বালিয়া ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ। ছবি - উইকিপিডিয়া
ভূমিকা
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতির নিদর্শন হলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্নতত্ত্ব একটি নির্দৃষ্ট সময় ও ভূ-খণ্ডে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানুষের জীবন যাত্রার সাথে জড়িত সব ধরণের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে ইতিহাস রচনার সূত্রাদি সরবরাহ করে। হিমালয়ের পাদদেশে বরেন্দ্র অঞ্চলের উত্তরে অবস্থিত অধুনা বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলা। ভূ-অবস্থানগত বিবেচনায় বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত জেলা হলেও বঙ্গ বিজেতা মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির (১২০৪-১২০৬ খ্রি:) দ্বিতীয় রাজধানী দেবকোটের অতি সন্নিকটের একটি জনবহুল ও সমৃদ্ধ জনপদ ছিল এই অঞ্চল। ঠাকুরগাঁও জেলার সমতল ভূমি, নদী, নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এ অঞ্চলের জনপদ সৃষ্টিতে এবং সমৃদ্ধিতে সমান উপযোগী। তাই এ জেলায় পাওয়া যায় যুগে যুগে গড়ে ওঠা মানুষের বসতির ইতিহাস আর প্রাচীন কীর্তিসমূহ। ঠাকুরগাঁও জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো বালিয়া ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ। মসজিদটি নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলেও এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোন গবেষণা করা হয়নি। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া-র রচিত ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ গ্রন্থে ঠাকুরগাঁও জেলার কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন - বাংলাগড়; নেকমরদ ও গড়গ্রাম; গোরকুই কূপ, মন্দির ও শিলালিপি; জগদল ও ধর্মগড়; রাণীশংকৈল গড়; মাল দুয়ার; গোবিন্দনগর দূর্গ ও মন্দির; রামদাঁড়া; কোরমখান গড়; কোয়েলি বাজার গড়; মহলবাড়ি মসজিদ ও অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ; গড় ভবানীপুর খোদ ও ভাতুরিয়া ইত্যাদি নিদর্শন সম্পর্কে উল্লেখ করা হলেও বালিয়া ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ নিয়ে কিছু লিপিবদ্ধ করা হয়নি। বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাপিডিয়া’ বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ (৫ম খণ্ড) গ্রন্থটিতে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গোবিন্দনগর মন্দির, জামালপুর জামে মসজিদ, কোরমখান গড়, বৃষমূর্তি, দেবীপুরের খুররমখাঁ পুকুর, গোবিন্দ জিউ মন্দির প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচীন নিদর্শনাদির কথা উল্লেখ থাকলেও বালিয়া ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ সম্পর্কে কোন তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
ঠাকুরগাঁও ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘ঠাকুরগাঁও পরিক্রমাঃ ইতিহাস ও ঐহিত্য’ গ্রন্থটিতে ঠাকুরগাঁও জেলার ২৬টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কথা লিপিবদ্ধ করা হলেও বালিয়া ঐহিত্যবাহী মসজিদ নিয়ে কোন তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। মো: সোহেল রানা কর্তৃক রচিত ‘ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থটিতে ঠাকুরগাঁও জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অধ্যায়টিতে ‘বালিয়া মসজিদ’ নামে সংক্ষেপে লেখা রয়েছে। যা বালিয়া ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার