ভেনিসের মুখোশ (ছবি - https://imagesofvenice.com/)
মুখোশ নিয়ে লিখতে বসে প্লেটো ও ফ্রেডরিখ নিটশের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কী অসামান্য সেই বিশ্লেষণ। মিথ্যে মানুষের মুখোশ কী অবলীলায় তাঁরা টেনে খুলে দিতে পারেন। বিপজ্জনক মানুষকে কী সহজে চিনিয়ে দেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক মানুষরা হল তারা, যারা অন্যদের মতো হতে চায় এবং নিজেদের আসল পরিচয় ঢেকে রাখে। তাদের মুখোশ হয়ত সমাজে মানানসই, কিন্তু হৃদয়টা ঠিকই অপরিচিত থেকে যায়’। কিংবা জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশের মানুষ সম্পর্কে করা উক্তি চিরকালীন মনে থেকে যায়, ‘মানুষ শুধু অন্যদের সামনে নয়, নিজের কাছেও মুখোশ পরে। আত্মপ্রতারণা মানুষকে দুর্বল করে তোলে এবং তাকে সত্যের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়’। অনেকদিন আগে মহাদেব সাহার চমৎকার একটা কবিতা পড়েছিলাম। মুখোশ প্রসঙ্গে আজও কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক সেই লেখা।
সব ছিন্ন হয়ে যাক, এই মিথ্যা মুখ,
এই মুখের মুখোশ
সম্পূর্ণ পড়ুক খুলে;
এই মিথ্যা মানুষের নকল সম্পর্ক, এই
ভোজভাজি
যা যাওয়ার তার সবই খসে যাক,
ঝরে পড়ে যাক,
ছিন্ন হয়ে যাক এই কৃত্রিম ভূগোল,
এই মিথ্যা জলবায়ু;
স্পষ্ট হোক, প্রকাশিত হোক তার নিজস্ব প্রকৃতি
ছিন্ন হোক এই কৃত্রিম বন্ধন,
অদৃশ্য অলীক রজ্জু
থাক শুধু যা কিছু মৌলিক
পদার্থের যা কিছু প্রধন সত্তা;
সব ছিন্ন হয়ে যাক, খসে যাক,
ঝরে পড়ে যাক
থাক শুধু মৌলিক সত্তা, যা কিছু মৌলিক
আমি আর কোথাও কোনো মুখোশ
রাখবো না,
মুখোশ রাখবো না,
মুখোশের সাথে মিথ্যা সম্পর্কের
এই কঠিন কপট রজ্জু
আজ খুলে ফেলে ছিন্ন করে দেবো;
আমি কোনো মুখোশ রাখবো না,
মুখের বদলে কোনো মুখাকৃতি
মোটেও রাখবো না,
সব ছিন্ন হয়ে যাক, চুকে বুকে যাক
শেষ হয়ে যাক
এই মিথ্যা মুখোশ আমি
মোটেও রাখবো না।
বড্ড খাঁটি অনুভব। দিনবদলের সাথে সাথে আমরা সত্যিই গুলিয়ে ফেলছি চারপাশে অসংখ্য মুখ, নাকি তার আড়ালে সবই মুখোশ। টেনে খুলে দিতে কেউ পারে, কেউ পারে না। সেই মুখোশের উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে সম্যক জানতে ঘুরে আসতে হয় সিটি অফ লাভ অর্থাৎ প্রেমের শহর ভেনিসের অলিগলি, তস্য গলি; পড়ে ফেলতে হয় মুখোশের ইতিহাস।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত মুখোশ। ইতিহাস জুড়ে মুখোশের ব্যবহার। প্রকৃত মুখটি লুকিয়ে ফেলে চরিত্রকে আরও শক্তিশালী রূপ দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা মানুষের, যুগ যুগ ধরে। এইভাবেই বিখ্যাত হয়ে গেছে, এবং ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে ভেনিসের মুখোশ। ঠিক যেমন বলিভিয়ার কার্নিভাল মাস্ক, কঙ্গোর ইয়াকা সংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক মুখোশ, লুবা সংস্কৃতির কিফওয়েবের মুখোশ, পেন্ডে সংস্কৃতির মহিষের মুখোশ, মেক্সিকোর শয়তানের মুখোশ, নাহুয়া সংস্কৃতির জাগুয়ার মাস্ক, লাইবেরিয়ার শিম্পাঞ্জি মাস্ক, নাইজেরিয়ার ইডিওক একপো মাস্ক, ইগবো সংস্কৃতির মেইডেন স্পিরিট মাস্ক, তাইওয়ানের বানরের দেবতার মুখোশ, জাপানের নোহ মাস্ক, পাপুয়া নিউ গিনির স্পিরিট মাস্ক, পূর্বপুরুষ মুখোশ, ইন্দোনেশিয়ার টপেং মাস্ক, বুরকিনা ফাসোর কারাঙ্গা মাস্ক, প্রজাপতির মুখোশ, আইভরি কোস্টের রাম মুখোশ, ঘানার সান মাস্ক, চাঁদের মুখোশ কিংবা ভারতের ছৌ মুখোশ।
