সচিন তেন্ডুলকর (ছবি - https://wamu.org/)
প্রায় চোদ্দ বছর হয়েছে গিয়েছে তিনি বাইশ গজকে বিদায় জানিয়েছেন। তবু মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে তাঁর বিদায়ী ম্যাচের হ্যাংওভারটা আজও যেন কোথাও ক্রিকেটপ্রিয় ভারতীয়দের মনের গভীরে রয়ে গিয়েছে। কর্মব্যস্ত দিনেও ওরকম উত্তুঙ্গ আবেগের উথালপাতাল, সচিন নামের গণ-হিস্টিরিয়া বিশ্বাস করুন আর কখনো ভারতীয় ক্রিকেট ক্যানভাস দেখবে বলে তো মনে হয় না। সে যতই আজকের যুগে একটা বিরাট কোহলি থাকুক। তিনি সচিন রমেশ তেন্ডুলকর। ভারতীয় ক্রিকেটের এক এবং একমাত্র মিথ। যার উত্থানের কোনো ব্যাখ্যা ক্রিকেট গবেষকদের কাছে আজও নেই। খেলা ছাড়ার বারো বছর পরও নেই!
একেক সময় মনে হয় নিশ্চই এই মানুষটার মধ্যে সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আছে। নইলে কী করে একটা মানুষের ক্রিকেট-জীবনের শুরু আর শেষটা এমন রূপকথার রাংতা মোড়া হতে পারে? কিরকম পুরো জীবননাট্যটাই যেন এক অদ্ভুত ছকে বাঁধা!
উননব্বইয়ের করাচি না হয় অবিশ্বাস্য এক বালক প্রতিভার উন্মেষ ঘটিয়ে ফেলেছিল। দু'হাজার তেরোর মুম্বই কী করে সম্ভব হলো? আরব সাগরের উপকূলবর্তী দুটো শহরের মধ্যবর্তী দূরত্ব মাত্র ৫৫১ মাইল যার মধ্যেই এক বিস্ময়ের জন্ম হল। আবার সস্নেহে বৃত্তটা সম্পূর্ণ করে শ্রেষ্ঠত্বের শো কেসে ঢুকিয়ে দিল। দুটোরই একইরকম ডিজাইন। কী করে সম্ভব? নাকি ক্রিকেটবিধাতা তাঁর শ্রেষ্ঠ পূজারীর আন্তরিকতায় এমনই বিহ্বল যে তিনি অদ্ভুত সমাপতনের চিত্রনাট্য শুরুর দিন থেকেই লিখে রেখেছিলেন?
সময় সময় বিশ্বাস হয়না কী করে একটা মানুষের জীবন এতটা ছকে বাঁধা হতে পারে? চব্বিশ বছরের রূপকথার ক্রিকেটীয় জীবন আর এখন একজন আদ্যোপান্ত ফ্যামিলি ম্যান হিসেবে তাঁকে দেখে মনে হয় সত্যিই তিনি দেবতারই বরপুত্র নইলে এগুলো সম্ভব হয়না। রোজই তো কত প্রতিভার জন্ম হয় ভারতমাতার স্নেহের গর্ভে কিন্তু তার মধ্যে ক'জন বিভিন্ন প্রতিকূলতার টর্নেডো সামলে ব্যর্থতার সাথে লড়াই করে এমন গগনচুম্বী সাফল্যের মুখ দেখে? আসলে শুধু ভাগ্য কিংবা ঈশ্বরদত্ত ট্যালেন্ট থাকলেই তো আর কেউ সচিন হয় না। সচিনের উত্থান সম্ভব হয়েছে ওরকম একটা পরিবারের ঘেরাটোপ, দাদা অজিতের ভাইয়ের জন্য আত্মত্যাগ, স্ত্রী অঞ্জলীর ডাক্তারি জীবনের উজ্জ্বল কেরিয়ারের মায়া ত্যাগ করে স্বামীর সহযোদ্ধা হয়ে পরিবার সামলানো আর অবশ্যই তার নিজের রান করার সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খার কারণে। এই চতুর্ভুজের সোনালী ফসল হলো সচিন তেন্ডুলকর। যা না থাকলে সচিন প্রতিভা ভারতীয় ক্রিকেট ক্যানভাসে প্রতিভাতই হয় না।
