ট্রাম, স্মৃতিমেদুরতার নাম

লিখেছেন:বিজয়লক্ষ্মী মুখার্জী

 

 

কলকাতার ট্রাম (ছবি - আনন্দবাজার পত্রিকা) 

আজকের কথা

“Survival of the fittest”  থিওরির সাপেক্ষেই বোধহয় কলকাতার সড়কদৌড়ের লড়াইয়ে ট্রামের দেড়শো বছরের ঐতিহাসিক সফর চিরদিনের মত থমকে গেল গত ৩০ সেপ্টেম্বর,২০২৪ । কলকাতার ট্রাম আমাদের প্রজন্মের মনের খুব কাছের। এশীয় যাত্রী পরিষেবার প্রথম বৈদ্যুতিক যান হওয়ার গর্বের অধিকারী কলকাতার ট্রাম ।

“City of joy” কলকাতার অন্যতম joyride ছিল ট্রামে চড়া। মনে পড়ে রবি কবির "স্বপ্ন" কবিতার সেই লাইনগুলো

রাস্তা চলেছে যত অজগর সাপ
পিঠে তার ট্রাম গাড়ি পড়ে ধুপধাপ।

কী বলবো আমরা ছোটোদের, কী বোঝাবো আগামীর নাগরিকদের? ট্রাম গাড়ি বস্তুটা কী? আকাশে চড়ে না জলে ভাসে? নাকি ট্রেন যেটা একদা রাস্তা দিয়ে যেত? সাজানো গোছানো হেরিটেজ ট্রাম (ধর্মতলা থেকে ময়দান পর্যন্ত) অবশ্য থাকছে দেখার জন্য, কিন্তু আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের যে স্মৃতিমেদুরতায় আমরা ধরোহর, তা কী  আর কোনোভাবে ওদের মধ্যে সঞ্চারিত করা যাবে?

চলুন মাত্র দু’ শতাব্দী পিছিয়ে যাই। ঐতো  বালক ঈশ্বর, পিতা ঠাকুরদাসের  সাথে মেদিনীপুর থেকে পায়ে হেঁটে কলকাতা আসছেন। ঈশ্বর চন্দ্র থেকে বিদ্যাসাগর আর বিদ্যাসাগর থেকে দয়ার সাগর হয়ে ওঠার দীর্ঘ কঠিন পথটাও তিনি অতিক্রম করেছেন পায়ে হেঁটেই। যাঁদের আর্থিক সংস্থান ভালো, তাঁরা চড়তেন পালকি; বেহারাদের পায়ের ভরসায়। কোম্পানি বাহাদুরের ইংরেজ সাহেবদের যাতায়াতের সাধন ছিল ঘোড়া, ঘোড়ায় টানা গাড়ি কিংবা পালকি। কিন্তু কলকাতা শহরে  ট্রামের পথচলার শুরু ঠিক কবে থেকে? আসুন জানি শুরুর সেদিনের কিছু কথা।

 

শুরুর কথা

ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পা রেখেছে ভারতের মাটিতে। ডিহি কলিকাতা, গোবিন্দপুর, সুতানুটি সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া তিনটি গ্রাম নিয়ে পত্তন হয়েছে জব চার্নকের ক্যালকাটা, আজকের কলকাতা। ১৮৭২ সাল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক সদর শহর কলিকাতা ততদিনে ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয় উপনিবেশের রাজধানী। মূলত ঔপনিবেশিক কলকাতার নগরীকরণ এবং শহরের পরিবহন পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য নেওয়া ব্রিটিশ উদ্যোগের অন্যতম ছিল ট্রাম পরিষেবা ।