ভেনিস মুখোশের জগৎজোড়া খ্যাতি। সেখানে মুখোশটি একটি প্রতীকী মাত্র, কারণ এটি ভেনিসীয়দের উদযাপন, বিনোদন এবং সীমা লঙ্ঘনের প্রতি তাদের মনোভাবকে তুলে ধরে। আর ভেনিসীয় কার্নিভালের উচ্চারণ তো ফেরে দুনিয়ার মানুষের মুখে মুখে। আর সেই কার্নিভালের অপরিহার্য উপাদান হল হরেক কিসিমের মুখোশ। এই উদযাপনে সমাজের সব স্তরের মানুষ একত্রিত হয়, পরিচয় গোপন রেখে মতের আদানপ্রদান করতে পারে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ভেনিসে মুখোশ পরা ছিল মর্যাদার প্রতীক। তবে এর ব্যবহার কঠোর নিয়মের আওতায় বাঁধা ছিল। যেমন কার্নিভালের সময় এবং কিছু নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে অথবা গির্জার মতো পবিত্র স্থানে মুখোশ পরা ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। একজন পুরুষ কখনই মুখোশের ব্যবহারে মহিলা সাজতে পারত না। আবার যৌনকর্মীদের জনসমক্ষে মুখোশ পরার অনুমতি ছিল না।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে শুরু হওয়া ভেনিস কার্নিভাল বা কার্নেভেল ডি ভেনেজিয়া আজও বিখ্যাত। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ পর্যটক এই প্রাচীন ঐতিহ্যের উত্তেজনা, জাঁকজমক এবং রং তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন। ইতালির ভেনিস শহরের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যই হল মুখোশ। সাধারণত কার্নিভালের সময়ই মুখোশ পরা হয়, তবে আগে অন্যান্য অনেক অনুষ্ঠানেও এর ব্যবহার হয়েছে। সাধারণত পরিধানকারীর পরিচয় এবং সামাজিক মর্যাদা লুকনোর হাতিয়ার হিসেবে ভেনিসের মুখোশের ব্যবহার ছিল বহুল। পরিচয় ও দৈনন্দিন রীতিনীতির বাইরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইত। কিছু উদ্দেশ্য ছিল অবৈধ বা অপরাধমূলক, অন্যগুলি কেবলই ব্যক্তিগত, যেমন রোমান্টিক সাক্ষাৎ। ভেনিসীয় মুখোশের অবশ্য আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাদের অলঙ্কৃত নকশাই বলে দেয় এটা ভেনিস মুখোশ। সোনালি বা রুপোর মতো উজ্জ্বল রং এবং বারোক শৈলীতে জটিল সাজসজ্জার ব্যবহার। ভেনিসীয় মুখোশের অনেক নকশা কমেডিয়া ডেল আর্ট থেকে এসেছে। এগুলি পূর্ণ মুখোশ, চোখ, নাক ঢেকে দেয়। আবার শুধু চোখের বাহারি মুখোশেও ভেনিসের জুড়ি মেলা ভার।
থিয়েটারে মুখোশ পরার প্রথা প্রাচীন গ্রিক উৎসবের সময় থেকে শুরু, থিয়েটারের দেবতা ডায়োনিসিয়াসের সম্মানে। রোমানরা যখন দক্ষিণ ইউরোপ জয় করে, তখন তারা গ্রিকদের থিয়েটারের প্রতি ভালবাসা এবং নাটক ও উৎসবে মুখোশের ব্যবহারকে অভিযোজিত করে। ১৪৩৬ সালে, ভেনিসের গিল্ড অফ ডেকরেটরসের কর্তারা মুখোশ তৈরির শিল্পকে পুনর্গঠিত করেন। বেশ কয়েকটি নিয়ম বলবতের প্রস্তাব করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন ভেনিসের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট গিউস্তিজিয়েরি ভেচ্চি। ‘মাশ্চেরেরি’ বা ‘মাস্করেরি’র ভেনিসীয় পেশার আনুষ্ঠানিকভাবে নিজস্ব গিল্ড এবং আইনের স্বীকৃতি মেলে। চাহিদা ক্রমশই বাড়তে থাকে। ফলে এই পেশায় আরও কারিগর আকৃষ্ট হয়। তাই এর ব্যবহার