান্ধবী এবং স্বামীজীর বিশিষ্ট অনুরাগীটির বাড়ির বাটলার। প্রবেশ করে জুলিয়েট একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। ঘরের দেওয়ালে ভারতীয় মূর্তি আর থাঙ্কা পেইন্টিং, ঠিক তার পাশেই বসানো ছিল সবচেয়ে আধুনিক ফ্রেঞ্চ ঝাড়বাতি। তারপরে ঠিক পাশের ঘর থেকে ডাক এল - "এখানে এস মাই চাইল্ড, ভয় নেই!"
ঘরের মাঝখানে স্বামী বিবিধানন্দ যোগাসনের ভঙ্গিতে বসে আছেন। পরনে গেরুয়া চাদর, মাথায় ঘন চুল, চোখে এক ধরনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। চারপাশে কয়েকজন ভক্ত নীরবে বসে তার কথা শুনছে। আর এই ভক্তদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে দেখে জুলিয়েটের সন্দেহ হলো, এরা সত্যিই যোগ অভ্যাস করতে এসেছে, নাকি স্বামীজীর চেহারা দেখতে। অবশ্য তাঁরা আর দেখবেন কী? তাঁদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, এই নীরবতার পিছনে গভীর কিছু নয়, বরং স্রেফ ঘুম আসার প্রস্তুতি চলছে।
বিবিধানন্দ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জুলিয়েটের দিকে।
“আপনি কি জানেন, আপনি এই মুহূর্তে ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে সুন্দর সঙ্গীত তৈরি করতে পারেন?” বিবিধানন্দ বললেন।
জুলিয়েট কিছুটা চমকে বললেন, “আমি জানি না। আমি শোকগ্রস্ত, আর আমার গলায় সুর নেই।”
“শোক সুরের শক্তিকে দ্বিগুণ করে তোলে,” বিবিধানন্দ বললেন। “কিন্তু আপনার মন সুরকে আটকাচ্ছে। সুরকে মুক্ত করতে হবে। এজন্যই আপনি এখানে এসেছেন। আসুন, আমরা আজ একটি বিশেষ প্রক্রিয়া করব।”
জুলিয়েট ইতস্তত করল। “কিন্তু কী করতে হবে?”
“সহজ,” বিবিধানন্দ হাসলেন। “এখানে বসুন। প্রথমে কিছু শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের চর্চা করব। এরপর আমরা করব ‘আত্মমুক্তি হাস্য যোগ’।”
“হাস্য যোগ?” জুলিয়েট অবাক হলেন। “এটা আবার কী?”
“আপনার কি মনে হয়, হাসি শুধুই বিনোদন?” বিবিধানন্দ তার স্বভাবসিদ্ধ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন। “না, মাদাম! হাসি হলো সৃষ্টির এক মোক্ষম অস্ত্র। আপনি যদি প্রাণ খুলে হাসতে পারেন, আপনার শোক এক মুহূর্তে হারিয়ে যাবে। তবে এর আগে আপনাকে প্রস্তুত হতে হবে। সবাই একসঙ্গে বলুন—‘হা হা হা’!”
ভক্তদের মধ্যে থেকে একজন, যিনি স্পষ্টতই নতুন, একটু কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, “হা হা হা।” বাকিরা সঙ্গে সঙ্গেই তাকে অনুসরণ করল, তবে একেকজনের হাসি একেক রকম। কারও হাসি ছিল করুণ, কারও ছিল অদ্ভুত জোরে, আবার কেউ স্রেফ ‘হা’ বলে থেমে গেল।
জুলিয়েট কান্ড দেখে মৃদু হাসলেন। স্বামীজী বললেন, “এটাই তো সমস্যার মূল! আপনারা সবাই অর্ধেক হাসেন, আর অর্ধেকটা কান্না । আমরা চাই খাঁটি হাসি। ঠিক আছে, মাদাম লুইজ, এবার আপনি।”
জুলিয়েট প্রথমে কিছুটা লজ্জা পেলেন। এত বড় অপেরা গায়িকা হয়ে এই ‘হাস্য যোগ’ করার কথা তার ভাবতেই অদ্ভুত লাগল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন, যে কিছু বলতে পারলেন না। একবার হালকা শ্বাস নিয়ে শুধু বললেন, “হা হা হা।”
“আরো জোরে!” স্বামীজী বললেন। “আপনার সমস্ত শোক, কষ্ট, যন্ত্রণা—সব ভুলে গিয়ে হাসুন।”
জুলিয়েট এবার কিছুটা চেষ্টা করে বললেন, “হা হা হা হা!”