এখনো ভাবি, ওই ব্যাট-প্যাড-হেলমেট-গ্লাভস সজ্জিত বেঁটেখাটো পৃথুল লোকটা আসলে ভারতবর্ষের আস্ত একটা মানচিত্র ছিল। হেলমেটে লাগানো তাঁর জাতীয় পতাকা থেকে যেন কাশ্মীর শুরু হতো। তারপর উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান হয়ে শার্টের কাছ থেকে নামতে নামতে বুটের স্টাডে এসে পৌঁছে যেত কন্যকুমারিকা। ডিপ্রেশনের কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার আগে তরুণ-তরুণীরা সেই মানচিত্রকে অনুসরণ করত। উঁহু, করত কী বলছি এখনো করে। ভবিষ্যতেও করবে যতদিন পৃথিবীতে মানুষ স্বপ্ন দেখবে যতদিন এই দুর্নীতির চন্দ্রাতপে ঢেকে যাওয়া সমাজে উচ্চাকাঙ্খার পাখিরা উড়ে বেড়াবে ততদিন মানুষ তাঁর দেখানো স্বপ্নের মানচিত্রকেই অনুসরণ করবে।
সচিনের অবসরের দিনেই তাঁকে 'ভারতরত্ন' ঘোষণা করে দেয় তৎকালীন কেন্দ্র সরকার। সেই সময়ে অনেকেই বলেছিল বিশেষত রাজনৈতিক কেষ্টবিস্টুরা, ধ্যানচাঁদের (মেজর) আগে তেন্ডুলকরকে ভারতরত্ন দেওয়া উচিত হচ্ছে কি সরকারের? পুরোটাই আমার কাছে হাস্যকর,অপ্রাসঙ্গিক আর মেঠো বলেই মনে হয়েছিল। যদি সেইসময় ভারত সরকার ভারতরত্ন তাঁর গলায় তড়িঘড়ি করে নাও ঝোলাত তাতেই বা কী এসে যেত!
পুরস্কার আর না-পুরস্কার তেন্ডুলকর যে সর্বকালীন বিচারে ভারতের প্রথম সারির রত্ন তা নিয়ে কারোর কোনো প্রশ্ন নেই, থাকাও উচিত নয়।
এখানেই বলে রাখা যাক, এসব বিতর্কের অনেক আগেই তাঁর গলায় 'অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া' (অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ নাগরিক সন্মান) পড়িয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলীয় সরকার। হ্যাঁ,ঠিকই পড়ছেন অস্ট্রেলীয় সরকার। সেই অস্ট্রেলিয়া যেখানে ডন ব্র্যাডম্যান নামক ক্রিকেটের যুগপুরুষ জন্মেছে এবং যারা ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে চিরকাল নাক সিঁটকিয়ে এসেছে।
কোনো অনাবাসী ভারতীয়ের কাছে তিনি আশা-আকাঙ্খার জ্বলন্ত প্রদীপ, কিংবা তিনি মানেই সমগ্র ভারতবর্ষ, বা আধুনিক ভারতের বৈদিক সভ্যতার শেষ বংশধর। ক্রিকেটের ঔরসে কালের নিয়ম মেনেই প্রতিভা আসবে যাবে কিন্তু সচিনরূপী ঐশ্বরিক প্রতিভা আর জন্মাবে না। নইলে গাওস্কর থেকে সৌরভ গাঙ্গুলী, কুম্বলে থেকে বিরাট কোহলি কত ক্ষণজন্মা প্রতিভার জন্ম হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের গর্ভে কিন্তু তিনিই আজও সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী আইডল হয়ে রয়ে গিয়েছেন। তিনি মানেই কোনো কিশোর-কিশোরীর আদর্শ বাবা-কাকা-জেঠা, যৌবনা তরুণীর মনের মানুষ কিংবা ভরসার দাদা, বাড়ির মা-কাকিমাদের আদর্শ পুত্র। তাকে তাই পদবি নয়, নাম-ভালোবাসা দিয়েই ভাবতে পছন্দ করে হিমালয় থেকে বিন্ধ্য পর্বত, গঙ্গোত্রী থেকে রামেশ্বর।
ক্রিকেটার সচিন মৃত কিন্তু মানুষ সচিন চির অবিনশ্বর। তাঁর জন্মদিনের প্রাক্কালে লিখতে বসে মনে হলো সচিনের ক্রীড়াজীবনের কোনো গল্পকথা এখানে লিখব না এ লেখা একজন পাগল ভক্তের তাঁর 'ঈশ্বরে'র প্রতি সামান্য ভালোবাসার ফুল-বেলপাতার সহিত শ্রদ্ধার্ঘ্য। তাই তাঁর ব্যাট হাতে ঘটানো বাইশ গজের রূপকথা গুলোকে আজ সযত্নে এড়িয়ে গেলাম।
শুভ জন্মদিন ক্রিকেট জাতিস্মর। সচিন-স্মৃতি দীর্ঘজীবি হউক.....