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৩  প্রথম বার কলকাতার আর্মেনিয়ান স্ট্রিট থেকে ৩.৯ কিমি দূরে শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত চালানো হয়েছিল ঘোড়ায় টানা যাত্রীবাহী ট্রাম। যদিও  যাত্রীর অভাবে সেই বছরই ২০শে নভেম্বরে বন্ধও হয়ে যায় এই পরিষেবাটি। ২২ শে ডিসেম্বর,১৮৮০ সালে লন্ডনে স্থাপিত হয় ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কম্পানি, যাদের তত্বাবধানে কলকাতার পথে ঘোড়ায় টানা ট্রাম আবার চালু হয়। সেই সময় ট্রাম কোম্পানির কাছে ছিল ১৭৭টি ট্রামের কামরা আর ১০০০ ঘোড়া। কিন্তু ঘোড়ায় টানা ট্রাম যতই দর্শনীয় হোক না কেন, যে কোনো প্রাণীর শরীরী ক্ষমতার একটা সীমা থাকে। সর্বোপরি মেজাজ বিগড়োলে ঘোড়ারা ট্রাম সমেত রাজপথে দাঁড়িয়ে পড়ত, তখন আবার নতুন ঘোড়া আনিয়ে ট্রাম চালানো ছাড়া গত্যন্তর থাকত না। তাছাড়া রাজপথ থেকে ঘোড়ার পুরীষ পরিষ্কার করা, ঘোড়াদের রক্ষণাবেক্ষণ ট্রাম কর্তৃপক্ষর কাছে একটা গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর লর্ড রিপন ১৮৮৫ সালে কলকাতায় ট্রামে স্টীম ইঞ্জিন ব্যবহার চালু করেন, সেই সময়ে প্রায় ১৯ মাইল ট্রাম লাইন পাতা হয়েছিল। এতে ঘোড়া সমস্যার সমাধান ঘটলেও কলকাতার আকাশে ধোঁয়া দূষণের সমস্যা শুরু হয়। ১৯০০ সালে কলকাতার পথে স্ট্যান্ডার্ড মিটার গেজ ট্রাম লাইন পাতা হয়। ইতিমধ্যে ১৯৮৫ সালে মাদ্রাজে (চেন্নাই) ট্রামের বিদ্যুতায়ন ঘটেছিল। ১৯০২ সালে কলকাতায় প্রথমবার বিদ্যুৎচালিত ট্রাম পথে নামে। স্বাধীনতার পরেও লন্ডনস্থ কম্পানিটির কাছেই ছিল কলকাতার ট্রামের মালিকানা। ট্রামের সামনের কামরাটি ছিল প্রথম শ্রেণীর (গদিওয়ালা বেঞ্চ) এবং পিছনের কাঠের বেঞ্চযুক্ত কামরাটি দ্বিতীয় শ্রেণীর। ১৫ই আগস্ট, ২০১৩ থেকে এই শ্রেণী বৈষম্য তুলে দেওয়া হয়।

কলকাতা শহরে ট্রাম কোম্পানির সাতটি ডিপো ছিল, আর গঙ্গার ওপারে হাওড়ার শিবপুরে ছিল একটি ডিপো। আর শহর জুড়ে ছিল ন'টি টার্মিনাল। এসপ্ল্যানেড টার্মিনাল থেকে সবথেকে বেশি রুটে ট্রাম যেত। হাওড়া ব্রিজ টার্মিনাল থেকে  ১৯০৫ সালে কলকাতার টুইন সিটি হাওড়ার বাঁধাঘাট পর্যন্ত ট্রাম রুট চালু হয়।  ১৯০৮ সাল নাগাদ হাওড়ার শিবপুর পর্যন্ত  ট্রাম লাইন পাতা ও শিবপুর ট্রাম ডিপো পর্যন্ত ট্রাম পরিষেবা চালু করা হয়। প্রসঙ্গত, শিবপুর ট্রাম ডিপোয় ট্রাম ঘোরানোর জন্য যথেষ্ট জায়গা না থাকায় এই গাড়িগুলোর দু’দিকেই  ড্রাইভার কেবিন বানানো ছিল। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি  মাসে হাওড়া ব্রিজ (রবীন্দ্র সেতু) নতুনভাবে নির্মিত হলে হাওড়া ও কলকাতা ট্রাম পরিষেবার সংযুক্তিকরণ করা হয়।