স্বামীজী তালি দিয়ে বললেন, “এটাই তো চাই। আরও! আরও হাসুন!”
জুলিয়েট এবার পুরোপুরি নিজের মধ্য থেকে হাসতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতে তাঁর চোখ দিয়ে জল বেরতে লাগল ক্রমাগত। আশেপাশের ভক্তরাও উৎসাহ পেয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দিল। পুরো ঘরটা যেন এক হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া পাগলাটে হাসির জোয়ারে ভেসে গেল।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, হাসতে হাসতে জুলিয়েট সত্যিই অনুভব করলেন, মনের ভার কিছুটা লাঘব হয়েছে। শোক যেন এক মুহূর্তের জন্য হলেও কোথাও লুকিয়ে গেছে।
হাসি থামার পর বিবিধানন্দ তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে বুঝলেন তো, শোককে পরাস্ত করতে হলে আপনাকে হাসি দিয়ে শুরু করতে হবে। আজকের ক্লাস এখানেই শেষ। কিন্তু আমি আপনার জন্য একটি বিশেষ কাজ রেখে গেলাম। আপনি যদি সত্যিই মুক্তি চান, তাহলে কাল সকালে সেন্ট্রাল পার্কে আসুন। সেখানে আমরা ‘যোগিক রোমান্স’ নিয়ে কথা বলব।”
“যোগিক রোমান্স?” জুলিয়েট এবার সত্যিই বিস্মিত হলেন।
“হ্যাঁ। আপনি জানেন না, প্রকৃত রোমান্স কীভাবে আপনার আত্মাকে শক্তিশালী করে তোলে ! তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে,” বিবিধানন্দ বললেন, এক রহস্যময় হাসি দিয়ে।
জুলিয়েট বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে লাগলেন, “এই যোগগুরু কি সত্যিই আমার মুক্তির পথ দেখাবেন, নাকি আরও বেশি রহস্যের দিকে ঠেলে দেবেন?”
অবশ্য জুলিয়েট জানেন আজকের হাসির অভিজ্ঞতা তাঁকে নতুন এক উপলব্ধির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
১২.
সকালের সেন্ট্রাল পার্ক। শীতল হাওয়ার মধ্যে স্বামী বিবিধানন্দ তার চিরচেনা ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে বসে। চারপাশে ছোটখাটো ভক্তদের ভিড়। কিন্তু আজকের সকালটা অন্যরকম। লন্ডন থেকে পাওয়া আমন্ত্রণপত্র স্বামীজীর সামনে রাখা। চিঠির প্রথম লাইনেই বড় বড় হরফে লেখা, "দ্রুত লন্ডনে আসুন। আপনার উপস্থিতি আমাদের সভার জন্য অপরিহার্য।"
“অপরিহার্য শব্দটা একটু অতিরিক্ত হয়ে গেছে,” বিবিধানন্দ মৃদু হেসে মনে মনে বললেন।
এদিকে, জুলিয়েট লুইজ সকাল থেকেই অস্থির। এমনিতেই তিনি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় একটু বেশি চঞ্চল, কিন্তু আজ যেন তার সবটাই অগোছালো। বিবিধানন্দের অদ্ভুত সারল্য এবং গভীরতাকে উপেক্ষা করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।
“মাদাম লুইজ, আজকের আলোচনা হবে প্রেম আর মুক্তি নিয়ে। আপনি কি প্রস্তুত?” বিবিধানন্দ বললেন।
জুলিয়েট একটু ইতস্তত করে বললেন, “প্রস্তুত, তবে প্রেমের ব্যাপারে আমার ধারণা খুব... অগোছালো।”
“প্রেম সবসময় অগোছালো,” স্বামীজী বললেন। “যদি তা না হয়, তবে সেটা প্রেম নয়। কিন্তু সত্যিকারের প্রেম হলো আত্মার মুক্তি। তবে আপনি কি জানেন, প্রেমের গভীরে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমে নিজেকে চিনতে হয়?”