জন্য পর্যাপ্ত না। শাহানা ফেরদৌস কর্তৃক রচিত ‘বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্য’ গ্রন্থটিতে দিনাজপুর জেলার সূরা মসজিদ এবং পঞ্চগড় জেলার মির্জাপুর শাহী মসজিদের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হলেও ঠাকুরগাঁও জেলার কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে কোন তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়নি। বালিয়া ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদটি বালিয়ার চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ও বাহক। এই মসজিদটি বালিয়ার চৌধুরী পরিবারের পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও জেলার গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষর বহন করছে। ফলে এ মসজিদটি নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনুসৃত হয়েছে।
অবস্থান
ঠাকুরগাঁও জেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বালিয়া গ্রামে বালিয়া মসজিদটি অবস্থিত। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে বোদা পঞ্চগড় যাওয়ার পথে ভুল্লী বাজার অবস্থিত। ভুল্লী বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে বালিয়া গ্রামের শাঠবন্দি এলাকায় মসজিদটি অবস্থিত। অপর দিকে ভুল্লী বাজার থেকে গড়েয়া হাট যাওয়ার পথে তুরুকপথা নামক বাজার থেকেও ৩ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বালিয়া মসজিদটি।
প্রচলিত রূপকথা
বালিয়া মসজিদটি স্থানীয় জনগণের কাছে ‘জ্বীনের মসজিদ’ নামেই অধিক পরিচিতি। এ মসজিদের নির্মাণ ইতিহাস নিয়ে অনেক প্রচলিত ইতিহাস ও উপকথা রয়েছে। অনেকের মতে, কোন এক অমাবশ্যার রাতে জ্বীন-পরীরা বালিয়া গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় গ্রামটি তাদের পছন্দ হয়। তারপর জ্বীন পরীরা মাটিতে নেমে আসে এবং মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করে। মসজিদটি নাকি তৈরী করা হয়েছিল এক রাতেই। জ্বীন-পরীরা সারারাত জেগে এ মসজিদটি নির্মাণ করেছে। অনেক রকমের কারুকার্যময় অলংকার ও পুরু দেওয়াল তৈরি করতে করতে ভোর হয়ে যায়। ফলে মসজিদের গম্বুজ তৈরির কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে যায় জ্বীন-পরীরা। জ্বীন-পরীরা মসজিদের কিছু অংশ তৈরি করেছে বলে মসজিদটি স্থানীয়দের কাছে ‘জ্বীনের মসজিদ’ নামে পরিচিত। বর্তমানের বালিয়া মসজিদটি ২০০৫ সালের পূর্বে জঙ্গলে ঢাকা ছিল। কারো কারো মতে, পূর্বে এই মসজিদের পুকুরঘাটে বাঘ নাকি পানি খেত। পানি খেয়েই পাশের জঙ্গলে কোন এক বিশাল গর্তে ঢুকে যেত। সঙ্গে কয়েকটা বাঘের বাচ্চাও ছিল। বাঘের সাথে আবার অনেক খরগোশও বাস করত। চৌধুরী পরিবারের সদস্য আহমেদ কবীর তার মামা আইনুদ্দীন আহম্মেদের (৮৬) (অব. সহকারি শিক্ষক বোদা সরকারি পাইলট মডেল স্কুল) কাছে শুনেছিলেন, মসজিদ তৈরি শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রধান স্থপতি মৃত্যুবরণ করেন এবং আর কিছুদিন পর মসজিদের কাজ অসমাপ্ত রেখেই মেহের বকস চৌধুরী মারা যান। এরপর এলাকায় গুজব ছড়ায় মসজিদটি আল্লাহর কাছে কবুল হয়নি, তাই মসজিদ তৈরিতে এতো বাঁধা। ফলে মসজিদটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল বাকির সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানা যায়, মসজিদটির বয়স ১০৮-১১০ বছরের মতো হবে। ২০০৫ সালের পূর্বে মসজিদটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং জায়গাটি উঁচু পিরামিড আকৃতির ছিল। এই মসজিদের পাশেই একটি ছোট ঘর তৈরি করে স্থানীয় মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতেন। ২০০৫ সালে মসজিদটি সংস্কারের কাজ শুরু করা হয় এবং ২০১০ সালে এটি চালু করা হয়। মেহের বকস চৌধুরী তৈরি করেছেন বলে স্থানীয়ভাবে এটি চৌধুরী মসজিদ নামেও পরিচিত। এছাড়াও মসজিদটি ছোট বালিয়া মসজিদ নামে পরিচিত। ২০১০ সালে মসজিদটি সংস্কারের পর উদ্বোধনের সময় এলাকার জনগণের সর্বসম্মতিক্রমে মসজিদটির নামকরণ করা হয় বালিয়া ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ। তখন থেকে মসজিদটি এ নামেই পরিচিত হয়ে আসছে।
মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস
বালিয়া মসজিদটি নির্মাণের সাল নিয়ে মতবিরোধ আছে। মসজিদের সামনে নির্মিত স্মৃতিফলকের গায়ে খোদাই করা আছে মসজিদটি নির্মাণ করা হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯১০ সালে। আবার মসজিদের নির্মাতা মেহের বকস চৌধুরীর কবরে তার মৃত্যু সাল উল্লেখ করা আছে ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। তবে স্থানীয় মানুষ ও মেহের বকস চৌধুরীর আত্বীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বালিয়া মসজিদের নির্মাণ কাজটি শুরু হয় এবং মেহের বকসের মৃত্যুর সময় অর্থাৎ ১৯১০ সালে মসজিদটির বেশির ভাগ কাজই শেষ হয়ে যায়।
স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, মেহের বকস সরকারের পিতা ছিলেন রাজ-এ-মোহাম্মদ, তাদের আদি নিবাস ছিল ভারতের বিহার বাজ্যে। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর তাদের পরিবার বিহার থেকে জলপাইগুড়ি চলে আসেন। পরবর্তিতে মেহের বকসের বাবা রাজা-এ-মোহাম্মদ ব্যবসা করার জন্য তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুরের অন্যতম মহকুমা (বর্তমান জেলা) ঠাকুরগাঁওয়ে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। রাজ-এ-মোহাম্মদ খুব দ্রুতই ব্যবসার সমৃদ্ধি অর্জন করেন। স্থানীয় জমিদারের সাথে সুসম্পর্কের ফলে রাজ-এ-মোহাম্মদের ছেলে মেহের বকসের সাথে তৎকালীন জমিদার কন্যা বিবি গুলমতি নেছার বিবাহ হয়। পরবর্তিতে গুলমতি নেছা বাবার মৃত্যুর পর জমিদারির উত্তরাধিকারী হন। যদিও জমিদারি গুলমতি নেছার নামেই ছিল, কিন্তু কার্যত শাসন করতেন মেহের বকস। গুলমতি নেছা ব্রিটিশদের কাছে সময় মতো জমিদারি কর পৌঁছানোর জন্য চৌধুরাণী উপাধি লাভ করেন। মেহের বকস সরকারও সে সূত্রে চৌধুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ১৮৬০ সালের দিকে জমিদার মেহের বকস চৌধুরী বালিয়া গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তার আগ্রহেই তার স্ত্রী গুলমতি চৌধুরানী মসজিদ নির্মাণে এগিয়ে আসেন। মুঘল স্থাপত্য রীতি অনুযায়ী ডিজাইনকৃত এই মসজিদটি নির্মাণের জন্য দিল্লীর আগ্রা মতান্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি আনা হয়। মুঘল স্থাপত্যশৈলীর জটিল নকশার মসজিদটি নির্মাণ যেমন ছিল ব্যয়বহুল, তেমনি সময় সাপেক্ষ। হঠাৎ মসজিদ নির্মাণের প্রধান স্থপতির মৃত্যুর ফলে মসজিদ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। মেহের বকস চৌধুরী স্থানীয় কারিগরদের সহায়তায় মসজিদটির কাজ পুনরায় শুরু করলেও স্থানীয় কারিগররা মসজিদের গম্বুজ তৈরি করতে ব্যর্থ হন। ১৯১০ সালে মেহের বকস চৌধুরী মারা গেলে পুনরায় মসজিদ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। মেহের বকসের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর তার ছোট ছেলে মাসির উদ্দীন চৌধুরী মসজিদটি নির্মাণের জন্য পুনরায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু তিনিও মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই মারা