গতির যুক্তিতে, ২০১২ খৃষ্টাব্দে শহরে এক কামরার ট্রাম চালু করা হয়। এগুলো ছিল দু’কামরার ট্রামের কামরাগুলোর তুলনায় দীর্ঘতর এবং দ্রুতগতি সম্পন্ন। ময়ের দাবি মেনে বিভিন্ন সময়ে ট্রামের ট্র্যাকে ও বগিতে সংস্কার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরাও  চালু করা হয়েছিল। নোনা পুকুর এবং শিয়ালদহ ওয়ার্কশপে এক কামরার ট্রামের কাজ হত। ট্রামের কামরা তৈরি  কর তৎকালীন বিখ্যাত মার্টিন বার্ণ ও জেসপ কম্পানি।

 

ভারতের অন্যান্য শহরে ট্রাম

কলকাতার পরে ভারতের অন্যান্য কিছু শহরেও যাত্রীবাহী ট্রাম পরিষেবা চালু করা হয়েছিল। ১৮৭৪ এ মুম্বই শহরে ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয়।  ১৮৯৫তে চেন্নাই, ১৮৮৯ তে নাসিকে ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়েছিল। এরপর ১৯০৪ সালে দিল্লি এবং ১৯১৪তে  কানপুর শহরেও  ট্রাম পরিষেবা চালু হয়, যদিও  ১৯৩৩ – ১৯৬৪ সালের মধ্যে এগুলো সবই বন্ধ হয়ে যায়।


 

ট্রাম দেশে দেশে

এবার শোনা যাক  ট্রামের নামকরণ, উদ্ভাবন ও সফল সড়ক চারণার পেছনের কিছু বিশেষ কথা। সে গল্প শুরু হয়েছিল সাগর পারে। প্রাথমিকভাবে খনি অঞ্চলে ব্যবহৃত হওয়া মালগাড়ি কে ট্রাম বা ট্রলিকার বলা হত। এখান থেকেই ট্রাম বা ট্র্যাম শব্দটি নেওয়া। ট্র্যাক বা  লাইনের ওপর দিয়ে যায় বলে আমেরিকায় একে ট্রাম ট্রেন বা ট্রলিও বলা হয়ে থাকে।  ১৮০৪ খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মাম্বলস রেলওয়ে আইন পাশ হয়। তারপর যুক্ত রাজ্যের সোয়াংসি এ্যান্ড মাম্বলস রেলওয়েজের তত্বাবধানে ১৮০৭ সালে বিশ্বের প্রথম ঘোড়ায় টানা  যাত্রীবাহী ট্রাম চালানো হয়। যদিও ১৮২৭ সালে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু ১৮৬০ সাল থেকে  ট্রামের এই পরিষেবা আবার চালু করা হয়েছে। মাম্বলস কোম্পানি  ১৮৭৭ সালে  বাষ্পচালিত ও  ১৯২৯ সালে  বিদ্যু্ৎচালিত  ট্রাম বিলেতের পথে চালায়।  

ইওরোপে প্রথম স্থায়ী ট্রাম চলাচল করতে শুরু করে ১৮৫৬ সালে প্যারিসে, ১৮৫৮ সালে দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে, ১৮৬০ সালে অষ্ট্রেলিয়াতে, ১৮৬৩তে আফ্রিকায়। এশিয়া মহাদেশে জাকার্তার বাটাভিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় ট্রাম পরিষেবা চালু হয় ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে।  বিশ্বের প্রায় ৩০০ শহরে ট্রাম আজও যাত্রী পরিবহনের একটি অন্যতম মাধ্যম।

ওয়ার্নার ভন সিমেন্স নামের এক ব্যক্তি ট্রাম আবিষ্কার করেন। ট্রামের বগির নকশা করেছিলেন থমাস ডেভেনপোর্ট।  ১৮৮১- ৮২ সালে ট্রাম বাণিজ্যিক ভাবে চালু করেন গ্রস লিচটারফ্রেন্ড। ১৮৭৫ সালে ফিওদর পিরোটস্কি বৈদ্যুতিক ট্রাম লাইনের উদ্ভাবন করেন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় সেটি পরীক্ষা করা হয়। লম্বা এই সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে উন্নত ট্রাম পরিষেবার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছে।

 

মিলানের রাস্তায় ট্রাম (ছবি - রাজর্ষি ঘোষ) 

 