আরও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল। ভেনিসে সংরক্ষিত একটি নথি থেকে জানা যায়, ১৫৩০ থেকে ১৬০০ সালের মধ্যে এগারোজন কারিগর মুখোশ প্রস্তুতকারক হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছিলেন, যার মধ্যে বারবারা শার্পেটা নামে একজন মহিলাও ছিলেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ‘তারঘেরি’ অর্থাৎ সাজসজ্জার সমাপ্তি এবং নতুন ‘মুখ’ তৈরির বিশেষজ্ঞ কারিগররা। ভেনিসে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই স্বতন্ত্র মুখোশগুলি ঐতিহ্যগতভাবে কাগজই দিয়ে তৈরি করা হত এবং পশম, কাপড়, রত্ন বা পালক দিয়ে অসাধারণভাবে সাজিয়ে তোলা হত। অবশেষে, ভেনিসীয় মুখোশগুলি কার্নিভালের প্রতীক হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়। শুরু হয় প্রতিযোগিতা। আন্তর্জাতিক মেলার রূপ পায় ভেনিসীয় মুখোশ প্রদর্শন।
ভেনিস কার্নিভাল ঐতিহ্যগতভাবে ২৬ ডিসেম্বর শুরু হত এবং অ্যাশ বুধবারের আগের দিন, অর্থাৎ শ্রোভ মঙ্গলবারে শেষ হত। অর্থাৎ দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে এই কার্নিভাল চলত। এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এবং অসামান্য এক কার্নিভাল। প্রথমদিকে এই কার্নিভালে মুখোশ পরায় কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। মুখোশের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের প্রথম আইনটি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে প্রণীত হয়। তবে এটা জানা যায় না, কখন থেকে ভেনিসিয়ানরা দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে মুখোশ পরা শুরু করেছিল। তবে এই সবকিছুরই অবসান ঘটে ১৮ শতকের শেষের দিকে, ভেনিসিয়ান প্রজাতন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে। তার আগে, আইন অনুসারে বছরের বেশিরভাগ সময়ই মুখোশ পরার অনুমতি ছিল। শুধু ১৮ শতকে ৫ অক্টোবর থেকে ১০ জুন পর্যন্ত; অ্যাডভেন্টের সময় ১০ দিন এবং লেন্টের ৪০ দিন বাদে মুখোশ পরায় কোনও বাধা ছিল না। প্রসঙ্গত, ভেনিস ছিল একটি অভিজাত প্রজাতন্ত্র। যার গণতন্ত্রের ধরন ছিল অনন্য। উচ্চবিত্ত শ্রেণি বাদে সাধারণ মানুষের সরকারে কোনও বক্তব্য ছিল না। অতএব, তাদের ভোগ করা সম্পদ, ক্ষমতা এবং ঐকমত্যের সাহায্যে, অভিজাতরা তাদের নিজস্ব জীবনধারা সাধারণ জনজীবনের উপর আরোপ করতে পারত, যা সমগ্র ভেনিসীয় সমাজের জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করত। ভেনিসীয় অভিজাতরা ছিলেন মূলত ব্যবসায়ী এবং অভিযাত্রী। জাহাজে পণ্য চাপিয়ে বাণিজ্য করার সময় তাঁরা অনেক সময় নিজের জীবন বাজি লাগাতেন। তাই তাঁরা একটি শহর তৈরি করেন, যার অন্যতম ধারণাই ছিল সাহসিকতার তীব্র অনুভূতি। তখন থেকেই ভেনিসের মুখোশ নিয়মের অনুপস্থিতি এবং কর্মের স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে। মুখোশের গোপনীয়তা দিয়ে যা খুশি করা যেত। ভেনিস সেই অ্যাডভেঞ্চারকে সমর্থন করত। ফলে ধীরে ধীরে কার্নিভালের ঐতিহ্যবাহী সীমানা ভেঙে মুখোশগুলি দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করে। ভেনিস প্রজাতন্ত্রের পতনের পর মুখোশ-মন্দার সময়কাল শুরু। তবে ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিক থেকে ভেনিসে মুখোশ শিল্পের নবজাগরণ ঘটে। আজ তো ভেনিসের