যান। ফলে মসজিদটি দীর্ঘ প্রায় ১০০ বছর গম্বুজ ছাড়াই অব্যবহৃত অবস্থায় থাকে এবং মসজিদের চারপাশে জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ফলে মসজিদটি লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যায়। ২০০৫ সালে মেহের বকস চৌধুরীর ছেলে বসরত আলী চৌধুরীর কন্যা বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি তাসরিফা খাতুনের পৃষ্টপোষকতায় এবং প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট এর কারিগরি সহযোগীতায় গম্বুজের নকশা করেন আর্কিটেক সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল এবং মসজিদটি সংস্কার কাজের তত্ত্ববধায়ন করেন শিল্পী কামরুজ্জামান স্বাধীন ও জাকিরুল হক চৌধুরী শাহেদ। মসজিদটি সংস্কারের সময় প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ফিরোজ এম হাসান। ২০১০ সালে মসজিদটি সংস্কার কাজ সমাপ্ত হয় এবং জনসাধারণের নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
মসজিদের বর্ণনা
বালিয়া মসজিদের নির্মাণ শৈলীর সাথে মুঘল আমলের স্থাপনার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের নির্মাণ শৈলী মনোমুগ্ধকর। মসজিদটিতে কোন পিলার নেই। মসজিদটি সমতল ভূমি হতে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের উপর অবস্থিত। মসজিদটি পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি ও উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আয়তাকার কমপ্লেক্সে অবস্থিত। মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত। প্লাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। মসজিদের প্রধান ফটকের দৈর্ঘ্য ২১ ফুট প্রস্থ ৯ ফুট। বিশাল আকৃতির কারুকার্য মণ্ডিত সদর দরজাটিই মসজিদের অন্যতম আকর্ষণ।
মসজিদটির ছাদে একই সাইজের তিনটি গম্বুজ ও আটটি মিনার আছে। ছাদের চারকোণে অবিস্থত চারটি মিনারের আকৃতি বড় বড়, বাকি চারটি মিনার আকৃতিতে ছোট। মসজিদটির ভিত্তি সহ পুরো মসজিদটিই হাতে পোড়ানো ইট, চুন-সুরকির মর্টার দিয়ে তৈরি। মসজিদের ইটে কোন কাজ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন অংশে ইট কেটে ফুল, কলস, ডিশ, ঘণ্টা, বাটি, আমলকি, পদ্মা ইত্যাদি নকশা তৈরী করা হয়েছে। আয়তাকার কমপ্লেক্স সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলাচত্ত্বর ও মূলভবন বা নামাজঘর এ তিনটি অংশে বিভক্ত। মসজিদের ভেতরে প্রবেশ দ্বার তিনটি। প্রতিটি দরজার উপর খোদাই করে লেখা আছে ‘হিজরি ১৩২৭ সাল’। মসজিদের পশ্চিম পাশে ছোট একটি জানালা এবং উত্তর-দক্ষিণে একটি করে জানালা আছে। মসজিদের ভেতরে তিনটি কাতারে প্রায় ৩০০ জন একসাথে নামাজ পড়া যায়।
উপসংহার
ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রত্নতত্ত্ব। যে কোন প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সমসাময়িক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনের মাধ্যমে জানা যায় উক্ত এলাকার মানুষের জীবন যাপনের যাত্রা, আচার-ব্যবহার, পেশা, সংস্কৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত বর্তমান ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন অপেক্ষাকৃত কম। তবে তারই মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো বালিয়া ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ। মেহের বকস চৌধুরীর শাসনামলে বালিয়ার যে জৌলুসতা ছিল তা কালের বিবর্তনে অনেকটা হারিয়ে গেছে। বালিয়ার চৌধুরী পরিবারের এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি তাদের পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করে। এই মসজিদটি প্রত্নতাত্তিক অধিদপ্তরের অধিভূক্ত হলে এটি সুন্দরভাবে সংরক্ষণের পাশাপাশি এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব জাতির সামনে উন্মোচিত হবে বলে আশা রাখা যায়।