বঙ্গ সংস্কৃতিতে ট্রাম

ট্রাম না ট্র্যাম? বানান নিয়ে সাহিত্যিকদের দ্বিমত থাকলেও বাংলার মানুষের মননে, সংস্কৃতিতে ট্রামের অবাধ গতিবিধি। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে সুনীল, সমরেশ, বুদ্ধদেব বসুর লেখায় ট্রাম এসেছে সমকালীন সমাজের ছবি নিয়ে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের নায়ক রজত ট্রামের ভাড়া বাঁচিয়ে নববধূর জন্য ফুলের মালা কেনে (শুধু কেরাণী), বুদ্ধদেব বসুর (নির্জন সাক্ষর) এক চরিত্র, এসপ্ল্যানেডে ট্রামের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা নিত্যযাত্রী সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়ায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “প্রবাসী”, সমরেশ বসুর “কালবেলা”, তুলে ধরেছে ট্রাম আন্দোলনের ছবি। রবীন্দ্রনাথের “ক্যামেলিয়া”তে ফুটবলার ছেলেটির ট্রাম সফরকালীন রোমান্টিসিজমই তাকে নিজের স্টপেজে নামতে দেয়না। জীবনানন্দের কবিতায় ট্রামের সর্পিলাকার লাইন শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। শম্ভু মিত্র নাটকে, সত্যজিৎ “মহানগর”, মৃণাল “পদাতিক”-এ ট্রামকে ধরেছেন সেলুলয়েডে। শ্রীপান্থ তাঁর “পালকি থেকে ট্রাম” প্রবন্ধে লিখেছেন “ট্রাম না চললেও কলিকাতা শহর চলে। _ _ _। ট্রামের সাধ্য কি আমাদের থামায়”। কী প্রাসঙ্গিক লেখা। সম্পর্ক নাট্যদলের “উড়ো চিঠি”, একটি উল্লেখনীয় কাজ; একটি চলন্ত ট্রামে নাটকের পরপর দুটি শো করা, যেখানে দর্শক ও নাট্যকর্মীরা এক সুন্দর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছিলেন। শ্রেয়া ঘোষালের “অটোগ্রাফ” সিনেমার গানের লাইনেও ট্রামের উল্লেখ আছে। এভাবেই ট্রাম  থেকে গেছে কলকাতার শিল্প সংস্কৃতিতে।

 

আন্দোলনে ট্রাম

কলকাতার নাগরিক জীবনে একদা অপরিহার্য ট্রাম একসময়ে দৈনিক প্রায় ১৫,০০০ যাত্রী বহন করত। ট্রামের সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালীর আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন।  

১৯১০ সালের পরে ক্যালকাটা ট্রাম কর্পোরেশন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে, গঠিত হয় কর্মচারী ইউনিয়ন, যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ বিপ্লবী ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত। রাজনীতির উত্তাল সময়ে এই ইউনিয়ন ১৯৩৯, ১৯৪৩ ও ১৯৪৭ এর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। আবার এই ইউনিয়নই ১৯৪৬ সালের দেশব্যাপী দাঙ্গায় হিন্দু মুসলিম ঐক্যরক্ষায় এক গৌরব জনক ভুমিকা নিয়েছিল। ধর্ম নির্বিশেষে কলকাতা ট্রামের সমস্ত কর্মচারী  রাজাবাজার ট্রাম ডিপোতে জমায়েত হয়ে সশস্ত্র দাঙ্গাবাজদের থেকে রাজাবাজার ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউটের ছাত্রীদের   প্রাণ ও সম্ভ্রম রক্ষা করে। ট্রাম কর্মচারী ইউনিয়নের এ এক গৌরবজনক অধ্যায়।

১৯৫৩ সালের জুন মাসে বিধান রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন, ট্রাম কম্পানি জুলাই থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাড়া ১ পয়সা বাড়ানোর ঘোষণা করলে, জ্যোতি বসু ও হেমন্ত বসুর নেতৃত্বে প্রবল আন্দোলন শুরু হয়েছিল। উত্তেজিত জনতা ট্রামে আগুন পর্যন্ত ধরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেন এবং গণ ধরপাকড় শুরু  হয়।

 