যত্রতত্র মুখোশ বিক্রেতার সারি। গোটা বিশ্বের পর্যটকরা ভেনিস থেকে মুখোশ না কিনে বাড়ি ফেরেন না। রঙে, ঐতিহ্যে, বর্ণে, বৈচিত্র্যে, বৈশিষ্ট্যে ভেনিসীয় মুখোশ দুনিয়ার তাবড় মুখোশ-শৈলীকে টেক্কা দেয়। এই মুখোশ ব্যবসার পুনর্বিকাশ শুরু হয় কিছু ভেনিসিয়ান কলেজ ছাত্রের প্রচেষ্টায়, পর্যটন বাণিজ্যের জন্য। বিশেষজ্ঞ ভেনিসিয়ান কারিগরদের তৈরি আসল এবং বেশ ব্যয়বহুল মুখোশের উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমদানি করা সস্তা সংস্করণ থেকে এগুলি আলাদা করা শুরু হয়। তখন থেকেই ভেনিসীয় মুখোশ বিশ্ববাজার ধরে ফেলে এবং নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে ফেলে। তখনই বলবৎ করা হয় মুখোশ-বিরোধী আইন। উদ্দেশ্য বিলাসিতা বা অপব্যয় নিয়ন্ত্রণ। নৈতিক বা ধর্মীয় ভিত্তিতে অভ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্যই এই আইন তৈরি করা হয়।
ভেনিস কার্নিভালের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল পোশাক এবং মুখোশের অত্যাশ্চর্য ছদ্মবেশ। মুখোশের প্রতীকী এবং কার্যকরী বৈশিষ্ট্য ছিল। অতীতে ভেনিস কার্নিভালের সময়, ভেনিসের রাস্তাগুলি মুখোশ এবং অভিনব সব পোশাক-পরা মানুষে ভরে থাকত। তাদের পরিচয় রক্ষা করা তো বটেই, মুখোশ পরিধানকারীদের মধ্যে যে কোনও সামাজিক এবং শ্রেণিগত পার্থক্য দূর করাও সম্ভব হত। তবে দুর্ভাগ্যবশত, নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন করার ক্ষমতার কারণে ক্রমশ চুরি এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধের উপযুক্ত স্থান হয়ে ওঠে ভেনিস। যৌনকর্ম, সমকামী কার্যকলাপ, জুয়া, মাদক এবং মদ্যপানের মতো কাজে এই মুখোশই পরিচয় গোপন করার সুযোগ দিত। অন্যরা এই ধরনের অনৈতিক আচরণের অনুমোদন দিচ্ছে কিনা, তা চিন্তা করার প্রয়োজনই বোধ করত না একদল মানুষ।
মুখোশ-পরা মানুষের প্রথম নথিভুক্ত উল্লেখ পাওয়া যায় ১২৬৮ সালে। তখন আইন অনুসারে মুখোশধারী ব্যক্তিদের বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। গ্রেট কাউন্সিল মহিলাদের হাঁটাচলার সময় বা বারান্দায় গোলাপ জলে ভরা সুগন্ধযুক্ত ডিম নিক্ষেপ নিষিদ্ধ করেছিল। এই বিনোদন এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে সরকার মহিলাদের তাদের দামি পোশাক আশাক ময়লা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বারান্দাগুলি জাল দিয়ে ঘিরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। এই সময়েই ‘ম্যাটাচ্চিনো’ মুখোশ (তরুণ অভিজাতরা জোকারের পোশাক পরেন) আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রথম মুখোশ হয়ে ওঠে। ১৩৩৯ সাল থেকে অপরাধমূলক এবং আপত্তিকর আচরণের বিরুদ্ধে ভেনিস কার্নিভালের মুখোশ এবং পোশাকের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যেমন মহিলাদের পোশাক বা ধর্মীয় পোশাক পরে গির্জা, মঠ বা কনভেন্টে ঢুকে অশ্লীল কাজ এবং অন্যান্য স্বাধীনতা হরণ করার সুযোগ। ডাকাত এবং খুনিদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য মুখ রং করা এবং নকল দাড়ি এবং পরচুলা পরাও নিষিদ্ধ ছিল। রাতে মুখোশ এবং রঙচঙে পোশাক পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কারণ পোশাকের নীচে লুকিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করা