জুলিয়েট তাঁর গভীর কণ্ঠে বললেন, “আমি কি নিজেকে চিনি না?”
বিবিধানন্দ এক মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “আপনার গলার সুর চেনেন আপনি। কিন্তু আপনার আত্মার সুর? সেটা কি চেনেন?”
সেদিন দুপুরেই স্বামীজী তার একান্ত অনুরাগী মাতঙ্গানন্দকে ডেকে পাঠালেন। মাতঙ্গানন্দ, যাঁর পরিবর্তিত মৃদু স্বভাব এবং নির্ভুল আনুগত্যের জন্য স্বামীজীর বিশেষ পছন্দের, স্বামীজী আমেরিকার কার্যক্রমের দায়িত্বভার তাঁকে দিলেন।
“মাতঙ্গানন্দ, আমি যখন লন্ডনে থাকব, তখন এই জায়গাটা তোমাকে দেখতে হবে। এখানে অনেক কাজ বাকি। আমাদের অনুশীলনের কেন্দ্র বড় করতে হবে। জুলিয়েট লুইজ এবং তার মতো অনেক মানুষের সাহায্য দরকার। তবে, সাবধান, কোনো বিতর্কে জড়াবে না,” স্বামীজী বললেন।
“স্বামীজী, এই দায়িত্ব... মানে... এত বড় দায়িত্ব... আমি পারব তো?” মাতঙ্গানন্দ অভিনয়ে সিদ্ধহস্ত। কারণ, মনে মনে তিনি জানেন, স্বামীজী ফিরবেন শীঘ্রই এবং তাঁকে স্বামীজীর সঙ্গেই ভারতে পৌঁছাতে হবে।
“তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। ” বিবিধানন্দ তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন।
সন্ধ্যায় জুলিয়েট তাঁর ড্রেসিং রুমে বসে ছিলেন। কারমেনের একটি বিশেষ দৃশ্যের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন বারবার বিবিধানন্দের দিকে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই, সে সিদ্ধান্ত নিল, তার মনের কথা বলবে।
অপেরা ভাঙার পর রাত ১০টায় সে বিবিধানন্দের আস্তানায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করল।
“স্বামীজী, আমি কিছু বলতে চাই,” জুলিয়েট বললেন, তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
“বলুন, মাদাম। আমি শুনছি,” স্বামীজী বললেন, তাঁর চোখে কৌতূহল।
“আমি জানি না এটা কী, কিন্তু আমি আপনার প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করি। এটা কি প্রেম? নাকি শুধুই আপনার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতি আমার আকর্ষণ?”
স্বামীজী গভীরভাবে শ্বাস নিলেন। তিনি বললেন, “আপনার অনুভূতিকে অস্বীকার করব না। কিন্তু মাদাম, আমার পথ ভিন্ন। আমি সংসারের বন্ধনে নিজেকে আটকে রাখিনি। আমার প্রেম হলো সার্বজনীন, যা শুধু এক ব্যক্তির জন্য নিবেদিত হতে পারেনা। তবে আপনার এই ভালোবাসা যদি সত্য হয়, তবে তা একদিন মুক্তির পথ দেখাবে। এই অনুভূতিকে ভয় পাবেন না। এটা আপনাকে আত্মার শক্তি দেবে।”
জুলিয়েট কিছু বলবার সাহস পেলেন না। তাঁর চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
রাতের অন্ধকারে, লন্ডনে যাত্রার প্রস্তুতির সময়, বিবিধানন্দ একটা চুরুট ধরিয়ে তাঁর ছোট্ট ঘরে একা বসে ভাবছিলেন। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই প্রথম আমেরিকায় আসার দিনগুলো। ধৰ্ম মহাসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তৃতার শুরু, আর শূন্য আসনগুলো কেমন ধীরে ধীরে ভরে উঠছিল। তাঁর কণ্ঠে উঠে এসেছিল তাঁর প্রিয় ভারতের কথা। কীভাবে তিনি একটা অচেনা দেশের মানুষের মন জয় করলেন, কীভাবে সবার হৃদয়ে ভারতকে জায়গা করে দিলেন....