সরকারি অধিগ্রহণ

১৯৫১ সালে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ এ্যাক্ট পাশ হলে পশ্চিম বঙ্গ সরকার জুন ১৯৭২ এর পরে দু বছরের নোটিশ সাপেক্ষে কোম্পানির সত্ত্বাধিকার অধিগ্রহণের অধিকারী হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে টেকিং ওভার এ্যাক্ট পাশ হয় এবং ঐ সালের ১৯শে জুলাই সরকার কোম্পানির পরিচালন কমিটি অধিগ্রহণ করে। ৮ই নভেম্বর ১৯৭৬ তারিখে পশ্চিম বঙ্গ সরকার কোম্পানির সমস্ত সম্পত্তির সত্বাধিকারী হয়।

 

সুবিধা-অসুবিধা

অন্যান্য  সবকিছুর মতই ট্রাম পরিষেবারও সুবিধে অসুবিধে দুইই আছে।

বিদ্যুৎচালিত ট্রাম সম্পূর্ণ দূষণহীন পরিষেবা দিত। নাগরিকদের সুবিধের জন্য ট্রাম কোম্পানি  ছুটির দিনে দৈনিক টিকিটে যতবার খুশি ট্রাম ভ্রমণের সুযোগ রেখেছিল। ট্রামে একসাথে ৩০০ লোক সফর করতে পারত যেখানে বাসে মাত্র ৬০ জন যাত্রী যেতে পারে।

ট্রাম না থাকায় প্রধান অসুবিধে হল, যানবাহনের পেট্রোল ডিজেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বাতাবরণে, আবালবৃদ্ধ সকলেই ক্রমাগত  দূষণজনিত অসুখে ভুগছে। কত পরিবারের রুটি রুজির সাধন ছিল এই পরিবেশ বান্ধব যানটি।

কিন্তু ধীরে ধীরে দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠেছে  আমাদের জীবন। সেই দৌড়ে তাল মিলিয়ে কলকাতার রাস্তায় দৌড়তে শুরু করেছে নানান দ্রুতগতির যান। ভিড় কমেছে ট্রামে, লোকসানের খাতায় নাম উঠতে শুরু করেছে ট্রাম কোম্পানির ।  

সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে”, এ যেন মনে হয় শ্লথগতির ট্রামের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাছাড়া কোনো কারণে ট্রাম পথের মধ্যে খারাপ হয়ে গেলে এক মারাত্মক অসুবিধাজনক যানজটের সাক্ষী হতে হচ্ছিল আমাদের শহরকে। বর্ষার রাস্তায় ট্রামের ট্র্যাকে অন্যান্য গাড়ির পিছলে যাওয়ায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

ক্রমশঃ যুগের দাবিতে, কখনো যাত্রীর অভাবে, কখনো মেট্রো রেলের, আবার কখনো উড়ালপুল তৈরীর কাজের জন্য ক্রমশ শহরের রাস্তা থেকে  ভ্যানিশ হতে শুরু করে ট্রামেরা। ১৯৭০ ( হাওড়া ডিভিশন), ১৯৭৩ ( নিমতলা), ১৯৮০ (বেন্টিংক স্ট্রিট, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রোড), ১৯৯১ সালে (জহর লাল নেহেরু রোড), ১৯৯৫ (হাইকোর্ট টার্মিনাস), ২০০৪ (গড়িয়াহাট জংশন), ২০০৬ সালে (মোমিনপুর-বেহালা শাখা) ট্রাম রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি নির্দেশে আজ সমস্ত ট্রাম ই উঠে গেছে কলকাতার রাজপথ থেকে। ইতিমধ্যে অবশ্য ট্রাম কম্পানি কলকাতার পথে তাদের বাস নামিয়েছে। ২০০৭ সালে গ্যালিফ রোডের টার্মিনাস টি সম্পূর্ণ ভাবে বাস টার্মিনাসে পরিবর্তন করা হয়েছে।

 

ট্রাম মিউজিয়াম

 

স্মরণিকা ট্রাম মিউজিয়াম (ছবি - https://kolkatatourism.travel/) 