অনেক সহজ ছিল। ১৮ শতকে কার্নিভালের সময়, মুখোশ এবং কার্নিভালের পোশাক পরে ক্যাসিনোতে যাওয়ায় ছিল বারণ। কারণ অজানা জুয়াড়িরা মুখোশ পরে খুব সহজেই তাদের পাওনাদারদের হাত থেকে পালিয়ে যেত। ১৭৯৭ সালে নেপোলিয়নের হাতে ভেনিসীয় প্রজাতন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভেনিস কার্নিভালের পোশাকের ওপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ভেনিসের প্রায় হাজার বছরের দীর্ঘ স্বাধীনতার অবসান হয় এবং প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলে আসা ভেনিসীয় কার্নিভালের বহু ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটে।
আধুনিক ভেনিসিয়ান কার্নিভাল উদযাপন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৯ সালে পুনঃপ্রবর্তিত হয় এবং তা ভেনিসিয়ান মুখোশ তৈরির শিল্প ও নৈপুণ্যকে পুনরুজ্জীবিত করে। আজও, ভেনিসীয় কারিগররা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিজের হাতে মুখোশ তৈরি করেন। সময় ও যত্ন নিয়ে এই কাজ করা হয় বলে শৈল্পিক গুণ এই মুখোশগুলিতে স্পষ্ট ধরা পড়ে। প্রথমে একটি মাটির ছাঁচ তৈরি করা হয়; যা পরে তরল প্লাস্টারে লেপা হয়। এই প্লাস্টার স্তরটি সম্পূর্ণ শক্ত হয়ে গেলে, এটি ছাঁচ থেকে সরানো হয়। ছাঁচে ভেসলিনের পাতলা স্তর দিয়ে প্রলেপ দেওয়ার পর; ভেজা কাগজ এবং আঠার স্তর প্রয়োগ করা হয়। স্তরগুলি জমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকে যাওয়া এড়াতে বাড়তি যত্ন নেওয়া হয়। শোকানো পর্যন্ত তাপ-উৎসের ওপর রাখার পর, মাস্কটি সাবধানে খুলে ফেলা যেতে পারে। এরপর, সাদা টেম্পুরার (প্লাস্টার/গাসো) কয়েকটি কোট প্রয়োগ করা হয় এবং চোখের গর্ত কেটে ফেলা হয়। শেষে মাস্কটি সাদামাটা বা উজ্জ্বল রং, সোনা ও রুপোর পাতা, পালক, কাপড়, স্বরোভস্কি স্ফটিক এবং চামড়া ব্যবহার করে সাজানো হয়। কম ব্যয়বহুল বিকল্প হল কাগজ-মেশ পেস্ট, যা প্লাস্টারের (টেম্পুরা) সঙ্গে মেশানো থাকে। আধুনিক স্টাইলগুলি সোনালি এবং অন্যান্য রঙের ধাতব ফিলিগ্রি দিয়েও তৈরি করা যেতে পারে। বিশেষভাবে ধরে রাখার জন্য তৈরি মুখোশগুলিও সিরামিক দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে।
ভেনিসীয় মুখোশগুলিকে সাধারণত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। কমেডিয়া ডেল আর্ট মাস্ক এবং কার্নিভাল মাস্ক। কমেডিয়া ডেল আর্ট হল এক ধরনের ইম্প্রোভাইজেশনাল থিয়েটার যা ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালিতে শুরু হয়েছিল এবং আঠারো শতক পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। এই থিয়েটারের হাস্যরসাত্মক চরিত্রগুলির মধ্যে ছিল আমাদের আধুনিক জোকারের পূর্বপুরুষ; যেমন হার্লেকুইন এবং জান্নি। কমেডিয়া ডেল আর্টের চারটি চরিত্র, ১) চাকর বা ‘জ্যানি’, - এরা সবই মুখোশধারী চরিত্র যেমন আরলেচিনো, ব্রিগেলা, পুলসিনেলা এবং পেড্রোলিনো; ২) বুড়ো মানুষ বা ‘ভেচ্চি’, প্যান্টালোন এবং ইল ডটোরের মতো চরিত্রগুলি, এরাও মুখোশ পরিহিত; ৩) প্রেমিক বা ‘ইনামোরাটি’, যাদের নাম ফ্ল্যাভিও এবং ইসাবেলার মতো হবে, ৪) ক্যাপ্টেন বা ‘ক্যাপিটানি’, যারা মহিলা হলে লা সিগনোরাও হতে পারে। এই নাটকে প্রচলিত কাহিনীর লাইনগুলি ব্যভিচার, ঈর্ষা, বার্ধক্য এবং