সকালে, নিউ ইয়র্ক বন্দরে ভক্তরা জমায়েত হয়েছিল। মাতঙ্গানন্দ পেছনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কান্না চাপবার নিখুঁত অভিনয় করছিলেন। জুলিয়েটের চোখ খানিক লাল, কিন্তু তাঁর চোয়ালে দৃঢ়তা।
"আবার দেখা হবে তো স্বামীজী?” জুলিয়েট বললেন, তাঁর গলা কাঁপছিল।
“আমাকে যখনই মনে পড়বে, আমি ঠিক আপনার কাছে পৌঁছে যাব ” বিবিধানন্দ বললেন।
জাহাজ বন্দর ছাড়লো। বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ছোট হয়ে আসছিল। বিবিধানন্দ ডেক থেকে আকাশের দিকে তাকালেন। তাঁর মন আজ ভাল নেই। খুব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা, মায়ের কথা...তাঁর পায়ে হাঁটা শহর কলকাতার কথা।
—
পরিশিষ্ট
নিউ ইয়র্ক থেকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার বিশাল সাগরযাত্রী জাহাজ দ্য সেরাফিনায় হাঁটাহাঁটি শুরু হয়ে গেছে যাত্রীদের। প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের মধ্যে দু’জন সবার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন —একজন ছিলেন লম্বা, সোজা কাঁধের মহিলা, তাঁর চেহারা ছিল তীক্ষ্ণ, গাঢ় বাদামী চুলে আটকে যাচ্ছিল আলো। যে গাউন তিনি পরেছিলেন তা যেন এক রাজকীয় পতাকা হয়ে উঠতে পারত। অন্যজন ছিলেন এক রহস্যময় পুরুষ, তাঁর গভীর চোখে অনেক কিছুই চাপা পড়েছিল, মাঝে মাঝে মনে হতো তিনি হয়তো পুরো পৃথিবীটাকেই এক চোখে মেপে দেখছেন, কিংবা সহযাত্রীদের অসহ্য হাস্যকর আচরণের দিকে চোখ সঁপে দিয়েছেন।
দ্বিতীয় ব্যক্তিটি যে বিবিধানন্দ, তা আন্দাজ করবার জন্য পাঠকদের কোন উপহার প্রাপ্য নয়। প্রথম ব্যক্তিটির নাম - লেডি অ্যানাবেল ব্রাসিংটন। দুজনেরই সদ্য পরিচয় হয়েছে, কিন্তু দুজনের সামনাসামনি বসে আলোচনার মগ্নতা দেখে মনে হয় যেন কতকালের আলাপি।
বিবিধানন্দ মৃদু হেসে বললেন, “দেখুন, আমি জানি আপনি বেদান্ত নিয়ে অনেক কিছু জানেন, কিন্তু আসল বেদান্ত তো আরেকটা। থিওজ্যোফি নিয়ে আপনার ধারণা… একদম ভুল নয়। তবে প্যানথিওন নিয়ে একটু ভেবে দেখতে হবে।”
লেডি আনাবেল ব্রাসিংটন চোখ বুজে শুনে বললেন, “ও! আপনি তো ‘অরিজিনাল’ বেদান্তের পক্ষে, আমি তো থিওজ্যোফির গোলকধাঁধায় একটু বেশি আটকে পড়েছি। তবে, আপনি বলুন, বেদান্তের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? যদি জানতে পারি —তাহলে হয়তো— আমার চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে পারব।”
এমন সময়ে হঠাৎই জাহাজের পেছন দিক থেকে প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে এল। একজন যাত্রী ছুটতে ছুটতে এসে জানালেন, এক সহযাত্রী অস্বাভাবিক আচরণ করে প্রায় গোটা জাহাজ শুদ্ধ লোককে অস্থির করে তুলেছেন। অদ্ভুত কিছু কাজ করছেন তিনি, যেন অন্য জগতের লোক!
বিবিধানন্দ আর অ্যানাবেল দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালেন। “এটা কী হতে পারে?” আনাবেল উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন।
বিবিধানন্দ দাঁড়িয়ে, চোখে একটু রহস্যময় হাসি নিয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে, ‘অরিজিনাল’ বেদান্তের পথের থেকেও বড় কোন রহস্য আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে।”
***