রাস্তায় ট্রামের সংখ্যা কমতে থাকলেও কমেনি সহ নাগরিকদের সাথে ট্রামের আত্মিক যোগ। তাই সরকারি আনুকূল্যে গড়ে উঠেছে কলকাতা ট্রাম মিউজিয়াম, “স্মরণিকা”। সিধু কানহু ডহরে, সিটিসি টার্মিনাসের ঠিক পাশে “স্মরণিকা” দাঁড়িয়ে আছে আমার, আপনার, আগামী প্রজন্মের প্রতীক্ষাতে। ১৯৩৮ সালের একটি ভিনটেজ ট্রাম গাড়িতে চালু করা হয়েছে এই মিউজিয়াম। নোনা পুকুর ওয়ার্কশপে গাড়িটিতে কিছু পরিবর্তন করে এটিকে মিউজিয়ামের উপযুক্ত করে তোলা হয়েছে। পুরোনো কাঠের কাঠামো ওয়ালা ট্রামের বগি মনকে পিছিয়ে নিয়ে যায় অতীতে। সামান্য দর্শনীর বিনিময়ে ঘুরে আসা যায় ট্রামের অতীত সফরে। প্রথম কামরাতে ট্রামের সফরের শুরুর দিন থেকে ট্রাম সম্পর্কিত সমস্ত উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন গুলি রাখা হয়েছে। আছে পুরোনো ট্রামগুলির মডেল, টিকিট, কয়েন চেঞ্জার, এবং আরও অনেক স্মৃতিভারাক্রান্ত জিনিস। দ্বিতীয় কামরাটিকে একটি বাতানুকূল ক্যাফেটেরিয়ার রূপ দেওয়া হয়েছে, যেখানে চা, কফির আনন্দ নিতে নিতে দেখে নেওয়া যাবে  ট্রাম সম্পর্কিত একটি তথ্যচিত্র ।

 

শেষের কথা

সমস্ত জায়গা থেকে ট্রাম উঠে গেলেও, হাওড়া শহরের বুকে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে একটি ট্রাম হীন ট্রামডিপো, শিবপুর ট্রাম ডিপো। আজ অনেকদিনই এখানকার ট্রাম সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, লাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে, পিচ ঢেলে মেরামত করা হয়ে গেছে জি টি রোডের সেই ক্ষতবিক্ষত রাস্তা;  কিন্তু তবুও আজও রয়ে গেছে শিবপুর ট্রাম ডিপো নামটা। লেখা রয়েছে হাওড়া শহরের মানচিত্রে, হাওড়া স্টেশন ও ধর্মতলাগামী সমস্ত বাস, মিনিবাসের গায়ে আন্দুল বি গার্ডেন, উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইল এবং অন্যান্য রুটের হাওড়া গামী বাস কন্ডাক্টরদের হাঁকডাকে, অটো, টোটো, রিকশা চালকদের আর শিবপুরের বাসিন্দা সহ নাগরিকদের কথায়। বাসের টিকিট কাটতে গিয়ে, কোথায় নামবে, কোথায় যাবে বলতে গিয়ে যারা এখনও বলে, “ট্রাম ডিপো”!

পরিবেশ দূষণের এই সংকটকালে যদি ট্রাম কে আরও আধুনিক আরও গতিশীল করে ব্যবহারে রাখা যেতে পারত, যাতে পরিবেশে দূষণের মাত্রা সংযত থাকে, তখনই আজকের গতির যুগের সাথে পাল্লা দিতে না পারায় সেই পরাধীন ভারত থেকে স্বাধীন ভারতে উত্তরণের সাক্ষী থাকা ট্রাম বিদায় নিল আমাদের নগরজীবন থেকে, কিন্তু আমাদের মন কেমনের ট্রাম, কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর/আত্মহত্যার বেদনাময়তার সাক্ষী আমাদের ট্রাম, আমাদের ভালোবাসার, ভালো লাগার ট্রাম ঠিকই থেকে যাবে আমাদের  ইতিহাসে, আমাদের প্রজন্মের স্মরণিকাতে।

 

তথ্যসূত্র- উইকির পাতা, ব্যক্তিগত অনুসন্ধান

 

0 Comments
Leave a reply