প্রেমের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা হয়। এর মূল চরিত্রগুলিকে পোশাক, মুখোশ এবং ব্যবহৃত প্রপস দ্বারা চিহ্নিত করা হত, উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে এক ধরনের লাঠি যা ‘স্ল্যাপস্টিক’ নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত এই লাঠি থেকেই আধুনিক শব্দ ‘স্ল্যাপস্টিক কমেডি’র উৎপত্তি। কমেডিয়া ডেল আর্টে পুরুষ চরিত্রগুলিকে মুখোশ পরা অভিনেতারা অঞ্চল বা শহরের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে চিত্রিত করতেন। তবে, মহিলা চরিত্ররা সাধারণত মুখোশ পরতেন না। এই চরিত্রগুলির মধ্যে যেমন ব্রিগেলা হলেন একজন মুখোশধারী কমিক, যার মুখোশ পরে একজন অর্থলোভী খলনায়ক এবং আরলেচিনোর সঙ্গী। তাকে হয় একজন ভৃত্য চরিত্র হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, নয়ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্য হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। ইল ডটোরের মুখোশটিও অনন্য, কারণ এটিই কমেডিয়া ডেল আর্টের একমাত্র মুখোশ, যা কেবল কপাল এবং নাক ঢেকে রাখে। ইল ডটোরের পোশাকের রঙ হত সাধারণত কালো, কখনও কখনও তা সাদা কলারযুক্ত এবং তিনি প্রায়শই একটি টুপি এবং সাথে লম্বা লম্বা পোশাক পরেন। আবার পুলসিনেলা প্রায়শই একটি কালো মুখোশ এবং লম্বা সাদা কোট পরে থাকে এবং তার চুল আলগা এবং এলোমেলো হয়ে থাকে।
ভেনিস কার্নিভাল (ছবি - https://www.visit-venice-italy.com/)
তবে এই দুই মুখোশ-প্রজাতির সবচেয়ে বিখ্যাত হল ভেনিসিয়ান কার্নিভাল মাস্ক। তার মধ্যে বাউটা ভেনিসের কার্নিভাল জুড়ে বিখ্যাত ছিল, কারণ এটি কার্নিভালের সময় পরা প্রধান একটি মুখোশ। বাউটা নামের উৎপত্তি অনিশ্চিত। সম্ভবত এটি জার্মান ‘বেহটেন’ থেকে এসেছে, যার মানে রক্ষা করা। আবার কেউ কেউ বলে, ‘বাউ’ বা ‘বাবাউ’ শব্দ থেকে বাউটার উৎপত্তি, যা সাধারণত দানব বা খারাপ পশুর প্রতিনিধিত্ব করে; মূলত প্রাপ্তবয়স্করা শিশুদের ভয় দেখানোর জন্য এই মুখোশের ব্যবহার করত। বাউটা দেখতে বেশ ভূতের মতো এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি একটি কালো ট্রাইকর্নো বা তিনকোণাযুক্ত সাধারণ ভেনিসিয়ান টুপি, জেনডেল বা সাটিন এবং ম্যাক্রেম দিয়ে তৈরি লম্বা হুড ও একটি লম্বা কেপের সঙ্গে পরার ফ্যাশন হয়ে ওঠে। ভেনিসীয় কার্নিভালে ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সুন্দর মুখোশ হল ডামা। এটি একটি মার্জিত বৈচিত্র্য উপস্থাপন করে। সিনকুয়েসেন্টোর মহিলাদের সঙ্গে মিলে যায়; যারা নিজেদের গয়না, দামি পোশাক এবং মার্জিত পোশাকে আবৃত করতেন। গ্যাটো (ইতালীয় ভাষায় বিড়াল) হল আরো একটি ঐতিহ্যবাহী ভেনিসীয় কার্নিভাল মুখোশ। প্রজাতন্ত্রের সময় ভেনিসে বিড়াল এতটাই দুর্লভ ছিল যে, তা সাধারণ মুখোশগুলির মধ্যে একটি মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। আবার মোরেটা হল আর একটি ঐতিহ্যবাহী ভেনিসীয় মুখোশ। এই মুখোশটি সারা বছর ধরে ভেনিসীয় মহিলারা পরতেন। মোরেটা কালো মখমলের তৈরি একটি ডিম্বাকৃতির মুখোশ যা সাধারণত কনভেন্ট পরিদর্শনকারী মহিলারাই ব্যবহার করতেন। এটির উদ্ভব ফ্রান্সে এবং তা দ্রুত ভেনিসে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ এটি নারীসুলভ সৌন্দর্যকে তুলে