তথ্য সহায়িকা
১. বেলাল রব্বানী, আমাদের প্রত্ননিদর্শন, ঠাকুরগাঁও পরিক্রমাঃ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ঠাকুরগাঁওঃ ঠাকুরগাঁও ফাউন্ডেশন, সেপ্টেম্বর ২০০৫; পৃ. ১৩৬
২. আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ, ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭; পৃ. ৫৫
৩. সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদক), বালিয়াপিডিয়া, বাংলাদেশর জাতীয় জ্ঞানকোষ (খণ্ড ৫), বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটি, মার্চ ২০২৩; পৃ. ২৮৩
৪. ঠাকুরগাঁও ফাউন্ডেশন, ঠাকুরগাঁও পরিক্রমা; ইতিহাস ও ঐহিত্য, ঠাকুরগাঁওঃ ঠাকুরগাঁও ফাউন্ডেশন, সেপ্টেম্বের ২০০৫; পৃ. ১৩৬-১৫৫
৫. মোঃ রাসেল রানা, ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ঢাকা: অবসর প্রকাশনি, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮; পৃ. ১৬০-১৬৩
৬. শাহানা ফেরদৌস, বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্য, ঢাকা: নীতিরীতি প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (৩য় সংস্করণ); পৃ. ৯৬
৭. ঠাকুরগাঁওয়ে এক রাতেই নির্মাণ হয়েছিলো বালিয়া মসজিদ, বাংলাদেশ জার্নাল, ১ অক্টোবর ২০২৪
৮. বালিয়ার চৌধুরীদের মসজিদ, কালের কণ্ঠ, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬
৯. সাক্ষাৎকারঃ আহম্মেদ কবীর (৬৮), পেশা- অব. সহকারি অধ্যাপক, সালন্দর ডিগ্রী কলেজ ভুল্লী, ঠাকুরগাঁও, পিতা- এস আব্দুল করিম, ঠিকানা- ছোট বালিয়া, ঠাকুরগাঁও, সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ- নিজ বাসভবন, ১৫ অক্টোবর ২০২৪
১০. সাক্ষাৎকারঃ আব্দুল বাকি (৭৪), পিতা- সৈয়দ জামান আকন্দ, পেশা- কৃষি, গ্রাম- বাবুপাড়, শুখানপুকুরি, ঠাকুরগাঁও, সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ- নিজ বাসভবন, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১
১১. বালিয়া মসজিদ উইকিপিডিয়া, তথ্য সংগ্রহের তারিখ- ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
১২. মসজিদের সামনে নির্মিত স্মৃতিফলক
১৩. মেহের বকস চৌধুরীর কবরে খোদাইকৃত স্মৃতিফলক
১৪. সাক্ষাৎকারঃ জাকিরুল হক চৌধুরী (৫০), পেশা- সহকারী শিক্ষক, বোদা সরকারি পাইলট মডেল স্কুল, পিতা- মোজাম্মেল হক চৌধুরী, ঠিকানা- সরকারপাড়া, ঠাকুরগাঁও, সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ- নিজ বাসভবন, ১৫ অক্টোবর ২০২৪
১৫. বালিয়া মসজিদ, উইকিপিডিয়া, তথ্য সংগ্রহের তারিখ- ১ সেপ্টেম্বের ২০২৪
১৬. জিন মসজিদের কথা, দৈনিক ইত্তেফাক, ২ অক্টেবর ২০২০
১৭. সাক্ষাৎকারঃ নূর আলম (৫০), পেশা- সহকারী শিক্ষক, সালন্দর আলিয়া মাদ্রাসা, ঠাকুরগাঁও, ঠিকানা- সরকার পাড়া, ঠাকুরগাঁও, সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ- নিজ বাসভবন, ১ জুন ২০২৪
১৮. ঠাকুরগাঁওয়ে ঐতিহ্যবাহী বালিয়া মসজিদ, ইধহমষধ ঞৎরনঁহব, তথ্য সংগ্রহের তারিখ, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
১৯. ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী বালিয়া মসজিদ, প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০২৩
২০. ঐতিহাসিক বালিয়া মসজিদ, প্রতিদিনের সংবাদ, ১১ এপ্রিল ২০২৩
২১. Balia Mosque is one of the Distinguished archaeological Landmarks in Thakurgaon, THE ASIAN AGE, 17 October 2024