ধরে। মুখোশটি একটি ঘোমটা দিয়ে শেষ করা হত। আবার ভল্টো (ইতালীয় ভাষায় ভূত এবং মুখ) হল একটি পূর্ণ মুখোশ, যা ‘নাগরিক’ মুখোশ নামেও পরিচিত; কারণ প্রাচীনকাল থেকে সমস্ত ছুটির দিনে সাধারণ মানুষ এটি পরত। থ্রিডি হওয়ায় এটি আরামদায়ক ছিল এবং সাধারণত তিনকোণাযুক্ত টুপি এবং পোশাকের সঙ্গে তা পরা হত; যা পরিধানকারীর চরিত্রের রহস্য বাড়িয়ে দিত। ডটোর পেস্ট হল একটি আধুনিক ভেনিসীয় কার্নিভালের মুখোশ এবং এর একটি অনন্য ইতিহাস রয়েছে। ভেনিস শহরে বেশ কয়েকবার আঘাত হানে প্লেগ। যে সব ডাক্তার এর চিকিত্সা করতেন তাঁরা একটি বিশেষ পোশাক পরতেন। ১৬৩০ সালে চার্লস ডি ল’অরমে এই পোশাক আবিষ্কার করেন। প্রথমে এটি নেপলসে ব্যবহৃত হত, কিন্তু পরে সমগ্র ইউরোপে ব্যবহার করা হয়। প্রতিরক্ষামূলক স্যুটে ছিল একটি হালকা, মোমের তৈরি কাপড়ের ওভারকোট, কাচের চোখ-খোলা মুখোশ এবং একটি পাখির ঠোঁট আকৃতির নাক, যার ভিতর সাধারণত ভেষজ দ্রব্য, খড় এবং মশলা ভরে দেওয়া হত। যেমন জুনিপার বেরি, অ্যাম্বারগ্রিস, গোলাপ, পুদিনা পাতা, কর্পূর, লবঙ্গ, লাউডানাম, গন্ধরস এবং স্টোরাক্স। তখন বিশ্বাস করা হত, এই স্যুটটি রোগীদের সেবা করার সময় ডাক্তারকে মায়াসমা (‘দুষ্ট বাতাস’, যা প্লেগের কারণ বলে মনে করা হত) থেকে রক্ষা করবে।
সেই ভেনিস যার আঁকাবাঁকা রাস্তার গোলকধাঁধায়, যেখানে গন্ডোলা ভেসে যায় এবং গোপনীয়তা মিলিত হয়, মুখোশগুলি আবির্ভূত হয়, একটি কালজয়ী ছদ্মবেশ, ষড়যন্ত্র, আবেগ এবং প্রহসনের একটি নৃত্যের মতো। শতাব্দী আগে, তাদের গল্প শুরু হয়েছিল, কার্নিভালের আগে। রহস্যের আলিঙ্গনে আচ্ছন্ন ভেনিসীয়রা মুখোশ পরে লুকিয়ে থাকত, ঘুরে বেড়াত, তাড়া করত। চীনামাটির বাসনের আড়ালে নীরব ফিসফিসানি, সন্ন্যাসী, পুরোহিত এবং প্রেমিকরা, তাদের হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হত। কনভেন্ট এবং পালাজ্জোতে, তারা দোল খাবে, দিনের আলো দ্বারা অসংযত, তাদের ইচ্ছাগুলি খেলা করে। সোনালি বিদ্রূপ, ঝিকিমিকি করা উজ্জ্বল চোখ, পালক, সিকুইন, এবং চাঁদনি রাত, কমেডিয়া ডেল’আর্ট, স্বপ্নের একটি থিয়েটার, যেখানে পিয়েরোট কেঁদেছিলেন এবং কলম্বাইন জ্বলজ্বল করেছিলেন। সেন্ট স্টিফেনের দিন থেকে শুরু করে লেন্টের আলিঙ্গন পর্যন্ত, মুখোশগুলি মুখমণ্ডলকে সজ্জিত করেছিল, সেটা ছিল এক গোপন সৌন্দর্য। ভেনিসিয়ান কার্নিভাল, রঙের একটি দাঙ্গা, যেখানে গোপনীয়তা নৃত্য করেছিল এবং আত্মা উন্মুক্ত ছিল।
ইতালির সেই ঐতিহাসিক নগরী ভেনিস। জলের ওপর ভেসে থাকা দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ, তার গা ঘেঁষে একে একে বয়ে চলা স্বচ্ছ লেকের জন্য এর খ্যাতি ভুবনজোড়া। ভেনিসের মতো নান্দনিক শহর পৃথিবীতে খুব কমই আছে। পুরো শহরের বুক জুড়ে থাকা জলে প্রাসাদের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে সঙ্গে আকাশের মেঘেরাও লেকের জলে হুটোপুটি খায়। অপূর্ব সুন্দর এই শহরটি তাই সারা পৃথিবীর পর্যটকদের প্রিয়। ভেনিস সারা বছরই পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত থাকে। প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ হাজার পর্যটক ভেনিসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যান। জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে ভাসমান এই শহরটি গড়ে উঠেছিল। ঐতিহ্য অনুযায়ী ভেনিসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সঙ্গী একমাত্র ছোট ডিঙি নৌকা। ভেনিসে বসবাস করা প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা হল এই নৌকা। বাড়ির ঘাটেই বাঁধা থাকে নিজস্ব নৌকা অথবা স্পিড বোট। ভেনিসের একটি আকর্ষণীয় জলযান হল গন্ডোলা। চমৎকার কারুকার্য খচিত, শৈল্পিক ছোঁয়ায় ফুটে ওঠা গন্ডোলায় চড়ে নদীর জলে ভাসতে ভাসতে ভেনিস মুখোশ কার্নিভালে অংশ নেন দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা। খালের পাশ ঘেঁষে যাওয়া রাস্তায় ইতিউতি ঘুরে বেড়ান। প্রাচীন কোনও মিউজিয়াম বা কোনও প্রদর্শনী শেষে পরপর মুখোশ, হ্যাট বা নানা রঙের কাচের জিনিসের দোকান। ভেনিসের পরতে পরতে মোহনীয় সৌন্দর্য। শহরকে দ্বিখণ্ডিত করেছে গ্র্যান্ড ক্যানেল। শহরজুড়ে চোখ-জুড়নো রং, নকশা ও দারুণ স্থাপত্যশৈলী। খালের দুই পাশে চমত্কার সব সেতু। মুখোশের শহরে প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয় মুখোশ কার্নিভাল। আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে প্রায় একশো আঠারোটি দ্বীপ দিয়ে গড়া ভেনিস। মধ্যযুগে প্রায় তেরোশো থেকে সতেরোশো সাল পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে, রেনেসাঁর সময়, ভেনিস ছিল প্রতিপত্তির শিখরে। ব্যবসা বলতে সিল্ক, মশলা ইত্যাদি। সেই গৌরবময় অতীতকে সোনার খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে ভেনিসবাসী। যেমন মুখোশ কার্নিভাল। নীল জলের ওপর সকালের নরম আলো পড়ে, সোনালি আলো মেখে ছোট-বড় ঢেউগুলো শব্দ করে নাচে, ওপারে দিগন্তের গায়ে লাল, হলুদ অট্টালিকার সারি, মাঝে একটা-দুটো গম্বুজাকৃতি চূড়া আকাশে মাথা তুলে থাকে। এক ধরনের সাদা পাখি জলের ওপরে ভেসে থাকে আর ঢেউয়ের সঙ্গে দোলে। ভেনিসে সূর্যের আলো, নীল-সবুজ জল আর আকাশের নীল রঙের সমন্বয় অতুলনীয়, যা সব সময়ই শিল্পীদের আকৃষ্ট করেছে। মুখোশের মুখেও সেই শিল্পের ছোঁয়া।
ভেনিস শহর (ছবি - রাজর্ষি ঘোষ)
বহুদিন আগে ভেনিসের অধিবাসীরা আল্পস থেকে আনা বড় বড় পাইন গাছের গুঁড়ি ভেনিসের নরম পলিমাটির মধ্যে ঠেসে পুঁতে রেখেছিল। কালের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি জমে শক্ত হয়ে গেছে। তার ওপরে গাছের গুঁড়ি বিছিয়ে আর পাথর দিয়ে আজকের বাড়িগুলির ভিত্তি স্থাপিত হয়। তবে ভেনিসের নতুন প্রজন্ম লেগুন ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে বসবাস করতে পছন্দ করে। ভেনিসের ক্যানালে গন্ডোলা চেপে কার্নিভালে যাওয়ার সময় মনে পড়তে পারে, ‘ছিপখান তিনদাঁড়, তিনজন মাল্লা, চৌপর দিনভর দেয় দূর পাল্লা’। একটু একটু করে দিন শেষ হয়। কার্নিভালে ছড়িয়ে থাকে নানা রং। মুখোশে ঢেকে থাকে ভেনিস।
‘তাহলে চলো বন্ধু, আমরা আমাদের মুখোশ পরে নিই,/ ভেনিসের গোধূলিতে, যেখানে গল্প মিশে যায়,/ আর চাঁদের মোহময় আভায়,/ আমরা সময়ের মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়াব,/ আমাদের পরিচয় উজ্জ্বল হবে’।
[তথ্যসূত্র : ভেনিস কার্নিভালের পোশাক : ইতিহাস এবং চরিত্র : ভেনিস ইনসাইডার গাইড, দ্য ভেনিসিয়ান মাস্কস : বার্টলেট স্কুল অফ আর্কিটেকচার, ভেনিসের কার্নিভাল : বিভিন্ন ধরনের ভেনিসীয় মুখোশের ইতিহাস এবং অর্থ : স্লো ইতালি]